এক কাপ চা দিয়ে অনেক সম্পর্কের শুরু হয়, আবার অনেক ক্লান্তির শেষও। দিনের শুরুতে, আড্ডার ফাঁকে, অফিসে কিংবা নীরব সন্ধ্যায় চা যেন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে আমরা অনেকেই জানি না, এই চায়ের পেছনে যে দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি থাকে, তার পেছনে রয়েছে কতশত জীবনের গল্প, শ্রমের ঘাম, আর অব্যক্ত বেদনা।
বাংলাদেশের চায়ের ইতিহাস দেড়শ বছরের পুরোনো। ইংরেজ সাহেব হার্ডসনের হাত ধরে ১৮৪৯ সালে ১৫০০ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়া। এরপর ব্রিটিশরা বিভিন্ন স্থান থেকে শ্রমিক এনে গড়ে তোলে শ্রমিক সম্প্রদায়, যারা আজও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাস করছেন সেসব বাগানে। বর্তমানে দেশে ১৭০টি চা বাগান রয়েছে। এ খাতে ৯৭ হাজার স্থায়ী ও ৪০-৫০ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক মিলে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তারা মূলত সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড় অঞ্চলের চা-বাগানগুলোতে কাজ করেন।
চা বাগানে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই শুরু হয় শ্রমিকদের জীবন। মাথায় ঝুড়ি, হাতে কাঁচি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে পাতা তোলা। একদিনে একজন শ্রমিকের সংগ্রহ করতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা, তা না হলে কমে যায় মজুরি। অথচ দৈনিক ৮ ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রতিজন শ্রমিক পান ১৭৯ টাকা। অনেক জায়গায় নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা, শিক্ষাব্যবস্থা বা স্যানিটেশন সুবিধা।
আমরা যখন ৫০-৬০ টাকা দিয়ে শহরের কোনো চা-ক্যাফেতে এক কাপ দুধ চা খাই, তখন খুব কম সময়ই মনে পড়ে এই পাতাগুলো তুলেছেন কোনো চা বাগানের এক মা, যার নিজের সন্তান স্কুলে যেতে পারে না টাকার অভাবে। হয়তো তার শিশুটি অসুস্থ, অথচ বাগানে নেই চিকিৎসকের ব্যবস্থা। এই অসম বাস্তবতা বুঝলেই বোঝা যায় চা শুধু স্বাদের নয়, একটি শ্রেণির বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নামও।
তবে শুধু কষ্ট আর অব্যবস্থাপনার গল্প নয়, চায়ের গল্পে আছে সম্ভাবনাও। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মতে, ২০২৪ সালে ৯ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। চায়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। শহরের নানা প্রান্তে গড়ে উঠছে ‘চা বাড়ি’, ‘চা ক্যাফে’, ‘টং শপ’ যেখানে শুধু অওচা নয়, গল্পও বিক্রি হয়। তরুণ উদ্যোক্তারা নানা স্বাদের চা তৈরি করে নতুন বাজার গড়ে তুলছেন।
তবে প্রশ্ন হলো, এই বাজারে কি শ্রমিকদের স্থান আছে? বড় বড় ব্র্যান্ড, রঙিন প্যাকেট, ঝকঝকে ক্যাফের চা-সংস্কৃতিতে সেই নারী শ্রমিকের মুখ কি কোথাও দেখা যায়? আমরা কি চাইছি শুধুই আধুনিকতা, নাকি তার সঙ্গে যুক্ত করছি ন্যায্যতাও?
চা শুধু একটি কৃষিপণ্য নয়। এটি একটি সংস্কৃতি, যা আড্ডায় আসে, সাহিত্যে উঠে, গানে গেয়ে ওঠে। জসীমউদ্দীন, রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ শামসুল হক কত কবির কবিতায় আছে চায়ের উল্লেখ। গ্রামবাংলার চায়ের দোকান মানে ছোট্ট এক গণতন্ত্রের মঞ্চ, যেখানে ধনী-গরিব, ছাত্র-চাকুরিজীবী সবাই মিলে বসে। সেই দোকানে জন্ম নেয় বহু মত, প্রশ্ন, স্বপ্ন।
এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘দুই পাতা এক কুঁড়ি’ কেবল একটি গাছের অংশ নয়, বরং আমাদের নিত্যদিনের অবিচ্ছেদ্য উঠেছে। তাই চা দিবস কেবল স্মারক নয়, এটি হোক দায়বদ্ধতার দিন। শ্রমিকদের জীবনের উন্নয়ন না হলে, চা শিল্পের এই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আমাদের উচিত চা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চা বোঝা। বোঝা উচিত, কারা এর পেছনে আছেন। সেই নারী শ্রমিক, সেই কিশোর, যে গ্রীষ্মের দুপুরে পাহাড়ে ঘাম ঝরায় আমাদের কাপে স্বাদ দিতে।
একদিন হয়তো আমাদের ভালোবাসা শুধু চায়ের স্বাদেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সেই স্বাদের পেছনের মানুষগুলোর জীবনেও আলো জ্বালাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর