একটি সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন কেবল কিছু ইট-পাথরের স্থাপনা কিংবা চোখধাঁধানো পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যায় না। বড় বড় রাস্তা, উঁচু ভবন, ওয়াই-ফাই সংযুক্ত স্কুল কিংবা ডিজিটাল অফিস থাকলেও যদি সাধারণ মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, ন্যায়বিচার না পায়, অথবা নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী জীবনের পথ খুঁজে না পায়—তাহলে সেই সমাজ কি সত্যিকার অর্থে উন্নত? উত্তরটি পরিষ্কার—না।
সমাজ উন্নয়নের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে তিনটি স্তম্ভের ওপর: স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং মানুষের সক্ষমতার উন্নয়ন। এই তিনটি উপাদান কেবল রাজনৈতিক স্লোগান বা উন্নয়ন নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত কোন শব্দমাত্র নয়, বরং এগুলো এমন বাস্তব চাহিদা যা না থাকলে সমাজ হয়ে পড়ে বিবশ, দুর্বল এবং অবিচারপ্রবণ।
স্বাধীনতা: চিন্তা ও মতপ্রকাশের সাহস
প্রথমেই আসা যাক স্বাধীনতার প্রসঙ্গে। স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে জাতির জন্ম নয়; বরং ব্যক্তি মানুষের চিন্তা, মতপ্রকাশ, মতাদর্শ, ধর্ম, জীবনচর্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ। একটি সমাজে যখন মানুষ ভয়ভীতিহীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারে, যখন সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে সত্য তুলে ধরতে পারে এবং যখন ভিন্নমত গ্রহণযোগ্যতা পায়—তখনই সমাজের মধ্যে অন্তর্নিহিত সমস্যা উন্মোচিত হয় এবং তা সমাধানের পথ তৈরি হয়।
স্বাধীনতা মানুষের মানসিক বিকাশের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। যেখানে স্বাধীনতা নেই, সেখানে প্রশ্ন করার সাহস থাকে না, নতুন কিছু ভাবার উৎসাহ জন্মায় না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে সমাজ এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক কারাগারে পরিণত হয়—যেখানে সবাই হয় মৌন দর্শক, নয়তো ভীত-সন্ত্রস্ত অনুগামী। আজকের তরুণরা যখন সামাজিক মাধ্যমে সত্য উচ্চারণ করতে গিয়ে মামলার মুখোমুখি হয়, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করলেই লাঞ্ছিত হয়—তখন এটা কেবল ব্যক্তির সমস্যা নয়, বরং সমাজের ভবিষ্যৎকে বাধাগ্রস্ত করার একটি ভয়ানক ইঙ্গিত। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা সবাইকে কথা বলার, ভাবার ও প্রতিবাদ জানানোর সাহস দেয়।
ন্যায়বিচার: সমাজের নীরব রক্ষাকবচ
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার হলো সমাজের সেই মেরুদণ্ড, যা সমাজকে সোজা করে দাঁড়াতে শেখায়। একটি সমাজে যদি দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী অপরাধী, কিংবা ক্ষমতাবান ব্যক্তি আইনের হাত এড়িয়ে চলে বেড়াতে পারে, আর সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন হয়রানি হয়, তাহলে সে সমাজে উন্নয়ন বলে কিছুই নেই—সেখানে আছে কেবল বৈষম্য, ক্ষোভ, ও অবদমন।
ন্যায়বিচার কেবল আদালতের কাঠগড়ায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ, শিক্ষায় সমান অধিকার ও সামাজিক মর্যাদায় সমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। যে সমাজে ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, শহর-গ্রামভিত্তিক বৈষম্য নেই, সে সমাজই পারে উন্নয়নকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে।
দুঃখজনকভাবে, আমাদের অনেক সমাজে এখনো বিচার প্রভাবিত হয় ক্ষমতার দাপটে। আইন সবার জন্য সমান এই নীতিটুকু কাগজে থাকলেও বাস্তবে তা একশ্রেণির জন্য নমনীয় ও আরেক শ্রেণির জন্য কঠোর। ফলে মানুষ ন্যায়বিচারে আস্থা হারায়, আর সেই সমাজে গড়ে ওঠে ক্ষোভ, অবিশ্বাস ও বিদ্রোহের বীজ। প্রকৃত উন্নয়ন চাইলে সমাজকে এমন বিচারব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হবে, যেখানে আইনের চোখ সত্যিকার অর্থে অন্ধ—ধনী-গরিব নয়, অপরাধের ভিত্তিতে বিচার হবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা পাবে।
মানুষের সক্ষমতা: শক্তির উৎস নিজের ভেতরেই
তৃতীয় ও সবচাইতে মানবিক উপাদান হলো মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি। উন্নয়ন তখনই অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, যখন তা মানুষের ভেতরের শক্তিকে জাগ্রত করে। একজন কৃষক যখন আধুনিক চাষাবাদের জ্ঞান পায়, একজন নারী যখন আত্মনির্ভর হওয়ার পথ খুঁজে পায়, একজন তরুণ যখন প্রযুক্তি-ভিত্তিক দক্ষতা অর্জন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে—তখন সমাজ এগোয়।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি সবকিছুই মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধির উপায়। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যদি কেবল বড়লোকদের সুবিধার জন্য হয়, আর সাধারণ জনগণের দক্ষতা বা প্রয়োজনের কথা না ভাবে, তবে সেই উন্নয়ন একতরফা ও অস্থায়ী হয়।
উন্নয়ন মানে আত্মমর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
সমাজ উন্নয়নের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষকে আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করা। একজন নাগরিক যখন নিজেকে সম্মানিত, নিরাপদ ও সক্ষম মনে করে, তখনই সে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ববান হয়ে ওঠে। একজন সচেতন, ন্যায়বান, স্বাধীনচেতা নাগরিকই পারে সমাজে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে। তাকে সুযোগ দিতে হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রগুলোতে পূর্ণ অধিকার ভোগের। মানুষ তখনই আত্মমর্যাদা অনুভব করে, যখন সে তার পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য পায়, তার কথা শোনা হয়, এবং তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে। উন্নয়নের প্রকৃত মানে তাই ইট-পাথরের যন্ত্রণায় নয়, বরং মানুষের অন্তরের আত্মবিশ্বাসে নিহিত।
উন্নয়নের দৌড়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে
এখন সময় এসেছে উন্নয়নকে নতুন চোখে দেখার। রাস্তা, ব্রিজ, বিল্ডিং—এসব প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন আমরা মানুষের স্বাধীনতা রক্ষা করবো, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবো, এবং প্রত্যেক মানুষকে নিজের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবো।
উন্নয়ন হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই। যেখানে শহরের মানুষ যেমন উন্নয়নের ছায়ায় আসবে, তেমনি প্রত্যন্ত গ্রাম, নদীভাঙা চর, কিংবা পেছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও পাবে সমান গুরুত্ব। কারণ সমাজ উন্নয়নের আসল চাবিকাঠি মানুষের হাতেই—শুধু দরকার সঠিক দিকনির্দেশনা, সৎ নেতৃত্ব, এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সুযোগের ক্ষেত্র। উন্নয়নের দৌড়ে যেন কেউ পিছিয়ে না থাকে—সেই চেতনাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক