ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো—অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা—দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা ভারতের জন্য যেমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে, তেমনি এই অঞ্চলের জনগণের জন্যও উন্নয়ন ও আধুনিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে। সিলিগুড়ি করিডর—যা ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত—একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রয়েছে, কিন্তু এটি কখনোই কার্যকরী বা নিরাপদ যোগাযোগের পথ হয়ে ওঠেনি। এই ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে ভারত এক নতুন সমুদ্রপথ যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যা সরাসরি মিয়ানমারের উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সংযুক্ত করবে। এই পরিকল্পনায় লক্ষ্য হচ্ছে মিজোরাম ও মণিপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দর ও কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। ভারতের এই পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে, যা শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, বরং ভূরাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত দিক থেকেও বিপজ্জনক।
বর্তমানে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট করিডর হিসেবে কাজ করে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে এই অঞ্চলের পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের জন্য অনিবার্য সেতু হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই ভূখণ্ডের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে বাংলাদেশ ভারতের কাছে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তবে ভারত যদি তাদের পরিকল্পিত সমুদ্রপথ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়, তাহলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর ভারতের এই নির্ভরতা অনেকাংশে কমে যাবে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব সংকুচিত হয়ে পড়বে এবং আমাদের দেশের কৌশলগত প্রভাব হ্রাস পাবে। এই পরিবর্তন শুধু একটি ভূখণ্ডিক সংযোগের পরিবর্তন নয়; এটি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কূটনৈতিক চাপ ও আঞ্চলিক নেতৃত্বের ভূমিকা হ্রাসের ইঙ্গিত বহন করে। ভারতের নতুন সমুদ্রপথ পরিকল্পনা কার্যকর হলে বাংলাদেশ একটি গৌণ পণ্য ট্রানজিট দেশে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
অন্যদিকে, ভারতের এই পরিকল্পনা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালানপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। যদি এই অঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সমুদ্রপথের সংযোগ স্থাপিত হয়, তাহলে এই অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা আগে থেকেই রোহিঙ্গা সংকট ও সীমান্ত অপরাধের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন সমুদ্রপথ ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মাদকদ্রব্য পাচার, মানবপাচার এবং অস্ত্র পাচারের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের জন্য এটি জাতীয় নিরাপত্তা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর এক নতুন চাপ সৃষ্টি করবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিমা বাজারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ পাবে, যেখানে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে প্রায় বাইপাস করা হবে। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভৌগোলিক অবস্থানকেও অবমূল্যায়িত করবে।
বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক যে, ভারতের এই পরিকল্পনা শুধু আঞ্চলিক কৌশলগত সমীকরণকেই নয়, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যকেও পরিবর্তন করতে পারে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে ‘এক্ট ইস্ট’ নীতির আওতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং চীনকে প্রতিরোধের লক্ষ্যে এই অঞ্চলে ভারতের আগ্রাসী অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য এক কঠিন আন্তর্জাতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। ভারতের এই পরিকল্পনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) কে প্রতিহত করার একটি কৌশলগত অংশ—যেখানে বাংলাদেশ প্রায় উপেক্ষিত। বাংলাদেশের জন্য এই অবস্থা কেবল আঞ্চলিক নয়, বরং আন্তর্জাতিক চাপের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ ভারত ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ এমন এক সংকটে পড়বে, যেখানে নিজস্ব অবস্থান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের উচিত হবে একদিকে কূটনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টি তুলে ধরা। ভারতকে বোঝাতে হবে যে, তাদের এই পরিকল্পনা শুধু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যই হুমকি নয়, বরং এটি পুরো অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যও মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ফোরাম, আঞ্চলিক সংস্থা এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর কাছে ভারতের এই সমুদ্রপথ পরিকল্পনার ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির দিকটি ব্যাখ্যা করতে হবে। এতে করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়া, বাংলাদেশকে নিজস্ব বিকল্প পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখতে হবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন, নৌ-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং নিরাপত্তা জোরদার করার মাধ্যমে ভারতের এই পরিকল্পনার মোকাবিলায় নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এটি শুধু একটি আঞ্চলিক সংকট নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তা সংকটও। বাংলাদেশের সরকারের উচিত হবে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রেখে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা, বিদেশ মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা নীতিনির্ধারকদের নিয়ে জরুরি কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
সুতরাং, ভারতের এই পরিকল্পনা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বিপদ এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে এক কঠিন কূটনৈতিক অবস্থায় ফেলতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি নীরব থাকে কিংবা প্রতিরোধমূলক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তাহলে ভবিষ্যতে এর খেসারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, কৌশলগত গুরুত্ব এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের জন্য এটি শুধু একটি ‘পরিবহণ করিডর’ ইস্যু নয়; বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক অবস্থান, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক নেতৃত্বের প্রশ্ন। ভারতের এই পরিকল্পনা একদিকে যেমন বাংলাদেশের কৌশলগত শক্তি ক্ষয় করবে, তেমনি অন্যদিকে দেশের ভূখণ্ডিক স্বার্থকেও সংকুচিত করবে। বাংলাদেশের উচিত হবে দ্রুত এই পরিকল্পনার বিরোধিতায় সক্রিয় ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করা।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রংপুর