বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক নতুন ধাপ অতিক্রম করছে। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলের মতো অবকাঠামো উন্নয়ন আমাদের গর্বিত করে। কিন্তু এই অগ্রযাত্রার আড়ালে যে অন্ধকার ছায়া নেমে আসছে, তা হলো পরিবেশ দূষণ। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইকিউএয়ার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালেও ঢাকা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দূষিত নগরী হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিল। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ শুধুমাত্র পরিবেশ দূষণজনিত কারণে প্রাণ হারায়। এই ভয়াবহ চিত্র আমাদের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। এমনকি দূষণের প্রভাবে শিশুদের স্বাস্থ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ ও হৃদরোগ। শহর থেকে গ্রাম—কোথাওই এখন আর নিরাপদ নয়। কিন্তু আমরা কি থেমে যাব, না লড়ব? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তরুণদের, কারণ পরিবর্তনের প্রধান শক্তি তারাই।
কেন দূষণ ভয়াবহ হয়ে উঠছে?
বাংলাদেশে বায়ু দূষণের প্রধান উৎস হলো যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটা, কারখানার বর্জ্য ও নির্মাণকাজ। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, শুধু ঢাকাতেই বায়ু দূষণজনিত কারণে শিক্ষার্থী ও শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে নদ-নদী ও খালগুলোতে বর্জ্য ফেলার কারণে পানিদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী কার্যত মৃতপ্রায়। শব্দ দূষণের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমা (৫৫ ডেসিবেল) অপেক্ষা বহু গুণ বেশি শব্দ প্রতিনিয়ত সহ্য করছে নগরবাসী, যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। এছাড়া আলো দূষণ, জমি দূষণ ও খাদ্যদূষণের মতো নতুন নতুন দূষণও হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে কৃষিজমি দিন দিন অনুজীবহীন হয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে খাদ্যের গুণগতমান কমে যাচ্ছে এবং মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শহরের ডাস্টবিন ও খোলা জায়গায় ময়লা ফেলার সংস্কৃতি, ড্রেনের ওপর দখল ও নালা-নর্দমা বন্ধ হয়ে যাওয়াও দূষণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, এই দূষণ একটি শ্রেণি-নিরপেক্ষ সমস্যা নয়। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। তারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে, যেখানে দূষণের মাত্রা বেশি।
তরুণরাই পারবে পরিবর্তন আনতে
আজকের তরুণরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু নেতৃত্ব শুধু রাজনীতিতে নয়, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন। পরিবেশ আন্দোলনে তরুণদের যুক্ত হওয়া এখন সময়ের দাবি। তারা চাইলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশ-সচেতনতামূলক ক্লাব গঠন করতে পারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পেইন চালাতে পারে, স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মডেল তৈরি করতে পারে। তারা চাইলে পরিবেশ বিষয়ক সেমিনার, পোস্টার প্রদর্শনী, ওয়ার্কশপ কিংবা রোড শো আয়োজন করে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পারে। স্কুল-কলেজের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরিবেশ বিষয়ে আগ্রহী নতুন প্রজন্ম তৈরি করা সম্ভব। এমনকি ছোট আকারে হলেও নানাবিধ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তারা হতে পারে পরিবর্তনের অগ্রদূত।
একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো নারায়ণগঞ্জের একদল তরুণের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘সবুজ অভিযাত্রা’ নামের সংগঠন। তারা নিয়মিত বৃক্ষরোপণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরকম আরও হাজারো উদ্যোগ দেশজুড়ে গড়ে উঠলে দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। তরুণদের উচিত নিয়মিত স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে পরিবেশ রক্ষার দাবিতে সক্রিয় থাকা। তারা চাইলে নিজ নিজ এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহ, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে পারে। শিক্ষিত ও সচেতন যুবসমাজই হতে পারে এই যুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর সৈনিক।
তরুণদের কী করা উচিত?
সচেতন হওয়া ও সচেতন করা: পরিবেশ-সংক্রান্ত তথ্য জানা ও তা অন্যদের জানানোর দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীদেরও পরিবেশ বিষয়ক আলোচনায় যুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মাঝেও পরিবেশ-সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে, যেন ছোটবেলা থেকেই তারা দায়িত্বশীল হতে শেখে।
পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন: একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিহার, সাইকেল চালনা, গণপরিবহন ব্যবহার প্রভৃতি অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নিজের আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা ও গাছ লাগানোর অভ্যাস গড়তে হবে। বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলাদা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে ভূমিকা: প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ যেমন—বর্জ্য থেকে জ্বালানি, জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি—এসব নিয়ে ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়েও মৌলিক গবেষণায় অংশ নিতে হবে।
জনমত গঠনে নেতৃত্ব: বিভিন্ন কর্মসূচি ও আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের নীতিমালাকে প্রভাবিত করা সম্ভব তরুণদের দ্বারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাস্তব মাঠেও তরুণদের সক্রিয়তা জরুরি। তৃণমূল পর্যায়ে দূষণবিরোধী প্রচারাভিযান চালিয়ে সমাজকে জাগ্রত করতে হবে।
স্থানীয় সমস্যার সমাধানে অংশগ্রহণ: নিজের এলাকায় যেসব নির্দিষ্ট দূষণ সমস্যা রয়েছে—যেমন: ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য ফেলা, নদী-নালার দখল—সেসব চিহ্নিত করে স্থানীয় প্রশাসন ও নাগরিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় ‘নিজ গ্রাম, নিজ শহর’ ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশ শিক্ষায় অন্যদের সহায়তা: যেসব তরুণ প্রান্তিক এলাকার স্কুল বা মাদ্রাসায় পড়ান বা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন, তারা সেখানে পরিবেশ শিক্ষা বিষয়েও কাজ করতে পারেন। শিশুদের মধ্যে পরিবেশ নিয়ে কুইজ, চিত্রাঙ্কন বা গল্প বলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সচেতনতা বাড়ানো যায়। পাশাপাশি স্থানীয় শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে নিয়মিত পরিবেশ বিষয়ক পাঠদান চালু করাও সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ভূমিকা জরুরি
শুধু ব্যক্তি উদ্যোগ নয়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা ও কর্মসূচি বাধ্যতামূলক করা উচিত। পাঠ্যপুস্তকে বাস্তবভিত্তিক পরিবেশ বিষয়ক অধ্যায় সংযোজন করে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরি করা যেতে পারে। ক্যাম্পাসজুড়ে পরিবেশবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ যেমন—প্লাস্টিকমুক্ত ক্যাম্পাস, গ্রিন ক্লাব, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষকদেরও ভূমিকা রয়েছে, তারা শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজ ও প্রকৃতির প্রতিও দায়িত্ববান করে তুলতে পারেন।
প্রতিটি শিক্ষার্থীর উচিত অন্তত বছরে একটি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এবং নিজ এলাকায় একটি দূষণবিরোধী কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেওয়া। তাছাড়া স্থানীয় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে বাস্তব অভিজ্ঞতাও অর্জিত হবে এবং সামাজিক প্রভাবও তৈরি হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেই মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ‘পরিবেশ সপ্তাহ’ বা ‘সবুজ দিবস’ পালন করতে পারে, যেখানে সেমিনার, চিত্রাঙ্কন, প্রবন্ধ লেখা ও বিতর্কের মাধ্যমে সচেতনতা ছড়ানো সম্ভব। গ্রামে বা শহরে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালালে তা আশপাশের মানুষকেও উৎসাহিত করবে।
তোমার হাতেই ভবিষ্যৎ
পরিবেশ রক্ষা কেবল একটি দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। দূষণের এই দানবকে পরাজিত করতে হলে তরুণদের অগ্রভাগে দাঁড়াতে হবে। তাদের হাতেই আছে আগামীর চাবিকাঠি। একেকটি পদক্ষেপ, একেকটি উদ্যোগই হতে পারে একটি পরিবর্তনের শুরু।
তরুণদের প্রতি আহ্বান—তোমরা জেগে ওঠো। কারণ, দূষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন শুধু নীতিনির্ধারকদের নয়, এটি তোমাদেরও। এখনই সময়, ভবিষ্যৎকে রক্ষা করার। নিজে থেকে শুরু করো, অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করো। ছোট ছোট ভালো অভ্যাস দিয়েই গড়ে তোলা যায় একটি বিশাল পরিবেশ-আন্দোলনের ভিত্তি। প্রতিদিন একটি গাছ লাগানো, প্লাস্টিক ব্যবহার না করা, নিজের বাসা কিংবা পাড়া পরিষ্কার রাখা—এই সহজ কাজগুলোই পরিণত হতে পারে পরিবেশ বিপ্লবের হাতিয়ারে। মনে রেখো, আজকের তোমার সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্ম কীভাবে বাঁচবে। তাই সময় নষ্ট করো না—তোমার হাতে আছে বাংলাদেশের সবুজ ভবিষ্যৎ।
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক