Thursday 22 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খবরের পেছনে ছুটে চলা অবহেলিত প্রাণ

সুদীপ্ত শামীম
২১ মে ২০২৫ ১৩:৫০ | আপডেট: ২১ মে ২০২৫ ১৫:৩২

আকাশ যেন আজ ব্যথিত। মেঘের চাদর ছিঁড়ে নেমে আসছে এক অনিঃশেষ কান্না। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কেবল জল নয়, যেন সময়ের গোপন দীর্ঘশ্বাস। সেই বৃষ্টির ভেতরেই হাঁটছে কিছু মানুষ—পায়ের নিচে কাদা, শরীরে কাঁপুনি, চোখে ক্লান্তি। তবুও থেমে নেই তারা। কাঁধে একখানা পুরোনো ব্যাগ, হাতে বিবর্ণ কলম, পকেটে ভেজা মোবাইল, আর গায়ে ছেঁড়া রেইনকোট। এরা কোনো বাহিনীর সদস্য নয়, কোনো আলোচিত আন্দোলনের নেতা নয়—তারা মফস্বলের নিঃশব্দ যোদ্ধা। তারা ছুটে চলে মানুষের মুখের ভাষা হতে, সমাজের অসুখের হদিস দিতে, রাষ্ট্রের গাফিলতি তুলে ধরতে। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ।

বিজ্ঞাপন

চারপাশে যখন উন্নয়নের জাঁকজমক, রাজনৈতিক সভার গর্জন, কিংবা মিডিয়ার মোড়কে মোড়া খবর—তখনও তারা নীরবে কণ্ঠ তুলে বলে চলে প্রান্তিকের সত্য। না, এ গল্প কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়। এ দৃশ্য জীবনের—অজস্র মফস্বল সাংবাদিকের ক্লান্তিহীন পথচলার গল্প। যাদের নেই বিলাসবহুল অফিস, নেই ক্যামেরার ঝলক, নেই মোটা অঙ্কের সম্মানী। তবুও হৃদয়ে তাদের এক আগুন জ্বলে—সত্যের জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য, আর অন্যায়ের বিপক্ষে নিরন্তর লড়াইয়ের জন্য।

বিজ্ঞাপন

মফস্বল মানেই সীমাবদ্ধতা

মফস্বল সাংবাদিকতা মানেই যুদ্ধ। এক অসম যুদ্ধ। যেখানে সহকর্মী কম, সরঞ্জাম নেই, তবুও কাজের চাপ ঢাকার চেয়েও কম নয়। যেখানে একাই রিপোর্টার, ক্যামেরাপার্সন, এডিটর, নিউজ সেন্ডার—সব দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করতে হয়।

গ্রামীণ কোনো দুর্ঘটনা, নদীভাঙন, ত্রাণ বণ্টনের অনিয়ম কিংবা ধর্ষণের ঘটনা—সবখানে তার উপস্থিতি চাই। তা সে সকাল হোক কিংবা গভীর রাত। অনেক সময় নিজের টাকায় যাতায়াত, নিজের ফোনের ডেটায় নিউজ পাঠানো, এমনকি খাবার জোটানোও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।

প্রতিদিনের এই সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়েই একজন মফস্বল সাংবাদিক লড়ে যান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। অনেক সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পড়তে হয় স্থানীয় প্রভাবশালীদের রোষানলে। এমনকি সাংবাদিক পরিচয় দিলেও সম্মান দূরে থাক, কেউ কেউ সন্দেহের চোখে তাকায়। তার পেছনে নেই কোনো বড় গণমাধ্যমের চৌকস ব্যাকআপ, নেই আইনজীবী কিংবা বীমার আশ্বাস। তবুও এই সীমাবদ্ধতার ভেতরেও অনেকেই এক দশক, দুই দশক ধরে কাজ করে চলেছেন। কারণ তারা সাংবাদিকতাকে শুধু পেশা নয়, দায়িত্ব ও অভ্যন্তরীণ তাগিদ হিসেবে দেখেন।

সম্মান কম, দায়িত্ব বেশি

জাতীয় বা বড় শহরের সাংবাদিকদের প্রাপ্তি যতটা প্রচারে, মফস্বলের সাংবাদিকের ততটাই অবহেলায়। কেউ তাদের চেনে না। তাদের ‘বাইলাইন’ থাকে না প্রথম পাতায়, কেউ তাদের পদ-পদবি জিজ্ঞাসা করে না। অথচ তারাই অনেক সময় গণমাধ্যমের ‘ফিল্ড সেন্সর’ হয়ে কাজ করেন।
দুর্যোগের সময় তারাই প্রথম পৌঁছে যান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়, তারাই চোখে দেখেন প্রকৃত অবস্থা, সংগ্রহ করেন ভিডিও-ছবি-ভয়েস। অথচ সেই রিপোর্ট যখন প্রচারিত হয়, তখন তার নাম থাকে না, থাকে না কৃতিত্বের কোনো স্বীকৃতি।

একটি জাতির ইতিহাস রচনা হয় তার খবর দিয়ে, ঘটনাবলীর বর্ণনায়। সেই ইতিহাস লেখার দায়িত্ব যাদের হাতে, তাদের যদি বারবার অস্বীকৃতি, অবহেলা আর অবজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়—তাহলে ইতিহাসই বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মফস্বল সাংবাদিকদের কাজের পরিধি অনেক বড় হলেও তাদের সামাজিক মর্যাদা আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসন কিংবা রাজনৈতিক নেতারাও তাদের ‘মূলধারার বাইরে’ মনে করে। অথচ এই সাংবাদিকরাই দিনের পর দিন প্রশাসনিক অনিয়ম, ভূমিদস্যুতা, নারী নির্যাতন বা দুর্নীতির খবর তুলে ধরে সমাজকে সচেতন করে তুলছেন।

ঝুঁকি পেরিয়ে সত্যের সন্ধানে

মফস্বল সাংবাদিকদের জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ঝুঁকি। তারা শুধু তথ্য সংগ্রহ করেন না, বরং প্রায়শই সত্য প্রকাশের কারণে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন। যখনই তারা স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে কাজ করেন, তখনই তারা হয়ে ওঠেন কারও না কারও চোখের কাঁটা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে তথ্য প্রকাশ করলেই শুরু হয় ভয়ঙ্কর রকম চাপ। কখনও পুলিশি হয়রানি, কখনও থানায় মিথ্যা জিডি, আবার কখনও সরাসরি প্রাণনাশের হুমকি আসে।

অনেক সময় রাতের আঁধারে হামলা হয় বাড়িতে, ছেলেমেয়েরা ভয়ে স্কুলে যেতে চায় না। সাংবাদিকরা মাঠে থাকলেও, তাদের পরিবারের ওপর চলে ভয়াবহ মানসিক নির্যাতন। অথচ এসব ঘটনায় অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

তারপরও মফস্বল সাংবাদিক থেমে যান না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন—‘একজন সাংবাদিক যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ান, তবে সমাজ একদিন অন্যায়ের কাছে নতজানু হবে।’ এই দায়বোধই তাদের সাহস জোগায়, কলম চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের সাহসিকতায় কখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকেও উঠে আসে কোনো সত্য, কখনো অন্ধকার গলির ভিতর থেকেও বের হয় আলোর ঝলক।

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা

মফস্বল সাংবাদিকদের জীবনের আরেকটি নির্মম বাস্তবতা হলো—অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। তারা দিনরাত মাঠে থাকেন, খবরের পেছনে ছোটেন; কিন্তু মাস শেষে তাদের পারিশ্রমিক বলতে গেলে কিছুই থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নির্দিষ্ট কোনো বেতন পান না—অনেকে তো কাগজে লিখেন বিনা সম্মানীতেই। কেউ কেউ কোনো প্রকার ‘সংবাদ পাঠালেই ২০০ টাকা’ টাইপ ভাতা পেয়ে থাকেন, সেটিও নিয়মিত নয়। অবস্থার এমন দুরবস্থা যে, কেউ কেউ স্থানীয় কোচিংয়ে পড়ান, কেউ বাজারে দোকান চালান, কেউবা আবার চাকরির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করেন।

বিষয়টি শুধু দুঃখজনক নয়, ভয়ংকর। কারণ একজন সাংবাদিক যদি নিজের মৌলিক চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খায়, তাহলে তিনি কিভাবে নৈতিকতা বজায় রেখে কাজ করবেন? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রাষ্ট্র কিংবা বড় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান কেউই এদের আর্থিক নিরাপত্তার কোনো কাঠামো গড়ে তোলেনি। কেউ দুর্ঘটনায় মারা গেলে পরিবারের জন্য থাকে না কোনো সহযোগিতা, না থাকে সরকারি বীমা, না কোনো ট্রাস্ট ফান্ড। তাই প্রয়োজন একটি কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক আর্থিক কাঠামো, যা এদের জীবনের নিরাপত্তা ও পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে।

প্রশিক্ষণের অভাব ও প্রযুক্তির সংকট

মফস্বল সাংবাদিকদের মধ্যে সিংহভাগই পেশাগত সাংবাদিকতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ পান না। তারা নিজ চেষ্টায়, অভিজ্ঞতা ও তাড়নার মাধ্যমে সাংবাদিকতার নানা দিক শিখে নেন। কোথায়, কীভাবে, কাকে প্রশ্ন করতে হয়—এই শৈল্পিক দক্ষতাগুলো তারা গড়ে তোলেন মাঠের অভিজ্ঞতা থেকে।

তবে প্রযুক্তির দিক দিয়ে তারা বড় রকম পিছিয়ে। এখনো অনেকেই পুরোনো মডেলের মোবাইলে ছবি তোলেন, ভিডিও করেন। কেউ কেউ ভাঙা বা ধীরগতির ল্যাপটপে নিউজ টাইপ করেন। অনেকের তো ইন্টারনেট সংযোগও থাকে না; ফলে সংবাদ পাঠাতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেরিতে, কখনো রাত ২-৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় সিগনালের জন্য। এই সীমাবদ্ধতা আরও প্রকট হয় যখন কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সময়মতো সংবাদ চাওয়া হয়। অনেকসময় ঢাকার বড় অফিস বুঝতেই চায় না গ্রাম পর্যায়ে কী ধরনের বাস্তবতা একজন সাংবাদিককে মোকাবিলা করতে হয়।

তাই সময় এসেছে—মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, মোবাইল রিপোর্টিং টুলস, ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করার। এতে কেবল সংবাদ গুণগত মানে উন্নত হবে না, বরং পেশাটিও আরও প্রতিষ্ঠিত হবে।

তাদের হাতে সমাজ বদলের চাবিকাঠি

সব সীমাবদ্ধতা, ঝুঁকি আর অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও মফস্বল সাংবাদিকরাই আজ সমাজ বদলের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। কারণ তারা মাঠের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকেন, সাধারণ মানুষের পাশে হাঁটেন, কান পেতে শোনেন চরাঞ্চলের হাহাকার, কৃষকের আকুতি কিংবা উপেক্ষিত স্কুলছাত্রের কষ্টের কথা। তাদের রিপোর্টের জোরেই বহুবার জনপ্রতিনিধিরা বিব্রত হয়েছেন, প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে, এমনকি রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ পর্যন্ত পরিবর্তন হয়েছে। চরাঞ্চলে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরলে সেখানে শিক্ষক নিয়োগ হয়, একটি ব্রিজের বেহাল দশা তুলে ধরলে স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পড়ে সেই জায়গা।

এদের কাজ শুধুই ‘সংবাদ সংগ্রহ’ নয়—তারা বাস্তবতার মুখ তুলে ধরে জনমত গড়ে তোলেন। তারা স্থানীয় সমাজের আয়না, যারা না থাকলে গ্রামীণ মানুষের কণ্ঠ হয়ে উঠত নিঃশব্দ।

এই গুরুত্ব অনুধাবন করেই রাষ্ট্র ও সমাজকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে—অন্তত তাদের কাজটুকু যেন সহজ হয়, সম্মানের সঙ্গে হয়।

রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব

প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় ‘চতুর্থ স্তম্ভ’। কিন্তু সেই স্তম্ভের মজবুত ভিত যাঁরা গড়ে দেন—মফস্বলের সাংবাদিকরা—তাঁদের অবস্থান আজও সবচেয়ে অনিশ্চিত। রাজধানীভিত্তিক গণমাধ্যমগুলোর চোখে থাকলেও, তাদের হৃদয়ে মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দ খুবই সামান্য। এখন সময় এসেছে একটি কার্যকর ও মানবিক নীতিমালার, যার মাধ্যমে মফস্বল সাংবাদিকদের রেজিস্ট্রেশন, ঝুঁকি বিমা, প্রশিক্ষণ ও সম্মানী নিশ্চিত করা যায়। সংবাদপত্রে ‘বাইলাইন’ নয়—তাঁদের মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং স্বীকৃতিই হোক আসল প্রাপ্তি।

গণমাধ্যম মালিকদেরও দায়িত্ব আছে—নিজেদের মুনাফার একটি অংশ নিয়ে ‘জার্নালিস্ট সাপোর্ট ফান্ড’ গড়ে তোলা, যাতে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা কিংবা সংকটে এই নিঃস্বার্থ কর্মীরা অন্তত কিছুটা নিশ্চয়তা পান। মফস্বল সাংবাদিকেরা শুধু তথ্যই দেন না—তাঁরা গড়ে তোলেন স্থানীয় সমাজ, জাগিয়ে তোলেন গণতন্ত্রের চেতনাকে। তাই তাঁদের পাশে দাঁড়ানো মানে—গণতন্ত্রের ভিত আরও দৃঢ় করা।

ইতিহাস লেখে যারা

মফস্বলের সাংবাদিকতা নিঃশব্দ বিপ্লবের আরেক নাম। তারা প্রচারের আলোয় না থেকেও সমাজ বদলের ভিতরকেই আলোকিত করে তোলেন। তাদের চোখে থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহস, কলমে থাকে প্রতিবাদের ভাষা, আর পায়ে থাকে থামতে না চাওয়া সংকল্প। সীমাহীন সীমাবদ্ধতা, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যেও তারা মাটি ও মানুষের কথা তুলে ধরেন অবিরত। তারা শুধু খবর লেখেন না—তারা ইতিহাস লেখেন। সেই ইতিহাস, যা কোনো শিরোনামে নয়, থাকে জনতার হৃদয়ে।

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

খবর মুক্তমত সাংবাদিকতা সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর