Wednesday 21 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চায়ের রাজনীতি: উপনিবেশ থেকে জাতীয় সম্পদ

সফিউল ইসলাম
২১ মে ২০২৫ ১৫:১৫

বাংলার ভোরবেলার সঙ্গে এক কাপ চায়ের সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, এর মধ্যে না আছে কেবল স্বাদ, না আছে শুধু অভ্যাস আছে ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি ও শ্রেণিচেতনার গভীর শিকড়। এই চা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ, একদিন ছিল উপনিবেশবাদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। ভারতবর্ষে চা চাষের সূচনা এবং এর পরবর্তী ইতিহাস কেবলমাত্র একটি পানীয়ের উৎপাদন ও ব্যবহারকে বোঝায় না, বরং তার ভেতরে লুকিয়ে আছে শ্রেণীশোষণ, কৃষকের শ্রমদাসত্ব, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া।

বিজ্ঞাপন

চায়ের উৎপত্তি চীনে হলেও, এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে এটি বিস্তার লাভ করে ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যিক লোভের ফলস্বরূপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনের চা আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য বজায় রাখা ব্রিটিশদের পক্ষে ক্রমশ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তখন ব্রিটিশরা চিন্তা করে কিভাবে চায়ের চাষ নিজেদের উপনিবেশেই শুরু করা যায়। তারা নজর দেয় ভারতবর্ষের ওপর, বিশেষত আসাম ও দার্জিলিং অঞ্চলের পাহাড়ি ভূমিতে, যেখানে জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতি চা চাষের অনুকূল।

বিজ্ঞাপন

এই সিদ্ধান্ত শুধু কৃষিকে নয়, সমাজকে পুনর্গঠিত করেছিল। ১৮৩০-এর দশকে যখন ব্রিটিশরা আসামে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু করে, তখন থেকেই শ্রমশক্তি সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণের এক নির্মম প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্রিটিশরা চা বাগান স্থাপনের জন্য জনপদ থেকে দরিদ্র কৃষকদের ধরে এনে বাগানের শ্রমিক বানায়। অনেক সময় প্রতারণা করে, আবার কখনো জোর করে তাদেরকে বাধ্য করা হয় এই শ্রমজীবনে প্রবেশ করতে। চুক্তিভিত্তিক এই শ্রমিকদের উপর চলত অমানবিক নির্যাতন, ছিল না ন্যূনতম শ্রমিক অধিকার কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা।

চা চাষ ছিল এক প্রকার ‘প্লান্টেশন ক্যাপিটালিজম’-এর প্রতিচ্ছবি, যেখানে জমির মালিক ব্রিটিশ কোম্পানি, উৎপাদনের নিয়ন্ত্রক ব্রিটিশ ব্যবস্থাপক, আর শ্রমজীবী মানুষ ভারতীয় প্রান্তিক শ্রেণির সদস্য। একদিকে চায়ের বাজার তৈরি হচ্ছিল লন্ডনের অভিজাত চায়ের কাপে, অন্যদিকে চা উৎপাদনের শ্রমজীবীরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছিল আসামের গহিন অরণ্যে। এই বৈষম্যের মাঝে জন্ম নেয় একটি উপনিবেশিক পণ্যনির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো, যেখানে চা ছিল কেন্দ্রবিন্দু।

চা কেবল একটি কৃষিপণ্য নয়; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জন্য এটি ছিল কৌশলগত সম্পদ। ইংরেজরা খুব দ্রুত বুঝে ফেলে যে, চা কেবল চীন থেকে কিনে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছালে তাদের মুনাফা সীমিত থাকবে। বরং চায়ের চাষ, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের পুরো চেইন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। ফলে তারা চা নিয়ে গড়ে তোলে একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে সরকার, কোম্পানি, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনী পর্যন্ত জড়িত হয়ে পড়ে।

চায়ের জন্য আলাদা কর নীতিমালা তৈরি হয়। চায়ের উৎপাদনকে রাজস্ব থেকে ছাড় দেওয়া হয়, কারণ এটি ছিল রপ্তানিমুখী পণ্য। উৎপাদনকারীদের মধ্যে মালিকপক্ষ ছিল ইংরেজ বা ইংরেজপন্থী ব্যবসায়ী, যারা সরকারি প্রশাসনের আশীর্বাদে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করত। স্থানীয় কৃষক ও শ্রমিকদের কোনও স্বত্ব ছিল না, বরং তারা ছিল শ্রমশক্তির যোগানদাতা মাত্র। চা বাগান তৈরি হতো জমিদারি প্রথার বাইরের জমিতে, অনেক সময় স্থানীয় আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে। ফলে চা চাষ হয়ে ওঠে জমি দখল ও সামাজিক পুনর্বিন্যাসের অন্যতম উপায়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে চা কি শুধুই অর্থনৈতিক পণ্য ছিল, না কি তা সাংস্কৃতিকভাবে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি উপায় ছিল? উত্তরটি জটিল, কিন্তু স্পষ্টভাবে বলা যায়, চায়ের মাধ্যমে একটি সাংস্কৃতিক প্রভাবও বিস্তার লাভ করেছিল। ব্রিটিশদের চা খাওয়ার অভ্যাস ভারতীয় অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও এই অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়। চা হয়ে ওঠে সভ্যতা, শালীনতা ও উন্নত রুচির প্রতীক। এমনকি শিক্ষিত বাঙালি সমাজে চা পানের মাধ্যমে এক ধরনের ‘ইংরেজি অভিজাততা’ তৈরি হয়।

চায়ের সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক সচেতনতা। কোলকাতার কফিহাউস কিংবা ঢাকার বটতলা—এগুলো কেবল আড্ডার স্থান ছিল না, ছিল রাজনৈতিক বিতর্ক, সাংস্কৃতিক জাগরণ ও বিপ্লবের আঁতুড়ঘর। চায়ের কাপ ঘিরেই জন্ম নিয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অনেক প্রস্তাবনা। আবার চায়ের দোকান হয়ে ওঠে সর্বস্তরের মানুষের মিলনক্ষেত্র, যেখানে নিম্নবিত্তেরও মত প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়। এইভাবে চা, যা একদা উপনিবেশিক দাসত্বের প্রতীক ছিল, ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে গণসচেতনতার বাহক।

স্বাধীনতার পরেও চা শিল্প থেকে ব্রিটিশদের ছায়া পুরোপুরি সরে যায়নি। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে রূপান্তরিত হওয়ার পরও চা উৎপাদন ছিল মূলত কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণাধীন। স্বাধীনতার পরে কিছু কিছু জাতীয়করণ হলেও, কার্যত শ্রমিকদের জীবনমানে তেমন পরিবর্তন আসেনি। এখনও অনেক চা শ্রমিক প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাগানের নির্দিষ্ট ক্যাম্পেই বসবাস করছে, যেখানে মৌলিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও সীমিত। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি প্রায় একশ বছরেও।

তবে এও সত্য, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে চা শিল্প ধীরে ধীরে জাতীয় অর্থনীতির অংশ হয়ে ওঠে। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় চা আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ কিছু অঞ্চলে চা বাগানের বিস্তার জাতীয় রাজস্ব আয়ের একটি শক্তিশালী উৎস। এখানেই শুরু হয় চায়ের রাজনীতির দ্বিতীয় অধ্যায়, যেখানে উপনিবেশিক দাসত্বের ধারা থেকে বেরিয়ে চা হয়ে ওঠে সম্ভাবনার প্রতীক, জাতীয় সম্পদ।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর চা শিল্প নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়ার সুযোগ পেলেও, এর অগ্রগতির গতিপথ ছিল বিচিত্র। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে একেবারে উল্টে দিয়েছিল। ব্রিটিশদের হাত ধরে গড়ে ওঠা এবং পাকিস্তানি আমলে ধীরে ধীরে একচেটিয়া ব্যবসায় রূপ নেয়া চা শিল্প তখন রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির মধ্যে চা শিল্প ছিল এমন এক খাত, যা তুলনামূলকভাবে অক্ষুণ্ণ ছিল, কিন্তু যার ওপর রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল সীমিত। সেই সীমাবদ্ধতা থেকেই শুরু হয় জাতীয়করণের উদ্যোগ।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার চা শিল্পকে ‘মূলধনী সম্পদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে চা বাগানগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং বাংলাদেশ টি এস্টেট ম্যানেজমেন্ট ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় এই খাতকে পরিচালনার চেষ্টা শুরু হয়। এ উদ্যোগের পেছনে ছিল চায়ের উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি সব কিছুতেই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ নিশ্চিত করা। এতে একদিকে যেমন শিল্পটি পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা হয়েছিল, অন্যদিকে সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে শিল্পটি কাঙ্ক্ষিত গতিতে অগ্রসর হতে পারেনি।

এই সময়েই চা শিল্পে ‘উন্নয়ন বনাম কল্যাণ’ বিতর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে রাষ্ট্র চা উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিকে নজর দেয়, অন্যদিকে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার, জীবনমান, স্বাস্থ্য ও আবাসন উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অনেক চা বাগানই ছিল এমন, যেখানে শ্রমিকেরা নিজেদের ভূমির অধিকার ছাড়াই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাজ করে যাচ্ছিল। সরকারি নিয়ন্ত্রণ তাদের শ্রমিকত্বের বন্দিত্ব ভাঙতে পারেনি; বরং অনেক সময় রাষ্ট্র নিজেই হয়ে ওঠে নতুন মালিক, যে মালিক বদলে যায়, কিন্তু শোষণের চরিত্র বদলায় না।

চা শ্রমিকদের এই সামাজিক পরিসরের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে এক প্রকার সীমাবদ্ধ জীবনবোধ। বাগানের মধ্যে ‘লাইন’ নামে পরিচিত ঘিঞ্জি বসতিগুলোয় সীমিত পরিসরে বেড়ে ওঠে এক স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, যা মূলস্রোতের সমাজ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। শিশুদের জন্য ছিল না মানসম্মত স্কুল, চিকিৎসা ছিল দূরহ এবং পানীয় জলের সংকট ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী। অথচ এই শ্রমিকদের শ্রমে তৈরি চা রপ্তানি হয়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনছে, শহরের অভিজাত শ্রেণির নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠছে, এমনকি সরকার তাদের ‘সম্পদ’ হিসেবে গর্ব করে কিন্তু সেই সম্পদের প্রান্তিক রক্ষাকর্তার জীবনে থাকে না রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে খাতভিত্তিক উন্নয়ন চিন্তাধারা আস্তে আস্তে বেসরকারিকরণ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির ছায়ায় প্রবেশ করতে শুরু করে। এই পরিবর্তনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদনমুখী ও মুনাফাভিত্তিক করে তোলা। চা শিল্পও এর ব্যতিক্রম ছিল না। BTMC-এর অধীনে থাকা অনেক বাগান ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরিত হয়। এতে নতুন বিনিয়োগকারীরা আসে এবং কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিকদের জীবনমানের মৌলিক উন্নয়ন হয়নি। বরং বেসরকারি মালিকানার অধীনে অনেক সময় শ্রমিকের ওপর চাপ আরও বাড়ে, এবং শ্রম অধিকার দুর্বল হতে থাকে।

এমন সময়েই চা শিল্পে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে ছোট চা চাষের প্রবণতা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে কিছু উদ্যোক্তা এবং কৃষক পরিবার মিলে স্বল্প পরিসরে চা চাষ শুরু করে। এই ক্ষুদ্রচা চাষ একদিকে কৃষকের আয়ের নতুন উৎস তৈরি করে, অন্যদিকে চা উৎপাদনের কাঠামোয় ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে। এখন আর চা উৎপাদন শুধু বড় কোম্পানি বা জমিদার-মালিকানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সাধারণ কৃষকও চা উৎপাদনে যুক্ত হচ্ছে। এটি চা-কে একটি গণতান্ত্রিক কৃষিপণ্যে পরিণত করেছে, যা আঞ্চলিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে।

অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে চায়ের চাহিদা ও প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের চা শিল্প নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ভারত, চীন, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মান, ব্র্যান্ডিং ও উৎপাদন কৌশলে আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে পড়ে। এ লক্ষ্যে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। একদিকে মানসম্পন্ন চা উৎপাদনের প্রযুক্তি উন্নয়ন, অন্যদিকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চায়ের উপস্থিতি বাড়ানো এই কৌশলের অংশ হয়ে ওঠে।

এখানে আবার রাজনীতির ভূমিকাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চা শিল্প শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক লবিং ও স্বার্থ সংশ্লিষ্টতায় জড়িত একটি শক্তিশালী খাত। বড় চা কোম্পানি, রপ্তানিকারক, সরকার এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা মিলে একটি ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তোলে, যেখানে শ্রমিক ও ক্ষুদ্র চাষির স্বার্থ প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। চায়ের মূল্য নির্ধারণ, শ্রমিক মজুরি বোর্ড, রপ্তানি কর, মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সব জায়গাতেই এই ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফলে চায়ের রাজনীতি কেবল চা উৎপাদনের কেন্দ্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির এক প্রকার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।

তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে চা শিল্পে শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে কিছুটা সচেতনতা গড়ে ওঠে। শ্রমিক ইউনিয়ন, এনজিও এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপে সরকার চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্বিন্যাস করে, আবাসন উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করে এবং শিক্ষার প্রসারে কিছু উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাস্তবায়নে এখনও রয়েছে প্রচুর ঘাটতি। চা শ্রমিকদের অধিকাংশই এখনও প্রান্তিক; তারা স্বাস্থ্যসেবায় বঞ্চিত, সামাজিক স্বীকৃতি সীমিত এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব দুর্বল। বরং অনেক সময় তাদের নিয়ে ‘দয়া’ প্রদর্শনের নামে কেবলমাত্র লোকদেখানো উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

চা শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করতে গেলে অবশ্যই দুইটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে একটি হচ্ছে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান এবং অন্যটি হচ্ছে শ্রমিক ও কৃষকভিত্তিক স্থিতিশীল উৎপাদন ব্যবস্থা। ব্র্যান্ডিং, জৈব চা উৎপাদন, ট্যুরিজমের সঙ্গে চা বাগানকে যুক্ত করা এগুলো বাংলাদেশের চা শিল্পকে বিশ্বমঞ্চে নতুন করে পরিচিত করতে পারে। ইতিমধ্যে ‘সিলেট টি’, ‘পঞ্চগড় টি’ ইত্যাদি নামে অঞ্চলভিত্তিক চায়ের পরিচিতি গড়ে তোলার চেষ্টাও শুরু হয়েছে। এটিকে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন মার্কার হিসেবে নিবন্ধনের উদ্যোগ চলমান রয়েছে, যা ভবিষ্যতে চায়ের মূল্যবৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।

চা শিল্পে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অধিকাংশ চা শ্রমিকই নারী, যারা দিনের পর দিন কঠোর শ্রম দেন, কিন্তু পরিবারে কিংবা সমাজে তাদের মর্যাদা স্বীকৃত নয়। নারী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানো হলে এটি কেবল শ্রমিককল্যাণই নয়, উৎপাদনশীলতাও বাড়াবে। এই নারীকেন্দ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা একটি ন্যায্য ও মানবিক চা শিল্প গঠনের ভিত্তি হতে পারে।

সবশেষে, চা এখন আর কেবল একটি পানীয় নয় এটি একটি জীবনচর্চা, একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। চা-কে ঘিরে যে রাজনীতি গড়ে উঠেছে, তা কেবল রাষ্ট্র ও পুঁজি নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং তৃণমূলের মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করে। চায়ের ইতিহাস আমাদের শেখায় কিভাবে একটি উপনিবেশিক কাঠামো, শ্রমিকশ্রেণির রক্ত-ঘামে গড়া এক সময়ের শোষণ-প্রক্রিয়া, ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে পারে জাতীয় সম্পদযদি সেখানে সাম্য, মানবিকতা এবং ন্যায়ের জায়গা নিশ্চিত করা যায়।

চায়ের রাজনীতি আজ তাই শুধুমাত্র ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নয়; এটি একটি বর্তমান আন্দোলন, একটি উন্নয়নের প্রশ্ন এবং আগামী প্রজন্মের জন্য এক নতুন পথের সন্ধান।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী

সারাবাংলা/এএসজি

চা দিবস চায়ের রাজনীতি মুক্তমত সফিউল ইসলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর