খেয়াল করে দেখেছেন কি? আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে থাকালে মনে পড়ে নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের একটি বিখ্যাত কবিতার শিরোনামের কথা, ‘উদ্ভট উঠের পিঠে চলছে স্বদেশ’। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও যেন ঠিক তাই! কি একটা অদ্ভুত বস্তু যেন ভর করেছে তার উপর। সত্যি বলতে আসলেই উদ্ভট এক উঠের পিঠে চলছে অথবা ঘুরে বেরাচ্ছে আমাদের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা। সুস্থ মস্তিষ্কের সাহায্যে চিন্তা করলে আশাকরি আপনাদেরও এই লক্ষণটি চোখে পড়বে, আর যারা স্বীকার করবেন না বা মানতে পারছেন না তাদের মস্তিষ্ক যে অসুস্থ সেটাও বলছিনা। হয়তবা কোনো না কোনো স্বার্থের হিশাব-নিকাশে তারাও এটার উপর বুলি চাপড়াচ্ছেন। কিন্তু এতে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার কোনো লাভ হবে না। কেননা আমরা হয়তো দেখেছি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক উন্নতি হয়েছে, পাশের হার বেড়েছে, জিপিএ-৫ অর্থাৎ এ প্লাসের সংখ্যা বেড়েছে ইত্যাদি। সুতরাং বুঝানো হচ্ছে আমরা শিক্ষায় আগের থেকে উন্নত করছি, আমাদের শিক্ষার হার বাড়ছে! কিন্তু আধো কি তাই হচ্ছে? এই শিক্ষায় ফলাফলের বাজারে হয়ত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি চমৎকার সনদ (সার্টিফিকেট) অর্জন হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কতজন শিক্ষার্থী মূল শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন আর কতটুকুই বা শিখতে পারছেন তার কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। দেশের নিরক্ষরতা দূর করার জন্য প্রথমে গণহারে পাশ দেওয়া শুরু হল, সেখানে বিশ্বের কাছে আমাদের শিক্ষার হার বাড়ছে দেখাতে যখন আমরা সফল হলাম তখন দেওয়া হলো জিপিএ এর মান বাড়িয়ে দেওয়ার হিড়িক। এখন ঘরে ঘরে এ প্লাস। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই জিপিএ কি একটা শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও মেধা প্রমাণ করতে সহায়ক? হলেই বা কতটা সহায়ক? এটা কোনোভাবেই বিশ্বের কাছে শিক্ষার হার বাড়ছে তা প্রমাণ করে না বরং এটা চমৎকার কূটকৌশল মাত্র। সহজ ভাষায় শুভংকরের ফাঁকি!
এই শুভংকরের ফাঁকি ধরার ক্ষমতা হয়ত আমাদের অনেকেরই আছে, আবার অনেকের নেই, সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। কিন্তু যাদের আছে তারা কথা বলছিনা, আর যারা বলছেন তাদের কথায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না। যতক্ষণ না আমাদের শিক্ষার হর্তাকর্তাদের মন সদয় হবে ততক্ষণ কথা বলেও অবশ্য লাভ হবে না। তবুও কাউকে না কাউকে কথা বলা চালিয়ে যেতে হবে। কেননা মনে রাখতে হবে, “অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয়ে যায় না।” হলেও প্রলয়ের দরজায় আঘাত করে করে যেতে হবে। একদিন হয়ত সেই প্রলয়ের দরজা খুলবে। তবে কবে খুলবে কি জানি। যদি অন্তত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে খুলে তাহলে হয়ত বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এভাবে কিন্তু বাড়ছে না শিক্ষার হার, বরং বাড়ছে শিক্ষিত বেকার। কারণ দারুণ ফলাফল করা এই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশেই হচ্ছে অদক্ষ, অযোগ্য শিক্ষিত। এরা বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল করছে ঠিকই, কিন্তু চাকরির জন্য দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছে না। আর শিক্ষায় প্রকৃত মানুষ হওয়ার দৌড়ে কতটুকু এগিয়েছে বা পেরেছে সেটা আর নাইবা বললাম।
বর্তমানে বোর্ড পরীক্ষায় ফলাফলের দিকে থাকালে অনেক সময় লজ্জাও হয়। ফলাফলে জিপিএ হিড়িক অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক শিক্ষার্থীদের দেখছি সারা বছর পড়াশোনার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, এমনকি পরীক্ষার খাতায় সে কি লিখে এসেছে শিক্ষার্থী নিজেও জানে না অথচ ফলাফলে জিপিএ এর অবস্থা খুব সয়লাব। যে ফলাফলে শিক্ষার্থী নিজেই অবাক! ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর খবরের কাগজের বদৌলতে কয়েকটি কলেজের খবরাখবর চোখে পড়ল। যেমন, ঢাকার একটি কলেজে পরীক্ষার্থী ছিল ১৪২৪ জন। পাসের হার ৯৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এখানে এ প্লাস (A+) পেয়েছে ৮৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সেখানে কোনো বি কিংবা সি গ্রেড নেই। এ (A) এবং (A-) এ-মাইনাসও খুব কম। এই চিত্র প্রায় সারা দেশেই। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্রই। আগে গ্রামে যেখানে সারা গ্রামে খোঁজে একটি এ প্লাস পাওয়া যেত না সেখানে এখন ঘরে ঘরে এ প্লাস। তাই এই ফলাফলের মান ও মর্যাদাও এখন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলে এরকম প্রবণতা লক্ষনিয়। এভাবে আসলে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন হয়না।
অবশ্য এমন ফলাফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সবাই খুশী হয়। কিন্তু এইযে সবাইকে খুশী করার মত একটা শিক্ষা মাধ্যম এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি আমরা গড়ে তুলেছি এটা কতটুকু কার্যকর হবে? এই নিয়ে অবশ্য একটা নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন। আমাদের ভাবার সময় এখনই।
কিন্তু কথা হচ্ছে চলমান আনন্দদায়ক (ছিপিএ হিড়িক) অবস্থায় শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের জন্য অপ্রিয় (একটা সঠিক) সিদ্ধান্ত কি আমরা নিতে পারব?
চলমান মাধ্যমে আমরা একটি ফলাফল নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে আগাচ্ছি। কিন্তু এই ফলাফল তো প্রকৃত মেধার কোনো মূল্যায়ন হচ্ছে না। এতে করে মেধার পরাজয় ও অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এবং এটা একটা সংকটে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে সংকট চোখে দেখা যায় না। তবে ক্ষতিটা অবশ্য আঁচ করার কথা। ফলাফলের পরিসংখ্যানের হয়ত একটা হিশাব দেখছি। সেই হিশেবে মহা আনন্দে জাতি। কিন্তু এতে করে জাতিকে আরও ভঙ্গুর করে তোলা হচ্ছে। ক্ষত তৈরি হচ্ছে। এই ক্ষত সরাসরি বা সাথে সাথেই দেখা যায় না। শরীরের কিছু ক্ষত আছে যা সরাসরি দেখা যায় না, কিছু ব্যাথা আছে যা সাথে সাথে ব্যাথা অনুভব হয়না। একটা সময় পর অবশ্য সেটা ভীষণভাবে চিহ্নিত হয়। শিক্ষার এই ক্ষতটাও হয়ত একদিন সবাই এভাবে টের পাবে। কিন্তু সেটা কতটুকু সময় থাকতে টের পাবে কে জানি! ঠিক সময় মত টের পাক সেটাই আমরা চাইব।
লেখক: কলামিস্ট