Saturday 17 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জীবিত সম্পর্কের মৃত শরীর

সুদীপ্ত শামীম
১৭ মে ২০২৫ ১৮:০২

একটা সময় ছিল যখন সমাজ মানে ছিল একটা বড় পরিবার। একে অপরের খোঁজ রাখা, দুঃখ-সুখ ভাগ করে নেওয়া, ভিন্নমতের সহনশীলতা আর মিলেমিশে থাকার যে সহজাত প্রবণতা ছিল—তা আজ বড় বেশি দুর্লভ হয়ে উঠেছে। আজকের বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামাজিক সম্পর্কগুলো ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। ঘরে-বাইরে, পাড়ায়-মহল্লায়, কর্মক্ষেত্রে কিংবা আত্মীয়তার বন্ধনে—সব জায়গায়ই মানুষ দিন দিন একা হয়ে পড়ছে। সম্পর্কগুলো ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে, আস্থার জায়গা হারিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এই অবক্ষয়ের পেছনে একাধিক প্রভাবক কাজ করছে। এখন একে অপরের রাজনৈতিক মত জানার পরেই আমরা নির্ধারণ করে ফেলি—সে আপন, না পর। একসময় পরিবারে রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও সৌহার্দ্য ও সম্মানের পরিবেশ থাকত। আজ তা নেই। ভাই ভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে, এমনকি বাবা ছেলেকেও সন্দেহের চোখে দেখে। ফেসবুক পোস্ট, কমেন্ট কিংবা নির্বাচনে কার ব্যানার টাঙানো হয়েছে—এসবই এখন সম্পর্কের ভার মাপার মাপকাঠি হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। একপক্ষের কাছে রাতের খাবারের প্লেটেও থাকে বিদেশি ব্র্যান্ডের নাম, অন্যপক্ষ সন্ধ্যায় চুলা জ্বালাবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। এই বিপরীত বাস্তবতা মানুষকে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার বদলে প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে হিংসা, ক্ষোভ, গ্লানি—যা সম্পর্কগুলোতে বিষ ঢেলে দিচ্ছে। কেউ ভালো কিছু করলেও অন্যজন তা মেনে নিতে পারে না। প্রশংসার জায়গায় তৈরি হয় ঈর্ষা, সহযোগিতার বদলে আসে প্রতিযোগিতা।

আমরা এখন একটা ভার্চুয়াল মুখোশ পরে বাঁচছি। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম—এসব যেন আমাদের নতুন পরিবার, নতুন প্রতিবেশী। একজন ব্যক্তি প্রতিদিন অসংখ্য স্ট্যাটাস, ছবি আর রিল শেয়ার করেন, কিন্তু পাশের ঘরের মানুষটা হয়তো জানেই না, সে ভালো আছে কিনা। এই একাকীত্ব ভয়াবহ। আমাদের সম্পর্কগুলো এখন ডিজিটালাইজড—কিন্তু হৃদয়শূন্য। ভার্চুয়াল জগতে হাজার ফ্রেন্ড থাকলেও বাস্তবে পাশে বসে কথা বলার মতো একজনও নেই।

একসময় মানুষ সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে আড্ডা দিত, কেউ চা খেতে ডাকলে লজ্জা করে না করে যেত। এখন কেউ কল করলেই আমরা মেসেঞ্জারে লিখে দেই—‘ব্যস্ত আছি’। অথচ বাস্তবে হয়তো ঘরে একা বসে স্ক্রল করছি। সম্পর্ক যেন এখন ‘seen’ হয়ে যাওয়ার ভয় পায়। সম্পর্ক মানেই এখন রিপ্লাই-রিভিউ-রিঅ্যাকশন।

বিজ্ঞাপন

আজকাল আত্মকেন্দ্রিকতা একটি সামাজিক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। ‘আমি কী পেলাম’, ‘আমার লাভ কী’—এই চিন্তাই হয়ে উঠেছে সম্পর্কের ভিত্তি। অথচ প্রকৃত সম্পর্ক তখনই টিকে, যখন ত্যাগের জায়গা থাকে। আমরা আজ নিজেদের জীবনকে ‘ব্যক্তিগত প্রকল্প’ হিসেবে গড়ে তুলছি, যেখানে অন্য কেউ যুক্ত হলে তাকেই বোঝা মনে হয়। বিয়েতে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ হারাচ্ছে, বন্ধুত্বে স্বার্থ ঢুকে পড়ছে, এমনকি পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কেও দূরত্ব বাড়ছে।

মানুষ এখন কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। যে সমাজে বিশ্বাস থাকে না, সেই সমাজ কখনোই সম্পর্কনির্ভর হতে পারে না। এখন কেউ কারো পাশে দাঁড়ালে সন্দেহ হয়, ‘তার লাভটা কোথায়?’ এই মনোভাব ভয়ানক। এটা শুধু সম্পর্ক ভাঙে না, মানুষের ভেতরকার মানবিকতাকেও খেয়ে ফেলে। সবাই কেমন যেন রোবট হয়ে গেছে। হাসি-কান্নাও হয়ে গেছে নিয়মিত স্ট্যাটাস আপডেটের বিষয়।

আজকের মানুষ সময়ের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে—কাজ, ক্যারিয়ার, সামাজিক স্ট্যাটাস, আরও কিছু পাওয়ার দৌড়ে। কিন্তু এই দৌড়ে হারিয়ে ফেলছে সম্পর্কের প্রতি মনোযোগ। একজনের জন্মদিন মনে নেই, কারো সন্তান অসুস্থ সে খবরও নেই—এমনই হয়েছে বাস্তবতা। সময় হয়তো আছে, কিন্তু মন নেই, মমতা নেই। আত্মীয়তা এখন শুধুই একটা নাম, অনুভব নয়।

এই সমাজ কি তাহলে শুধু ইট, কাঠ, পাথরের? শুধু কৃত্রিম আলো আর শব্দে মোড়ানো এক শূন্যতা? আমরা কি এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে কেউ কাউকে হারালে কাঁদে না, শুধু ‘স্ট্যাটাস’ দেয়?

না, এমন তো ছিল না আমাদের সমাজ! এই সমাজ গড়ে উঠেছিল ‘যে যাই হোক, সে আমার মানুষ’—এই অনুভব নিয়ে। আমরা হারিয়ে ফেলেছি সেটাই। আর এখন দরকার সেটা ফিরিয়ে আনার।

সমাধান আসবে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছোট ছোট উদ্যোগে। পরিবারে শিশুদের শেখাতে হবে সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ। পারস্পরিক সম্পর্ককে সময় দিতে হবে, ভালোবাসা দিতে হবে, ভুল হলে ক্ষমা করতে শিখতে হবে। ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা বাড়াতে হবে, রাজনৈতিক পরিচয়ের আগে মানবিক পরিচয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে, যেন মানুষ শুধু ভোগে নয়—মূল্যবোধে বাঁচে। সবচেয়ে বড় কথা—আমাদের আবার মানুষ হতে হবে। প্রযুক্তি নয়, রাজনৈতিক পরিচয় নয়—‘মানুষ’ শব্দটা আবার আমাদের জীবনের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনতে হবে।

সম্পর্ক ভেঙে গেলে সমাজ ভেঙে পড়ে। পরিবার টেকে না, মানুষ একা হয়, মনুষ্যত্ব মরে যায়। আসুন, সম্পর্কগুলো রক্ষা করি। ছোট্ট একটি খোঁজ নেওয়া, একটা সহানুভূতির কথা বলা কিংবা কারো পাশে দাঁড়ানো—এগুলো দিয়েই আবার গড়ে উঠতে পারে ভালোবাসায় গাঁথা এক সমাজ। যেন আমরা শেষ নিঃশ্বাসেও বলতে পারি—‘আমি একা মরিনি, সম্পর্কগুলো নিয়ে বেঁচে থেকেছি।’

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

মুক্তমত সম্পর্ক সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর