Saturday 17 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকার আন্দোলন-অনশন: গণতন্ত্রের চর্চা না জনজীবনের অচলাবস্থা

মীর আব্দুল আলীম
১৭ মে ২০২৫ ১৮:৪১

ঢাকা— বাংলাদেশের রাজধানী-শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, রাজনীতি এবং আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুও। এখানে বসবাস করে কোটি কোটি মানুষ। এই শহরের রাজপথ যেন বারবার আন্দোলনের মুখোমুখি হয়। প্রতিদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন নানা দাবিতে রাস্তায় অবস্থান নেয়, অনশন করে, মিছিল করে। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, রাজনৈতিক দল-সবারই দাবি দাওয়ার অঙ্গীকার! কিন্তু প্রশ্ন উঠেই যায়, এই ‘আন্দোলন রাজধানী’ কি আদৌ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা আর স্বাভাবিক চলাচলকে সম্মান করে? রাস্তায় আটকে অফিস, স্কুল, হাসপাতালের জরুরি সেবা-সবই যেন বন্ধের মুখে।

বিজ্ঞাপন

এসব কর্মসূচি প্রায়ই নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে যান চলাচল ব্যাহত করে। এতে অফিসগামী কর্মী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, রোগী এবং সাধারণ মানুষ-সবাইই ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেক সময় জরুরি সেবা বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। আন্দোলন অবশ্য গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, কিন্তু যখন তা জনজীবন বিপর্যস্ত করে এবং সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন প্রশ্ন ওঠে—এখনকার আন্দোলন কি আদর্শের জন্য, নাকি কেবল রাজনৈতিক প্রদর্শনী? অনশন এখন আর আত্মত্যাগের নিদর্শন নয়, মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে নাটকীয়তায় পরিণত হয়েছে। মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা এক্ষেত্রে দ্বিধাস্পদ। ঢাকার এই অবস্থা সত্যিই উদ্বেগজনক; একটি শহর যেখানে প্রতিবাদের স্বাধীনতা থাকা উচিত, সেখানে সাধারণ মানুষের চলাচল ও জীবনের অধিকার কতটা রক্ষা হচ্ছে—এটাই এখন বড় প্রশ্ন। তাই প্রয়োজন সচেতন ও দায়িত্বশীল আন্দোলন, যাতে গণতন্ত্রের মূল্যবোধ বজায় থাকে এবং সাধারণ মানুষের জীবন দুর্ভোগমুক্ত থাকে। প্রশ্ন উঠছে-এই আন্দোলন ও অনশন কি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা নাকি জনজীবনের উপর একধরনের নির্যাতন?

বিজ্ঞাপন

আন্দোলনের অধিকার এবং নাগরিকের দুর্ভোগ

গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তির অন্যতম স্তম্ভ হলো মতপ্রকাশ ও আন্দোলনের স্বাধীনতা। নাগরিক সমাজের স্বার্থ রক্ষায় কোনো দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন, অনশন, প্রতিবাদ বা অবস্থান কর্মসূচি চালানো একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। এই অধিকার সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত এবং ইতিহাসেও এর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ—সব কিছুতেই সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদের শক্তি ছিল মূল চালিকাশক্তি। অতএব, যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই ধরনের আন্দোলন একটি ন্যায্য এবং জরুরি অস্ত্র। তবে প্রশ্ন উঠছে, আন্দোলনের পদ্ধতি ও এর প্রভাব নিয়ে। বর্তমান সময়ে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ‘আন্দোলন’ শব্দটি যেন একটি বিভীষিকাময় বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, দাবি আদায়ের নামে রাস্তায় অবস্থান, মিছিল, আগুন জ্বালানো, টায়ার পোড়ানো, বাঁশের ব্যারিকেড বসিয়ে পথ অবরোধ করা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। পল্টন মোড়, প্রেসক্লাব এলাকা, জাতীয় জাদুঘরের সামনে কিংবা শাহবাগ—এগুলো যেন আন্দোলনের স্থায়ী মঞ্চে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে মাইকে স্লোগান, রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতা, ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে যাওয়া জনপদ। ফলে গোটা রাজধানী জুড়ে সৃষ্টি হয় চরম বিশৃঙ্খলা।

এই কর্মসূচির প্রধান শিকার হয় সাধারণ নাগরিক। স্কুলগামী শিশু, পরীক্ষার্থী, অফিসগামী কর্মচারী, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা কিংবা রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স—সবার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এই তথাকথিত ‘জনতার কর্মসূচি’র কারণে। কেউ পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে অফিসে যাচ্ছে, কেউ আটকে আছে অ্যাম্বুলেন্সে, কেউ পরীক্ষার সময় পার করে দাঁড়িয়ে আছে জ্যামে। এমনও দেখা গেছে, অ্যাম্বুলেন্স না চলার কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটেছে, সন্তান প্রসব করেছেন সড়কের পাশেই এক অসহায় মা। অথচ এই দুর্ভোগের দায় কেউ নেয় না। প্রতিদিন সকাল হলে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে—আজ আবার কোন কর্মসূচি? কোথায় জ্যাম? কোন রাস্তায় যাওয়া যাবে না? গণপরিবহন অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দিতে বাধ্য হয়। ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ে। একটি দিনের আন্দোলনে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয় জাতীয় অর্থনীতিতে, যা পরোক্ষভাবে দেশের জনগণের ঘাড়েই চাপে। আন্দোলনকারীরা তাদের বক্তব্যে দাবি করেন, ‘এটি জনগণের অধিকার’। কিন্তু সাধারণ জনগণ তো প্রশ্ন করতে চায়—এই ‘জনগণ’ কারা?

এখানে একটি জটিল দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে—আন্দোলনের অধিকার বনাম নাগরিকের চলাচলের স্বাধীনতা। একপক্ষ তার বক্তব্য জানানোর অধিকার চায়, আর অন্যপক্ষ চায় নিরবিচারে চলাচল, কাজকর্ম করার সুযোগ। এই দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট স্থানে সভা-সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই অধিকার প্রয়োগের নামে যদি রাস্তা দখল, যান চলাচলে বাধা, সরকারি-বেসরকারি অফিসের কার্যক্রমে বিঘ্ন, পরিবেশদূষণ, আতঙ্ক সৃষ্টি, জনজীবনে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়—তবে তা গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, বরং তা আইনভঙ্গ এবং নৈতিক সন্ত্রাসের পর্যায়ে পড়ে।

একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার মানেই তার দায়িত্বও। যার যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনই অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার নৈতিক দায়িত্বও রয়েছে। কিন্তু এই ভারসাম্য রক্ষার সংস্কৃতি দেশে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন মানেই যেন চরম পন্থা, আগুন সন্ত্রাস, রাস্তা অবরোধ, প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষ। এর ফলে জনগণের মনে তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক ও ক্ষোভ, যা গণতন্ত্রের জন্যও হুমকিস্বরূপ। আন্দোলনের সংস্কৃতি যে শুধু জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে তা-ই নয়, বরং ধীরে ধীরে তা রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস করছে। মানুষ ভাবছে, আন্দোলন মানেই বিশৃঙ্খলা, ভোগান্তি আর ক্ষয়ক্ষতি। রাজনৈতিক বা সামাজিক দাবি যতই যৌক্তিক হোক না কেন, যদি তা জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে, তবে সেই আন্দোলনের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মানুষ আর প্রশ্ন করে না আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী, বরং প্রথমেই ভাবে—এই কর্মসূচি তার জীবনে কতটা সমস্যা আনবে!

অতএব, প্রয়োজন আন্দোলনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করা দরকার, যেখানে দাবি জানানো যাবে শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে, যেখানে মানুষের চলাচল ও জীবন ব্যাহত হবে না, যেখানে আন্দোলন হবে আলোকিত চেতনার প্রতীক, নিছক আতঙ্কের উৎস নয়। সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজকে এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করতে হবে যাতে আন্দোলনের অধিকার ও নাগরিকের স্বস্তির মধ্যে এক ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। সত্যিকারের গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন এক ব্যক্তির স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত না করে। আন্দোলন হোক দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ হাতিয়ার, জনদুর্ভোগের কারণ নয়।

অনশন: আত্মত্যাগ নাকি নাটক?

অনশন-একসময় এটি ছিল আত্মত্যাগ, আত্মসংযম এবং নৈতিক প্রতিরোধের এক পবিত্র পদ্ধতি। মহাত্মা গান্ধীর অনশন, শহীদ তালুকদারের প্রতিবাদী অনশন কিংবা তাজুল ইসলামের ন্যায্য দাবি আদায়ের অনশন আমাদের ইতিহাসের গর্ব। এসব অনশনে ছিল না কোনো মিডিয়া শো-ডাউন, ছিল না জনপ্রিয়তা অর্জনের কৌশল। ছিল কেবল আত্মত্যাগের তীব্র প্রেরণা, আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা, এবং নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে হলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক নির্লোভ প্রত্যয়।
কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। অনশন এখন যেন ‘মিডিয়া ইভেন্ট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো দাবি নিয়ে অনশন ডাকলেই শুরু হয় প্রস্তুতি: কোথায় হবে, কোন মিডিয়া আসবে, কে লাইভে যাবে, মঞ্চ কোথায় সাজানো হবে, এবং কোন নেতার ভাষণ কখন শুরু হবে। এমনকি ‘অনশনকারী’দের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে, পাশে থাকে ওষুধ, কখনও হালকা স্ন্যাক্সও। কেউ কেউ ‘সন্ধ্যায় একটু বিশ্রাম নিতে হবে’ বলে আশেপাশে ঘুরে আসে। অনেক সময় অনশনের পাশেই দেখা যায় চায়ের দোকান জমজমাট, ফেসবুক লাইভে অনশনকারীর চিৎকার, আবার কেউ হাসিমুখে সেলফি তুলছে ‘হ্যাশট্যাগ অনশন’ ক্যাপশনে!

এই চিত্র শুধু অনশন পদ্ধতির নয়, গোটা প্রতিবাদ সংস্কৃতিরই অবক্ষয় নির্দেশ করে। প্রশ্ন উঠছে—এই অনশন কি আদৌ আত্মত্যাগের প্রতীক, নাকি এটি একটি পরিকল্পিত নাট্যরূপ যা দাবি আদায়ের রাজনৈতিক চাপ ও মনোযোগ পাওয়ার মাধ্যম? আন্দোলনের পবিত্রতা যদি এভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়, তবে তা শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতাকেই খর্ব করে না, বরং সত্যিকারের নিপীড়িত মানুষের দাবিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অনশন তখনই তাৎপর্যপূর্ণ হয়, যখন তাতে থাকে আত্মিক প্রস্তুতি, নিষ্ঠা, এবং সর্বোপরি আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার। মিডিয়া-নির্ভর, লোক দেখানো, সাজানো-গোছানো অনশন কেবল হাস্যরসের উপাদানই নয়, বরং এটি সামাজিক প্রতিরোধের সুশৃঙ্খল পথকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

রাজধানী: আন্দোলনের মঞ্চ না মানুষের ঘরবাড়ি?

ঢাকা শহর-বাংলাদেশের হৃদয়, দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, শিক্ষাবিষয়ক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি মানুষ এই শহরে চলাচল করে জীবিকার তাগিদে। এই শহরে রয়েছে হাজার হাজার অফিস, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন। এই শহর কেবল রাজনীতিকদের মঞ্চ নয়—এটি মানুষের ঘরবাড়ি, জীবনের কেন্দ্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজকের ঢাকা যেন প্রতিদিন এক আন্দোলনের শহর। কোথাও না কোথাও রাস্তায় শ্লোগান, অবরোধ, ধাক্কাধাক্কি, পুলিশি হস্তক্ষেপ, কিংবা পেট্রোলবোমা—সবই একরকম স্বাভাবিক চিত্র হয়ে উঠেছে। প্রেসক্লাব, জাতীয় জাদুঘরের সামনের মোড়, পল্টন, শাহবাগ কিংবা সেগুনবাগিচা—সব জায়গা যেন স্থায়ী প্রতিবাদ মঞ্চ। স্কুলপড়ুয়া শিশু, চাকরিজীবী, রোগী, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী—সবাই যখন সকালে বের হয়, তখন তাদের মনে একটাই প্রশ্ন: ‘আজ কোন রাস্তা বন্ধ?’

ধরা যাক, একজন গার্মেন্টস কর্মী সকালে সাতটায় বের হয়েছেন সাভার থেকে কারখানায় পৌঁছাতে। তিনি ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে কারখানায় পৌঁছাতে দেরি করলেন, ফলে তার বেতন কাটা পড়ল বা চাকরি হারালেন। অন্যদিকে একজন গুরুতর অসুস্থ রোগী অ্যাম্বুলেন্সে আটকে রইলেন আন্দোলনের কারণে, কারণ আন্দোলনকারীরা রাস্তা ছেড়ে দেয়নি। কেউ পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, আবার কেউ মা হতে চলেছে—তাদের কারো দিকেই আন্দোলনকারীদের চোখ নেই।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, সাধারণ মানুষ এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও ভয় পায়। কারণ, এই আন্দোলনগুলোর সঙ্গে ‘জনতার দাবি’ লেখা ব্যানার থাকে। আর যারা এর বিরোধিতা করে, তাদের ওপর উঠে পড়ে লাগে আন্দোলনকারীরা কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী। ফলে এক ধরনের অনৈতিক চুপ চাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়—সাধারণ মানুষ কষ্টে থাকে, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে না। ঢাকা শহরকে যদি প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক পরীক্ষাগারে পরিণত করা হয়, তাহলে তা দেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। সময় এসেছে ভাববার—এই শহর কি শুধু রাজনৈতিক খেলা চালানোর বোর্ড, নাকি এটি এক কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের মূলভিত্তি?

রাজনৈতিক লাভের খেলা

আন্দোলন বা অনশন যখন কোনো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন সেটি ন্যায্য দাবি আদায়ের চেয়ে রাজনৈতিক চাপ তৈরি এবং প্রচারমূলক কৌশলের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই কৌশলের পেছনে থাকে ক্যামেরার সামনে নাটকীয়তা প্রদর্শন, দলীয় নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, মিডিয়ায় কাভারেজ পাওয়া এবং বিরোধী পক্ষকে কোণঠাসা করার অপচেষ্টা। এর ফলে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ক্রমশ বিস্মৃত হয়, আর জনগণের কষ্টের বিষয়গুলো আড়ালে চলে যায়।

এমনও দেখা যায়-একটি দল বা গোষ্ঠী দাবি তোলে, রাস্তা অবরোধ করে, অনশন করে, শ্লোগান দেয়-কিন্তু সে দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় সেগুলো হয় অস্পষ্ট, নয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা নয়, বরং মিডিয়ায় ‘ফোকাস’ পেতেই যেন বেশি আগ্রহ। দলীয় নেতারা আসেন, ক্যামেরার সামনে চিৎকার করে বক্তব্য দেন, ব্যানারে শোভা পায় দলীয় লোগো। অথচ সেই বক্তব্যে থাকেনা সাধারণ মানুষের দুর্দশার বিবরণ, কিংবা আন্দোলনের ফলে জনগণের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা নিয়ে সামান্যও উদ্বেগ। এই রাজনৈতিক নাটকীয়তা কতটা অমানবিক রূপ নিতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায় প্রতিদিনের খবরের শিরোনামে। অনশনের পাশেই দেখা যায় চেয়ার পেতে নেতাদের প্রেস ব্রিফিং, অনশনকারীকে বলা হয় ‘ক্যামেরার সামনে দাঁড়াও’, যেন একটি সংবেদনশীল ঘটনা না, বরং এটি একটি সাজানো দৃশ্য।

আন্দোলনের মাধ্যম যদি জনসমর্থনের জায়গা না হয়ে মিডিয়া দখলের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়, তবে তার প্রভাব পড়ে গোটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর। মানুষের আস্থা কমে, আন্দোলনকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না, এবং পরিণামে সত্যিকার দাবিও গুরুত্ব হারায়। আন্দোলনের এই বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক চেহারা প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য এক বিপজ্জনক সংকেত। অতএব, রাজনীতির দায়িত্বশীলতা এখানেই যে, জনগণের দুর্ভোগকে সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দাবিকে মানুষের কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আন্দোলন হোক দাবি আদায়ের গৌরবময় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি—হড়ঃ ‘শোডাউনের স্টেজ শো’।

সমাধানের পথ কী?

১. আন্দোলনের জন্য নির্ধারিত স্থান: বর্তমানে আমাদের শহরের ব্যস্ততম সড়কগুলো প্রায়ই আন্দোলনের জন্য ব্যবহার করা হয়, যার ফলে জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নির্ধারিত আন্দোলন ক্ষেত্র বা প্রতীকী প্রতিবাদের মঞ্চ গড়ে তোলা জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে- ভারতে দিল্লির ‘জনতার মন্ত্র’ আন্দোলনের নির্দিষ্ট স্থান হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিক্ষোভকারী দলসমূহ পূর্ব অনুমতি নিয়ে তাদের কর্মসূচি পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফ্রিডম পার্ক’ (ঋৎববফড়স চধৎশ) আন্দোলন ও মতপ্রকাশের জন্য সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশেও এমন একটি বা একাধিক উন্মুক্ত ও সুরক্ষিত স্থান নির্ধারণ করলে একদিকে যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে নাগরিক জীবনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে না।

২. বিকল্প যান চলাচল ও পূর্বঘোষণা: অনেক সময় আন্দোলনের কারণে হঠাৎ রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে পড়ে। এই পরিস্থিতি এড়াতে- বিকল্প রুট নির্ধারণ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার অগ্রিম পরিকল্পনা থাকা উচিত, যা আন্দোলনের সময় তৎপরভাবে চালু করা যাবে। জনসাধারণকে আগে থেকেই গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, রেডিও, মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে জানানো প্রয়োজন যেন তারা নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিকল্প পথ বেছে নিতে পারে। এই পূর্বঘোষণা ও বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে রোগী, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, শ্রমিকসহ সবাই বিপদ এড়াতে সক্ষম হবে। উদাহরণস্বরূপ, লন্ডনে কোনো বড় সমাবেশ হলে মেট্রো ও বাস সার্ভিস তাৎক্ষণিকভাবে নতুন রুটে চালানো হয় এবং ওয়েবসাইট ও নিউজ মিডিয়ায় তথ্য প্রকাশ করা হয়।

৩. শান্তিপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল আন্দোলন: গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে প্রতিবাদ করা যেমন নাগরিকের অধিকার, তেমনি সেই অধিকার পালনের ধরনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলন যেন কখনোই সহিংস, উচ্ছৃঙ্খল বা ধ্বংসাত্মক না হয়- এ বিষয়ে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের দায়িত্ব নিতে হবে। কর্মীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন যাতে জনজীবন বিঘ্নিত না হয়, পুলিশি অ্যাকশনের প্রয়োজন না পড়ে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের মধ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে যেন তারা নিজেদের ভূমিকাকে দায়িত্বশীলভাবে পালন করে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের উদাহরণ হিসেবে, মাহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য, যেখানে অহিংসার মাধ্যমে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

৪. মিডিয়ার দায়িত্ব: মিডিয়া সমাজের দর্পণ-তবে সেই আয়নায় যদি শুধুই উত্তেজনা, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি আর নাটকীয়তা প্রতিফলিত হয়, তবে সেটি জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। মিডিয়ার উচিত আন্দোলনের প্রকৃত পটভূমি, দাবির যৌক্তিকতা, সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষতির দিকগুলোও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা। তারা যেন কেবল ‘সাউন্ড বাইট’ বা নাটকীয় মুহূর্ত প্রচারে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তৈরি করে। মিডিয়ার উচিত দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনমত গঠন করা, যার ফলে আন্দোলনের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয় এবং সমাজে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। নরওয়ে ও সুইডেনের গণমাধ্যমগুলো এই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত হয়, যেখানে যে কোনো প্রতিবাদ নিয়ে প্রচারের সময় বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও প্রভাব বিশ্লেষণ একসঙ্গে উঠে আসে।

এই চারটি পথ অনুসরণ করলে আন্দোলন যেমন তার মর্যাদা ও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে, তেমনি জনজীবনও ব্যাহত হবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকার-দুটোরই ভারসাম্য বজায় থাকবে।

শেষ কথা: গণতান্ত্রিক সমাজে প্রতিবাদ থাকবে, আন্দোলন থাকবে। কিন্তু সেই আন্দোলনেরও নৈতিকতা থাকা জরুরি। আন্দোলন যেন মানুষের অধিকার রক্ষার পথ হয়, জনজীবন দুর্বিষহ করার মাধ্যম না হয়। অনশন যেন আত্মত্যাগের প্রতীক থাকে, নাটক না হয়ে ওঠে। ঢাকা শহর আমাদের সকলের। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, প্রশাসন ও মিডিয়া—সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে যাতে এই শহর চলতে পারে গণতন্ত্রের সঙ্গে, কিন্তু নাগরিকদের দুর্ভোগ ছাড়াই। গণতন্ত্র মানে শুধু অধিকার নয়, দায়িত্বও। সেই দায়িত্ববোধ নিয়েই আমাদের সকলকে ভাবতে হবে: কোথায় শেষ হবে অরাজকতা, আর কোথা থেকে শুরু হবে বাস্তব সমাধান।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

অনশন আন্দোলন গণতন্ত্র মীর আব্দুল আলীম মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর