Sunday 18 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আইএমএফের ঋণের শর্ত ও অর্থনীতিতে প্রভাব

ড. মিহির কুমার রায়
১৮ মে ২০২৫ ১৬:৫২

সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট কাটাতে, ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।এরি মধ্যে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার ( ৪র্থ ও ৫ম কিস্তি) যা নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় আইএমএফ অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজস্ব আয় বৃদ্ধি,ডলারের মূল্য বাজারমূখী করন, খেলাপি ঋণ কমানো, এন.বি.আর এর পুন:গঠন, ভর্তুকি কমানো ইত্যাদি। এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য এই ধরনের প্রস্তাব অর্থনীতিতে কি প্রভাব ফেলছে তার একটি বিশ্লেষন করা।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নের ফলে নিম্নমুখী মূল্যস্ফীতির হারে ফের চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। শর্ত অনুযায়ী ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ডলারের দাম বেড়ে যাবে, কমবে টাকার মান। মূল্যস্ফীতির হার সন্তোষজনক পর্যায়ে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। এতে ঋণের সুদের হার বাড়বে, কমবে টাকার প্রবাহ। ফলে একদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের জোগানও কমবে, অন্যদিকে ব্যবসা খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে বাড়বে পণ্যের দাম। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে হলে দাম বাড়াতে হবে। ফলে সব পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়বে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির হার আবার উসকে যেতে পারে। এদিকে আইএমএফ বলেছে, এসব পদক্ষেপের ফলে দেশের অর্থনীতিতে টেকসই প্রবৃদ্ধি হবে। ডলারের দাম বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে এর প্রবাহ বেড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। রাজস্ব আয় বাড়লে সরকারের বিনিয়োগ বাড়বে।

বিজ্ঞাপন

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ডলারের ওপর কড়া নজর রাখা হবে। যাতে কোনো ব্যাংক কারসাজি করে দাম বেশি বাড়াতে না পারে। কোনো ব্যাংক সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলারের জোগান দেওয়া হবে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কারণে ডলারের দাম বেশি বাড়বে না বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরি মধ্যে বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে ডলার লেনদেন হয়েছে। এতে ডলারের দাম খুব বেশি বাড়েনি। তবে কিছু ব্যাংক ১২২ টাকা করে রেমিট্যান্স কিনে ১২৩ টাকায় বিক্রি করেছে। বেশির ভাগ ব্যাংকেই ডলারের দাম ১২২ টাকার মধ্যেই আছে। তবে আগাম বেচাকেনার ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে ২০২২ সালের মার্চ থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। ওই বছরের আগস্টে তা বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। ওই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় এ হার এখন কমছে। গত এপ্রিলে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৮ শতাংশের ঘরে। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সরকার কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ, ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছেড়ে সরকারকে ঋণের জোগান বন্ধ করা, পণ্যমূল্য কমানোর পদক্ষেপ নেয়। ফলে মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। তবে কঠোর মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কম হওয়ায় বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের গতি কমে গেছে। এতে বেকারদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কারণে বাড়বে ডলারের দাম, কমবে টাকার মান। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। বাড়বে পণ্যমূল্য। যা মূল্যস্ফীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। এতে সুদের হার বাড়বে, টাকার প্রবাহ কমবে। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এমনিতেই এখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ তলনিতে রয়েছে। বিদ্যমান অস্থিরতা, সুদের হার বেশি ও ব্যাংকে তারল্য সংকটে বেসরকারি খাত ঋণ পাচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। এতে ভোক্তার আয় বাড়বে না। কিন্তু ব্যবসা খরচ বাড়ার কারণে পণ্যমূল্য বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।

আইএমএফ সরকারের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের শর্ত দিয়েছে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে খরচ কমবে। এতে কষ্ট বাড়বে স্বল্প আয়ের মানুষের। যা তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় কমানো আইএমএফের অন্যতম একটি শর্ত। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। এর দাম বাড়লে সব খাতের পণ্য ও সেবার দামও বাড়বে। যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া আইএমএফ অনেকগুলো ভালো পরামর্শ দিয়েছে। যেগুলো বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতকে সবল করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজস্ব আয় বাড়ানো। কারন রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়া এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়ার কারণে আগামী বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এর আকার কমছে।১৮ মে অনুষ্ঠেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) এর সভায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।অনুমোদিত খসড়া অনুযায়ী, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপির আকার হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার অর্থায়ন করবে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আর প্রকল্প ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। মোট প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ১৪২টি। অনুমোদিত নতুন এডিপি চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি’র তুলনায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এটি কমিয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে সংশেধিত এডিপি’র তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এডিপি প্রয়ণনে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মোট চাহিদা ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়নের প্রস্তাব ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা এবং প্রকল্প ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ ছিল ৮৬ হাজার কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে সাম্প্রতিক সময়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যা হলো রাজস্ব নীতি ও প্রশাসন আলাদা করেছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে এই পদ্ধতি আছে। কিন্তু এটি বাংলাদেশের জন্য কতটা উপযোগী হবে, তা নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা এ বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরতে পারতেন। এদিকে অর্থনীতিবিদরা রাজস্ব খাতের এই বড় সংস্কারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এই সংস্কারের ফলে কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে। অন্যদিকে, এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, এই সংস্কারের ফলে রাজস্ব খাতে প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য বাড়তে পারে। সীমিত হতে পারে শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের সুযোগ। বিশ্বের সব দেশেই রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তাদের পেশাদার হতে হবে। অর্থাৎ দেশের জিডিপি, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান- এসব বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। যারা নীতি প্রণয়ন করবেন, তারা আবার রাজস্ব সংগ্রহও করবেন, তা হতে পারে না। এই সিদ্ধান্ত সাহসী ও সময়োপযোগী। এই সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের কর প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে। সামগ্রিক করব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে জনসংখ্যার ধনী অংশ, যারা সঠিকভাবে কর দেয় না, তাদের করের আওতায় আনতে হবে। এনবিআর বিলুপ্তির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৮ দশমিক ৫ শতাংশ; এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে এনবিআর পুনর্গঠন জরুরি। একই সংস্থা করনীতি প্রণয়ন এবং সেই নীতির বাস্তবায়ন করবে- এ অবস্থান সাংঘর্ষিক। এই নতুন নীতিমালা নিয়ে এনবিআর এর কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মাঝে অসন্তোস রয়েছে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

আইএমএফের ঋণ ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর