২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট প্রণয়নের কাজ শেষ র্পযায়ে রয়েছে। জাতীয় বাজেট একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং রাষ্ট্রের আর্থিক পরিকল্পনা বা আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ বাজেট একটি রাষ্ট্রীয় দলিল। এবার জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রস্তাবিত বাজেট অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সম্মতি ও রাষ্টপতির অনুমোদনের পর মিডিয়ার মাধ্যমে জাতীর কাছে উপস্থাপনের কথা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রদত্ব বাজেটের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একেক ধরনের হবে যা রাজনৈতিক সরকারের আমলের তুলনায় ভিন্ন হবে বলে প্রতিয়মান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কোন খাতে কোন ধরনের সংস্কার হবে, তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনে কতটা পড়বে সে সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারছেন না। তাই সরকার তার মেয়াদে কোন কোন সংস্কার করতে আগ্রহী এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কি হবে, তা বাজেট বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার কথা রয়েছে। সন্দেহ নেই আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নানা কারণেই ভিন্নতর হবে যা হতে পারে জনবান্ধব, জাতীয় স্বার্থ, সামাজিক উন্নয়ন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রন প্রাধান্য। অন্যান্যের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থবিভাগ।
এখন আসা যাক আগামী বাজেটের বৈচিত্রের দিক গুলো কিকি যেমন:
১. আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট হবে ঋণের দুষ্টচক্র ভাঙার। এক্ষেত্রে দেশি ও বৈদেশিক উভয় ঋণের কথাই বলা হচ্ছে,বাজেট হবে দারিদ্র্য কমিয়ে আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মূল্যস্ফীতি সহ্য করার সক্ষমতা তৈরি এবং বাস্তবভিত্তিক;
২. আগামী অর্থবছরের বাজেট দিয়ে কাজটা শুরু করা হবে। এই ঋণনির্ভরতা একবারেই কমানো যাবে না। ধীরে ধীরে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসারচেষ্টা থাকবে যার একটি প্রভাব থাকবে নতুন বাজেটে। এছাড়া অর্থ সংস্থানের প্রতিকূলতা এবং ব্যয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হবে আগামী অর্থবছরে;
৩. আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোনো মেগা প্রকল্প হবে না। বরং যেগুলো চলমান সেগুলোও যাচাই-বাছাই করে বাস্তবায়নযোগ্য অংশ চলমান রাখা হবে। এরপরই প্রয়োজন অনুযায়ী চলতি মেগা প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি যেসব প্রকল্প আগামী অর্থবছরে সমাপ্ত করা হবে বলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে কমিটমেন্ট রয়েছে সেগুলোতে পর্যান্ত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে;
৪. আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে রাস্তাঘাট তৈরিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বলতে গেলে বিদ্যমান রাস্তাসহ এ সংক্রান্ত অবকাঠামোগুলোর সংস্কার, সংরক্ষণ এবং প্রশস্তকরণসহ উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত থোক বরাদ্দ রাখা। দেশের অনেক জায়গায় রাস্তার বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক রাস্তায় ব্রিজ ও কালভার্ট ভাঙা আছে। ফলে ওইসব রাস্তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে আছে সেসব মেরামতে গুরুত্ব পাবে। এছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন গুরুত্ব ও এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়ার কাজ চলছে;
৫. আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যাতে করে মূল্যস্ফীতির চাপ মানুষ বর্ধিত আয় দিয়ে সামলাতে পারে। আগামী অর্থবছরে যাতে মূল্যস্ফীতি কম থাকে সেজন্য অন্যান্য ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। গত বছর জুন-জুলাই মাসে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল এবার জুন-জুলাই মাসে এর চেয়েও অনেক কম মূল্যস্ফীতি থাকবে বলে আশা করা যায়;
৬. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমবে , তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে বরাদ্দ পর্যাপ্ত রাখা হবে। কিন্তু নতুন অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়বে না। যেসব অবকাঠামো বিদ্যমান আছে সেগুলো সচল করা এবং পরিচালন খাতে ব্যয় বাড়ানো হবে। অবকাঠামো তৈরি করে ব্যবহার না করাটা একটি বড় অপচয়। এজন্য অব্যবহৃত থাকা অবকাঠামোগুলো ব্যবহারযোগ্য করতে ব্যাপক প্রাধান্য দেওয়া হবে বাজেটে। ফলে সার্বিকভাবে মনে হতে পারে বরাদ্দ কমছে। আর একটি বিষয় হলো বেসরকারি শিক্ষকদের জমানো বড় অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছিল। সেই টাকার কিছু অংশ যাতে তাদের ফেরত দেওয়া যায় সেজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে বন্ড ইস্যু করার ব্যবস্থা রাখা হতে পারে যাতে ভবিষ্যতে সেই বন্ডের আয়ের টাকা দিয়ে শিক্ষকদের দায় কিছুটা মেটানো যায়। পাশাপাশি নগদ টাকাও কিছু বরাদ্দ রাখা হবে। তবে এত বছরের বঞ্চনা এক বছরের বাজেট দিয়ে তো প্রতিকার সম্ভব হবে না। এ সরকার বঞ্চনা দূরীকরণের কাজের শুরুটা করে যাবে;
৭.এটি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ অনেকেই বলছে দারিদ্র্য হার বাড়বে। দারিদ্র্য কি কর্মসংস্থানের কারণে বেড়েছে, নাকি কৃষিপণ্যের দাম কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমার কারণে বেড়েছে, নাকি রোগবালাই বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ায় দারিদ্র্য বাড়ছে সেটি খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচনে বরাদ্দ থাকবে।
প্রয়োজনে বাড়তি কর্মসূচির জন্য থোক বরাদ্দ থাকবে। সেটি খাতওয়ারি থাকবে, তবে দরকার হলে একটি খাত থেকে অন্য খাতে যাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যাপারে কোন কর্মসূচিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সেটিরও বরাদ্দ থাকবে নতুন বাজেটে;
৮. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো থেকে প্রকৃত উপকারভোগী চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এতে স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগানো হবে। এক্ষেত্রে অনিয়ম, দলীয়করণের ফলে জায়গা পাওয়া এবং অযোগ্যদের বাদ দেওয়া হবে। ফলে যারা প্রকৃত গরিব এবং কর্মসূচিতে থাকার যোগ্য তাদের জন্য মাথাপিছু বাড়তি বরাদ্দের সুযোগ তৈরি হবে;
৯. বাজেট কাঠামো, বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বাজেটকে একটি উদ্ভাবনী এবং ব্যবসাবান্ধব করার আকাক্সক্ষা সরকারের থাকলেও শেষ মুহূর্তের বিভিন্ন কারণে বিচ্যুতি ঘটে। যার ফলে অনেক হতাশার সঙ্গে, এটি কেবল সংখ্যার সমন্বয় সাধনের একটি এলোমেলো অনুশীলনে পরিণত হয়। সন্দেহ নেই আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট এই সমাস্যাগুলো গোচাতে সহায়ক হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি ও জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা