Saturday 17 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাংবাদিকদের বাঁচতে দিতে হবে

সুমন বৈদ্য
১৭ মে ২০২৫ ১৮:৩০ | আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ ১৮:৩১

সাংবাদিক, একটি দেশের আশা ভরসার নাম। একটি দেশের চাপা পড়ে যাওয়া বিভিন্ন অনৈতিক খবর নিষ্ঠার মাধ্যমে সজ্জিত করে সবার সামনে তুলে ধরায় হলো একজন প্রকৃত, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকের কাজ। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সাংবাদিকতা শুধু একটি পেশা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন, জনমত গঠন এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাংবাদিকরা। তাই যথার্থই বলা হয় ‘সাংবাদিক জাতির মেরুদণ্ড’। একটি দেশের সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের অবদান অপরিসীম।

বিজ্ঞাপন

গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’। এই স্বাধীনতা রক্ষায় সাংবাদিকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। যেখানে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা স্বাধীন, সেখানে গণতন্ত্র দৃঢ় হয়। আর যেখানে সাংবাদিকরা নিপীড়নের শিকার, সেখানে স্বেচ্ছাচারিতার উত্থান ঘটে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সময়ে সাংবাদিকরা পেশাগত নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক সংকট, ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য, সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তাহীনতা—এসব কারণে সাংবাদিকতার মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আবার অনেকে সাংবাদিকতার আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা ও অর্থ উপার্জনের পথে হাঁটছেন, যা প্রকৃত সাংবাদিকতার জন্য হুমকি স্বরূপ। এই থেকেই সাংবাদিক নাম শুনলেই সাধারণ জনগণ সাংবাদিকদের প্রতি সৃষ্টি হয় অনীহা এবং বদনাম হয় সাংবাদিকতা নামের পবিত্র পেশাটির। তাছাড়া অনেকেই সাংবাদিকতা পেশাকে নামমাত্রই মাইক ধরে কথা বলা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেইজ খুলে কথা বলা বা শুধু লেখালেখি করাকে বুঝায়।

কিন্তু সাংবাদিকতার বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে তাদের রয়েছে অজ্ঞতা। যেমন: অনলাইন, প্রিন্ট, ফিচার রাইটিং, অনুসন্ধানী রিপোর্টিং, ডেটা জার্নালিজম, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট, ফ্যাক্ট-চেকিং, কপিরাইটিং ইত্যাদি সাংবাদিকতার নানা শাখা আছে — কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব বিষয়ে অবগত নয়।

বিজ্ঞাপন

ফলে তারা কেবল দৃশ্যমান অংশ (মাইক হাতে রিপোর্টার বা লেখক) হিসেবেই সাংবাদিকতা ভাবে। তাই এইসবের মাঝে সাংবাদিকদের বেঁচে থাকাটা যেনো অনেকটাই দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে।

একটা সময় তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের পেশা ছিল সাংবাদিকতা। সাহসী ও চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকেই বেছে নিতেন তারা। বলা হয়ে থাকে সাংবাদিক জাতির চতুর্থ স্তম্ভ। এখন বোধহয় সেই সোনালী সময়গুলো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনার হার বাড়ছে। কিন্তু পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতায় আসার হার বাড়ছে না। আবার যারা এসেছেন, তাদের অনেকেই এই পেশা ছেড়েছেন, আর যারা আছেন, তাদের কেউ কেউ ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন। সুযোগ পেলেই অন্য কোনও চাকরিতে চলে যাচ্ছেন তারা।

একটি দেশে চিন্তা প্রকাশের অবারিত স্বাধীনতার যে গণতান্ত্রিক সুযোগ থাকা দরকার, তা নানানভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু লোভী ও স্বার্থান্বেষী মহলের চাপের কারণে ভয়ের একটি পরিবেশ তৈরি করেছে।সংবাদমাধ্যম ও নাগরিকের মতপ্রকাশ করার ক্ষেত্র যতটা সংকুচিত করা সম্ভব, তার প্রায় পুরোটাই তারা করতে পেরেছে।

এ ছাড়া সাংবাদিকতায় যথোপযুক্ত মানবসম্পদের অভাব বড় একটি সমস্যা। এখন সংবাদকর্মীদের অধিকাংশেরই সিরিয়াস পড়াশোনার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হচ্ছে না চৌকস ও মেধাবী সংবাদকর্মী। এর ফলস্বরূপ সংবাদকর্মীর মাথায় তীক্ষ্ণ প্রশ্ন কাজ করছে না, ক্ষমতার নানা উৎস থেকে কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করবে, মানুষের তরফে কীভাবে ক্ষমতাবানদের জবাবদিহির আওতায় আনবে? সেইসব বিষয় থেকে তারা রয়েছে যোজন যোজন দূরে।

একইভাবে কমে গেছে সাহসী তারুণ্য, যেটি সাংবাদিকতার জন্য খুবই দরকার। ফলে সংবাদমাধ্যমকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

সাংবাদিকদের মাঠপর্যায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ঝুঁকি আরও বেশি। ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আক্রোশের শিকার হতে হয়, অনেকের জীবনও চলে যায়। সন্ত্রাসীরা সাংবাদিকদের খুন করে। অন্যদিকে কিছু সুযোগ সন্ধানী স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যক্তিগণরা সাংবাদিকদের নামে মামলা ঠুকে দেয়, হয়রানি করে। আবার কথায় কথায় রাজপথে সাংবাদিক পেটায়। সাংবাদিকদের মূল্যায়ন সমাজ ও রাষ্ট্রে নেই বললেই চলে। একজন সাংবাদিকের নিষ্ঠা, শ্রম, সততা, আদর্শবাদিতা ও জীবন-ঝুঁকি অবলীলায় ঢাকা পড়ে যায়।

এ দেশে বরাবরই নানাভাবে হামলা মামলার শিকার হচ্ছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাউকে ছাড় না দিয়ে একজন সাংবাদিককে ঘুষ-দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখতে হয়। আর তাতেই ক্ষেপে যান সংশ্লিষ্টরা। কখনো জীবন কেড়ে নেওয়া, কখনো শারীরিকভাবে হামলা, আবার প্রায়ই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে সাংবাদিকদের। সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন এখন শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কারণে-অকারণে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করা হচ্ছে, সাংবাদিক খুন হচ্ছে।

পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই সাংবাদিক পেশার উপর অমানবিকের চিত্রটা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ১৫ বছরে সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতনের ৩ হাজার ৬৪১টি ঘটনা ঘটেছে এবং খুন হন ৩০ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে সর্বশেষ তিন বছরে ৬৮২টি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বা গল্পকথক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তার এক লেখায় বলেছেন, সাংবাদিকতা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পেশা। তিনি নিজে সাংবাদিক ছিলেন বলে হয়তো কথাটা বলেছেন। অথবা বলেছেন বিশ্ব প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওই মন্তব্য কতটা যৌক্তিক তা বিবেচনার দাবি রাখে।

উন্নত দেশগুলোতে যে কেউ ইচ্ছা করলেই সাংবাদিকতায় আসতে পারে না। কারণ সাংবাদিক হওয়ার জন্য নূ্যনতম যোগ্যতা হচ্ছে- ভালো লেখাপড়া জানা, মাতৃভাষা ও ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত করা। লেখার ও লেখা সম্পাদনার ক্ষমতা দক্ষতা থাকা। দেশের ও বিদেশের সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলা। অবাক ব্যাপার যে, ভাষা সম্পর্কে যার কোনো ধারণা নেই, এডিটিং সেন্স যার নেই, নিজের পত্রিকাটাও যিনি মনোযোগ দিয়ে পড়েন না, পৃথিবীর ৯৫ ভাগ যার অজানা তিনিই হচ্ছেন সবচেয়ে বড় সাংবাদিক। এ ধরনের সাংবাদিকরা আবার রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন এবং সমাজে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের নিবন্ধন শাখা থেকে সংবাদপত্রের নিবন্ধন প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ৩২১০টি (অনলাইন গণমাধ্যম ব্যতীত) যার মধ্যে ১৩৫৭টি ঢাকা থেকে এবং ১৮৫৩টি অন্যান্য জেলা থেকে প্রকাশিত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে অনুমোদিত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সংখ্যা ৪৫টি, এর মধ্যে সম্প্রচার রয়েছে ৩৫টি। সেইসাথে দেশে অনলাইন নিবন্ধিত মিডিয়া রয়েছে ২০৪টি।এর মধ্যে সাপ্তাহিক ১২১৪ টি, মাসিক ৪২৫ টি।

অথচ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নিয়মিত বেতনভাতা পরিশোধ করছে। চাকরির অনিশ্চয়তা, পেশাদারিত্বের অভাবের কারণে অনেক মেধাবী সাংবাদিক এখন আর এই পেশায় থাকছেন না। আর সে থেকেই দেশে সাংবাদিকতা এখনও পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই পেশা অনিশ্চয়তায় ভরা। কাজের স্থায়িত্ব বা নিশ্চয়তা নেই। তাই ক্যারিয়ার হিসেবে তরুণরা সাংবাদিকতাকে আর বেছে নিতে পারছেন না। অনেকেই হয়তো আপদকালীন হিসেবে সাংবাদিকতায় আসছেন কিন্তু পরে সুযোগ বুঝে ছেড়ে দিচ্ছেন এই পেশা। কেউবা পার্টটাইম করছেন, তাও শখের বশে। মিডিয়া সেক্টরে পেশাদারিত্ব নেই বলেই পেশার প্রতি আগ্রহ বা ঝোঁকও নেই। কারণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হোক আর আদর্শিক লড়াই হোক, ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তাটা আগে চাই।

সংবাদমাধ্যমে কর্মচারীরা মাসের পর মাস বেতনহীনই থাকছেন। গার্মেন্টসেও কর্মী ছাঁটাই নীতিমালা আছে। শ্রম আইন আছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনও নীতিমালার তোয়াক্কা নেই।

একজন সাংবাদিককে আইনের রক্ষক বলা হয় এজন্যই কারণ একজন সাংবাদিককে তার কাজ নিষ্ঠার সাথে করে যাওয়ার জন্য থাকে না সরকারী ছুটি, থাকে না পূজার ছুটি, থাকে না ঈদের ছুটি। কিন্তু সেই সাংবাদিককের বেতন ধরা হয় অনেক দৃষ্টিকটু ভাবে। সেই বেতন থেকে একটু বাড়তি বেতন পাওয়ার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় বছরখানেক। যে বেতন টুকু পায় তা দিয়ে একটি সংসার চালাতে তার হিমশিম খেতে হয়, হিমসিম খেতে হয় তার ব্যাংকে টাকা জমাতেও। তাছাড়া প্রতিনিয়ত তাদের মাঝে টেনশন কাজ করে। এই বুঝি চাকরি হারাতে হলো। এছাড়া হরহামেশাই কর্মী ছাঁটাই তো চলছেই। যারা পারছেন পেশা বদল করছেন, বিদেশ যাচ্ছেন আর যারা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না, তারা অনেকে ঢাকা শহর থেকে পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সন্তান নিয়ে কষ্ট আর কতটা সহ্য করা যায়। এছাড়া বাসাভাড়া সময়মতো দিতে না পারলে কে থাকতে দেবে? অন্য পেশায় যেখানে দেখা যায়, অভিজ্ঞ ও মেধাবীদের মূল্যায়ন বেশি, এই পেশায় তার উল্টো। বয়স হলেই চাকরি হারানোর আতঙ্ক। বেশি মেধাবী হওয়ার দরকার নেই। টিভি হলে হাতে ‘বুম’ আর কিছুটা লিখতে জানলেই হলো। এসব কারণে কমে যাচ্ছে মেধাবী সাংবাদিকের সংখ্যা।

একজন মানুষের চাকরি হারানো মানে শুধু তার চাকরি হারানো নয়, তার সামাজিক মর্যাদা, দৈনন্দিন চলাফেরা—সর্বোপরি একটি পরিবার যেন পতনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। যার ফলে বজলুর রহমান, মাহ্‌ফুজ আনাম, মতিউর রহমান, শাহাদাত চৌধুরী, মিজানুর রহমান খান, গৌতম দাসের মতন দেশবরেণ্য সাংবাদিক আর তৈরি হচ্ছে না। হচ্ছে না মেধার বিকাশ। থেমে যাচ্ছে সত্য আর ন্যায়পরায়ণের মাধ্যমে সংবাদ প্রদান করার কলম।

সংবাদকর্মীদের বেশিরভাগই আজ অসুখী। কিন্তু তারপরও সাংবাদিকরা বসে থাকে না কারণ সাংবাদিক মানেই যে জাতির চতুর্থ স্তম্ভ। আর তাই জনণগণকে নিত্যনতুন খবর ন্যায়পরায়ণ এবং সত্যতার সাথে পৌঁছে দেওয়ার জন্য লড়াইটুকু করে যায় রোজ‌।

সংবাদমাধ্যমের দুর্দিনের আরও একটি কারণ হলো বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া। যে হারে গণমাধ্যমের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সে হারে কিন্তু বিজ্ঞাপনের বাজার বাড়েনি। আগে বিজ্ঞাপন অফিসে আসতো আর এখন বিজ্ঞাপনের জন্য বিভিন্ন দূর্ভোগ লাগে। সাংবাদিকদের একট অংশ এখন নির্ভর হয়ে পড়েছেন দৈনন্দিন সংবাদ মানে ডেজ ইভেন্ট বা প্রেস রিলিজের ওপর। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নেই বললেই চলে।

অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ কথা সত্য বটে। কিন্তু এই শিল্প যে ধুঁকে ধুঁকে চলছে, সেটি তদারকি করার সময় এসেছে। তাই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের দায়িত্ব নিতে হবে। তাই এই পেশায় বিভিন্ন ধরনের দিকনির্দেশনা ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

ভাবতে হবে কেন একজন মেধাবী তরুণ এই পেশায় এসে হতাশায় থাকবেন, কেন পেশা ছাড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়বেন। একসময় একতা ছিল বলেই সরকার অন্যায় করতে ভয় পেতো। আর এখন থোড়াই কেয়ার করে। সেই একতাটা জরুরি। এই পেশায় যে অঢেল অর্থ নেই সেটি সংবাদকর্মী মাত্রই জানেন। সেটিকে কেয়ার না করেই সত্যের পিছনে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ায় হলো একজন সাংবাদিকের শক্তি।

এইবার আসা যাক নারী সাংবাদিকদের বিষয়ে। বলা যায় নারীরা শুধু ঘরেই নয়, নারী শক্তি সমাজ গঠনে, পরিবারে, শিক্ষায়, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে এবং জাতির উন্নয়নে অপরিসীম অবদান রাখে।

কিন্তু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তা হয়ে যায় উল্টো। অনেক পরিবার এখনও নারীদের সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যেতে উৎসাহিত করে না। রাতের ডিউটি, বাইরে কাজ করার ঝামেলা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে পরিবার থেকে বাধা আসে।

মাঠপর্যায়ে কাজ করা, বিশেষ করে দুর্গম এলাকা বা সহিংস পরিবেশে রিপোর্টিং করা নারীদের জন্য অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। শ্লীলতাহানির ও হেনস্তার আশঙ্কাও অনেক নারীকে দূরে রাখে। অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে এখনো নারীদের প্রতি সমান সুযোগ বা নেতৃত্বের পদে পৌঁছানোর সুযোগ সীমিত। ফলে নারীরা নিরুৎসাহিত হয়।

সাংবাদিকতা পেশায় আর্থিক নিরাপত্তা তুলনামূলক কম হওয়ায় অনেক নারী পরিবার ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে অন্য পেশা বেছে নেন। অনেক নারী সাংবাদিক সফল হলেও তাদের সংখ্যা কম। নতুন প্রজন্মের নারীরা যদি বেশি রোল মডেল দেখতে পেতো, তবে আগ্রহ বাড়তো।

অন্যদিকে বাংলাদেশে এর মতো উন্নয়নশীল দেশে অভিভাবকরা সাধারণত তাদের সন্তানদের সাংবাদিকতা পড়ানোর ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী হন না। এর পেছনে কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পেশাগত কারণ রয়েছে।

অভিভাবকরা মনে করেন, সাংবাদিকতা পেশায় উচ্চ আয় ও স্থায়িত্ব নেই। সরকারি চাকরি, ব্যাংক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী পেশাগুলোতে নিরাপদ বেতন, পেনশন, চাকরির নিরাপত্তা থাকে। যা সাংবাদিকতায় তুলনামূলকভাবে কম।

মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি হারানোর ঝুঁকি, বেতন বৈষম্য ও অনিশ্চিত ক্যারিয়ার দেখে অনেকেই সন্তানদের এই পেশায় যেতে নিরুৎসাহিত করেন।

মাঠ পর্যায়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে হুমকি, মামলা, হামলার শিকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কাজ করলে নিরাপত্তার অভাব হয়। অভিভাবকরা সন্তানদের এসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ থেকে দূরে রাখতে চান।

অনেক অভিভাবক জানেন না যে আধুনিক সাংবাদিকতা পেশায় ডিজিটাল মিডিয়া, মাল্টিমিডিয়া প্রডাকশন, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, ব্র্যান্ড জার্নালিজমের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ সুযোগ রয়েছে। সাংবাদিকতা মানেই শুধু ‘সংবাদপত্রের রিপোর্টার’ – এই সীমিত ধারণার কারণে তারা সন্তানদের এই পথে যেতে উৎসাহ দেন না।

কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন, যেমন হলুদ সাংবাদিকতা, গুজব ছড়ানো ইত্যাদি কারণে অভিভাবকরা পেশাটি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। এর ফলে সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। ডিজিটাল মিডিয়ার বিস্তারের ফলে প্রচলিত সাংবাদিকতার ধরণ বদলে যাচ্ছে। অনেকে নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিচ্ছেন।

তাই সাংবাদিকদের অবস্থার উন্নতি করতে হলে পেশাগত নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন, চাকরির নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী মহল ও কর্পোরেট চাপমুক্ত সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, তথ্য পাওয়ার অধিকার ও বাকস্বাধীনতা আইনি কাঠামোতে রক্ষা করতে হবে।

তাছাড়া বর্তমান সাংবাদিকতাকে ধরা হয় ডিজিটাল সাংবাদিকতা। তাই অদূরে ভবিষ্যতে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক দরবার প্রতিষ্ঠা করতে হলে বেশকিছু সময়োপযোগী স্কিল-ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দরকার। যেমন:

তথ্য যাচাই (Fact-checking) ও অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা।ডিজিটাল সাংবাদিকতা ও কন্টেন্ট ভেরিফিকেশন। ডেটা জার্নালিজম ও ভিজ্যুয়ালাইজেশন (ইন্টারেক্টিভ রিপোর্টিং)। মিডিয়া এথিক্স ও আইনগত জ্ঞান। ভিডিও প্রোডাকশন, মোবাইল জার্নালিজম (MoJo)।

এআই সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যার ফলে সাংবাদিকরা সহজে এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে দ্রুত ফ্যাক্ট-চেকিং, ফেক নিউজ শনাক্ত করতে পারবে। সোশ্যাল মিডিয়া-ভিত্তিক গুজব প্রতিরোধে AI বড় ভূমিকা রাখবে। অডিও-ভিজ্যুয়াল AI টুল দিয়ে সহজেই ডকুমেন্টারি বা ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং তৈরি করতে পারবে। পাঠকের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী পারসোনালাইজড নিউজ ফিড তৈরিতে এআই সাংবাদিকদের সহায়তা করবে।এতে ভবিষ্যতে যেসব সাংবাদিক AI-ভিত্তিক দক্ষতা অর্জন করবে, তারা বাজারে বেশি চাহিদাসম্পন্ন, দক্ষ ও প্রভাবশালী হবে।

সেইসাথে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা, ফেলোশিপ ও ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালু করা।অনলাইন কোর্স, ওয়েবিনার, সার্টিফিকেশন।

অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মকে সাংবাদিকতা পড়াশোনা ও পেশায় আসার জন্য সাংবাদিকতা শিক্ষার আধুনিকায়ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক সাংবাদিকতা (Practical Media Lab), ডিজিটাল নিউজরুম সিমুলেশন চালু করা।

সাংবাদিকতা ও কমিউনিকেশনের কারিকুলামে প্রযুক্তিনির্ভরতা যুক্ত করা। সফল, নৈতিক ও প্রভাবশালী সাংবাদিকদের গল্প ও অভিজ্ঞতা তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়াতে সাংবাদিকতার মূল্যবোধ নিয়ে আকর্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি করা।

ইন্টার্নশিপ, ট্রেনিং, স্কলারশিপ ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা।ইউথ মিডিয়া ফোরাম, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক রিপোর্টিং প্রতিযোগিতা চালু করা।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শুধু সংবাদমাধ্যম বা তার কর্মীদের জন্যই প্রয়োজন নয়। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর যখন কোনো হুমকি আসে, সেটি গোটা জনগণের ওপরই আসে। কারণ, জনগণ তখন প্রয়োজনীয় তথ্য থেকে বঞ্চিত হয়। এই যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, যারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সুন্দর মার্জিত গণতান্ত্রিক রূপান্তর চায় তাদের কথা তো আমরা সাংবাদিকদের মাধ্যমেই জানতে পারি। তাই সংবাদমাধ্যমের যে কমিটমেন্ট বা প্রতিশ্রুতি, তা রক্ষার দায় শুধু আমাদের নয়, জনগণকেও বুঝতে হবে, কারণ এটি তার জন্যও সমস্যা।

তাই সবাই যদি সাংবাদিকদের অধিকার সোচ্চার থাকে এবং গৃহীত পদ্ধতি যদি অবলম্বন করা হয় তাহলে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে সাংবাদিকতার অগ্ৰণী যাত্রা তৈরি হবে। সেইসাথে সকল সাংবাদিকরাও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

সারাবাংলা/এএসজি

মুক্তমত সাংবাদিক সুমন বৈদ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর