Wednesday 21 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারত: আমাদের বন্ধু না শত্রু?

মনোয়ার পারভেজ
২১ মে ২০২৫ ১৫:৫৯ | আপডেট: ২১ মে ২০২৫ ১৬:০১

সমালোচনার জায়গায় অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে। ভারতের সমালোচনা প্রসঙ্গে যদি বলি, তাহলে ঐতিহাসিক ভাবেই আমাদেরকে ভারতের সমালোচনা করতে হয়েছে, হচ্ছে। সমালোচনার পাশাপাশি কিছুটা বিরোধীতাও করতে হয়। ভারতের বিরোধীতা করতে হয় কারণ তারা নানা সময়ে আমাদের উপর তাদের উপনিবেশ চালানোর চেষ্টা করেছে। একাত্তরে পাকিস্তানের শাষন থেকে মুক্ত হয়েছি কি তাদের উপনিবেশ হওয়ার জন্য? অবশ্যই না। এটা ঠিক মুক্তিযুদ্ধে তারা আমাদেরকে সাহায্য করেছে। আমাদেরকে তাদের দেশে আশ্রয় দেয়, এবং শেষদিকে এসে তারাও আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে যুক্ত হয়। তার জন্য অবশ্য ধন্যবাদ তারা পাবে, কৃতজ্ঞতাও জানাই। কিন্তু এই অযুহাতে তারা আমাদের উপর উপনিবেশ চালাতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র নিয়ে যদি তারা কোনো ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করে তখন সেটার সমালোচনা ও বিরোধীতা অবশ্যই করতে হবে। তবে তার মানে কি এই সমালোচনা ও বিরোধীতা অন্ধের মতো করতে হবে? বা ভারতের সাধারণ জনগণও কি আমাদের শত্রু?

বিজ্ঞাপন

খেয়াল করলে দেখবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভারতের সমালোচনা শুধু নয় সরাসরি ভারতের বিরোধীতা করে এদেশের আলেম-ওলামারা। মাঝে মধ্যে তারা ভারত বয়কটের ডাকও দেয়। এই বয়কট বলতে তারা ভারতের সবকিছুই বয়কট করে। এই বয়কটে উনারা ভারতের পন্য থেকে শুরু করে সবকিছুই বয়কটের কথা বলেন। কিন্তু দেখা যায় ওয়াজ-মাহফিলের সময়ে ভারত থেকে আগত বক্তা এনে তারা ওয়াজ মাহফিল করান। উনারা কি ভারত বয়কটের সাথে সাথে তাদের কওমী মাদ্রাসার কেন্দ্র বলে খ্যাত ভারতের দেওবন্দে অবস্থিত দেওবন্দ মাদ্রাসাকেও বয়কট করেন? অবশ্যই না। সুতরাং তাদের যেটা প্রয়োজন সেটা কিন্তু বয়কট করেন না। উনারা ভারতের সমালোচনা করলেও দেওবন্দের অথবা সেখানে থাকা মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোর সমালোচনা করেন না, বিরোধীতা করেন না। স্বার্থ অনুযায়ী কিছু কিছু মেনে নেন।

বিজ্ঞাপন

এদেশের মুসলমানদের কাছে সৌদি আরব আলাদা একটা আবেগের জায়গা। কারণ, সেখানে তাদের পূণ্যভূমি মক্কা-মদিনা অবস্থিত। নবী মোহাম্মদ (স.) এর জন্মভূমি। তবে ক্ষেত্রবিশেষ কেউ কেউ সমালোচনা করেন সৌদির বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার। রাষ্ট্রের সমালোচনা করা মানে কিন্তু তীর্থস্থানের সমালোচনা বা যে ধর্মকে ঘিরে তীর্থস্থান গড়ে উঠা সেই ধর্মের সমালোচনা নয়। কেননা রাষ্ট্র ও ধর্ম আলাদা বিষয়। এদেশের হিন্দুরা ভারতকেও তাদের পূর্ণভূমি মনে করে। সেখানে তাদের অনেকগুলো তীর্থস্থান রয়েছে। তাই তাদের কাছে ভারত প্রশ্নে তাদের আবেগ কাজ করে। কিন্তু এটাও সত্য যে এদেশের অধিকাংশ হিন্দুরা ভারতের সমালোচনার জায়গায় যথাযথ সমালোচনাও করতে পারেন না। এর জন্য দায়ী আওয়ামীলীগ ও কতিপয় হিন্দু নেতারা। আওয়ামীলীগ তার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতের সমর্থন আশা করে। সেজন্য এদেশের হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়। কিন্তু এটা তাদের পুঁজি। ক্ষমতায় টিকে থাকার পুঁজি। এমনকি হিন্দুরা আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় না থাকলে একটা আতঙ্কের অনুভূতি প্রকাশ করে। কিন্তু আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে যে তাদের উপর নির্যাতন হয় না তা কিন্তু নয়। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় না থাকলে তাদের উপর নির্যাতন হয় এটা যেমন সত্য, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলেও তাদের উপর নির্যাতন হয় এটাও চরম সত্য। এমনকি আওয়ামীলীগের অনেক নেতার হাতে এদেশে হিন্দুদের জমি দখলের অনেক উদাহরণও আছে। তারপরও অধিকাংশ হিন্দুদের কাছে আওয়ামীলীগ ভরসার জায়গা। সেটা হচ্ছে হিন্দুরা আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক পুঁজি বুঝতে পারে না বিদায় এটা হয়েছে। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আওয়ামীলীগের সঙ্গে ভারতের একটা সম্পর্কের জায়গা। কিন্তু সেটাও যে রাজনৈতিক প্রসঙ্গক্রমে এটাও বুঝতে পারে না সবাই। তাই তারা ভারতের রাষ্ট্রীয় আগ্রাসী ভূমিকাতেও সমালোচনা করতে পারে না। এখানেও ভারত রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনে ধর্মের অনুভূতিকে সামনে উপস্থাপন করে। তারা দেখায় এদেশের হিন্দুদের রক্ষাকর্তা যেন তারাই। এইগুলা তাদের রাজনৈতিক ভাওতাবাজি। সৌদি আরব যেমন এদেশের মুসলমানদের কাছে পূর্ণভূমি হলেও ইসলামের কোনো দলিলী রাষ্ট্র নয়, তেমনি এদেশের হিন্দুদের জন্যেও ভারত তীর্থস্থান হলেও সেটা কোনো দলিল নয়। কমিউনিস্টরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি না করলেও, এদেশে কমিউনিস্টরা যেমন সংখ্যাগুরু মুসলমানদের কাছে পৌছাতে পারেনি, তেমনি সংখ্যালগু হিন্দুদের কাছেও তেমন সরব ভাবে পৌছাতে পারেনি। এখানে কমিউনিস্টদের কিছুটা সাংগঠনিক ব্যার্থতা আছে। আর ধর্মীয় যে গোঁড়ামি প্রসঙ্গ, এটা এই দক্ষিণ উপমহাদেশ জুড়েই। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার বলা যায় ‘ধর্ম’। বাংলাদেশ তার বাহিরে নয়। বামপন্থী বা কমিউনিস্টরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। তাই তাদের রাজনীতিতে অবশ্য ধর্ম থাকে না। যার কারণে তারা এখানে সফল হয়ে উঠতে পারেনি। আবার ধর্মীয় দলগুলোও এতোটা সফল হয়ে উঠতে পারছে না। তার কারণ, এদেশের মানুষ যতোটা ধর্মভীরু ততটাই আবার ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু তারা জানে না কিভাবে তারা ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠেছে। তারা তাদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অবস্থান এবং কাজে, কর্মে ঠিকই ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ করে। কিন্তু কাজে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও নামে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটাকে তারা বুঝে উঠতে পারে না। কেননা তাদেরকে ধর্মনিরপেক্ষতার যে সজ্ঞা ধর্মীয় দলগুলো বুঝায় এখানেই মূলত বিভ্রান্তি ঘটে। তবে তারা সজ্ঞা না বুঝলেও চালচলনে ধর্মনিরপেক্ষই থেকে যান। ধর্মনিরপেক্ষ হতে গেলে যে ধর্মান্তরিত বা ধর্মহীন হতে হবে তা কিন্তু নয়। যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতার বিভ্রান্ত সজ্ঞা তাদের মগজে ঢেলে দেওয়া হয়, তাই আচরণের দিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষ হয়েও রাজনৈতিক ভাবে বা ঘোষিত ভাবে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে যেতে পারে না। আবার তারা ধর্মীয় দলগুলোর দিকেও একেবারে ঝুঁকে পড়ে না। সেটাও তাদের আচরণের সংস্কৃতির কারণেই। তবে এইখানে সফল হয়েছে ডানপন্থী দলগুলো। তারাও জেনে গেছে ‘ধর্ম’ নিয়ে কতটুকু পুঁজি তাদের করতে হবে বা না করতে হবে। জনগণ যখন বামপন্থী ও ধর্মীয় দলগুলোর দিকে যেতে পারে না তখন ডানপন্থী দলগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এবং তাই ডানপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও জনপ্রিয় ধারার কথা বলেন তাদের পুঁজি টিকিয়ে রাখার জন্য।

তবে এদেশে একটা কথা চালু আছে হিন্দু মানেই ভারতের দালাল অর্থাৎ ভারতপন্থী, হিন্দু মানেই আওয়ামীলীগ। না, একথা সত্য নয়। কমিউনিস্ট পার্টির বা বামপন্থী দলগুলোর অনেক হিন্দু নেতা আছেন যারা ভারতের সমালোচনা ও বিরোধীতা করেন। এমনকি অনেক সময় সচেতন হিন্দুরা সমালোচনা করে থাকেন। আবার সব হিন্দু আওয়ামীলীগও নয়। বামপন্থী ছাড়াও বিএনপিতে বা অন্যান্য দলে অনেক হিন্দু নেতা, কর্মী আছে বলে দেখা যায়। আর ভারতও যে বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ বলে দখলদারিত্ব করতে চায় তা না। নেপালের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো না। মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় সে একটা সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে চায়। ভারত বাংলাদেশের হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হওয়ার যে অভিপ্রায় দেখায় এর পুরোটাই মিথ্যা। হিন্দুদের পুঁজি করে মূলত সে তাদের সহানুভূতি অর্জনের লক্ষ্যে তার উপনিবেশীয় ঘাটি বানাতে চায়। এটা হিন্দুদের কেউ কেউ বুঝেন। তাই তার বিরোধীতাও করেন। ঐতিহাসিক ভাবে ভারতের সমালোচনা, বিরোধীতা করতে গেলেও অন্ধ ভাবে করা যাবে কি? মাওলানা-আলেমদের যে উদাহরণ বলেছিলেন তারা ভারতের বিরোধীতা করলেও তাদের স্বার্থের জায়গায় ঠিকই স্বার্থ টিকিয়ে রাখেন। তেমনি ভৌগোলিক স্বার্থে বা বাণিজ্যিক স্বার্থে হোক তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়।

প্রথম দিকে যে প্রশ্ন রেখে এগিয়েছিমাল ভারতের সাধারণ জনগণও কি আমাদের শত্রু? তার একটা ফয়সালা দেখা যাক। এই উদাহরণ শুধু ভারত নয় যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই হবে। যেকোনো রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নীতিনির্দারক বা ক্ষমতাবানরা শত্রু হলেও সেই দেশের সাধারণ জনগণ কিন্তু শত্রু নয়। দেশ ও রাষ্ট্র এক বিষয় না। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যেমন বন্ধুত্ব থাকবে, আবার শত্রুতাও থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই শত্রু রাষ্ট্রে বসবাসকারী দেশের জনগণ অবশ্যই আমাদের শত্রু না। যেমন, ভারত রাষ্ট্রের নীতি ও তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বা নানান বিষয়ে রাষ্ট্র আমাদের শত্রু হতে পারে, তবে ভারতের জনগণ আমাদের শত্রু না। তেমনি পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই। বাংলাদেশে চব্বিশের ছাত্র আন্দোলনে কলকাতার শিক্ষার্থী আমাদের ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে তারাও মাঠে নেমে আসে। তারপর পাকিস্তান, একে একে এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ। এই যে সাধারণ জনগণ নেমে এসেছিল সেটাও এদেশের সাধারণ জনগণের প্রতি সংহতি জানাতে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

বন্ধু না শত্রু ভারত মনোয়ার পারভেজ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর