আন্তর্জাতিক মানব পাচার বর্তমানে এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, যা প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো এই অমানবিক অপরাধের এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, যা তখনই আমাদের নজরে আসে যখন কোনো ভুক্তভোগী চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিকার চান। এই ঘৃণ্য অপরাধের ব্যাপকতা, এর পেছনের কারণ এবং এর মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।
মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র
সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি ট্রলার থেকে দুই শতাধিক মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে উদ্ধার করেছে, যাদের মধ্যে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি নাগরিক উভয়ই ছিলেন। দালালরা তাদের থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল, কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল এই অসহায় মানুষগুলোকে মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে দেওয়া। এই ভুক্তভোগীরা মূলত ফেসবুক এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় দালালদের মাধ্যমে পাচার হচ্ছিলেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক সংকট ও অসহায়ত্বকে পুঁজি করে পাচারকারীরা বিদেশে ভালো কাজ, অর্থ উপার্জন, এমনকি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে বা ভালো বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ-তরুণীদের দলে ভেড়ায়। এরপর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তাদের নির্ধারিত দেশে পাচার করে দেশে থাকা পরিবার থেকেও কৌশলে অর্থ আদায় করা হয়। টেকনাফ পুলিশ জানিয়েছে, সম্প্রতি এই চক্রের স্থানীয় দালাল ও রোহিঙ্গা সদস্যরা বিভিন্ন এলাকা ও ক্যাম্প থেকে ভুক্তভোগীদের সংগ্রহ করেছিল, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে। গত আট বছরে (২০১৬-২০২৪) কক্সবাজারে সাগরপথে মানব পাচারের সময় দেড় হাজারের বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা।
এই সিন্ডিকেট শুধু মালয়েশিয়া নয়, লিবিয়াসহ অন্যান্য দেশেও মানুষ পাচার করে। লিবিয়ায় সাধারণত ঢাকা-নেপাল-মিসর-লিবিয়া এবং ঢাকা-দুবাই-মিসর-লিবিয়া – এই দুটি পথে মানুষ পাচার করা হয়। কয়েক বছর আগেও চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার বন-জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে বহু বাংলাদেশিকে নির্যাতন করে করুণ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
করোনা মহামারির প্রভাব ও মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত
আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটের সক্রিয়তা মূলত করোনা মহামারির সময় থেকেই বেড়েছে, যখন লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ চাকরি হারিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছিল। তখন তারা যেকোনো উপায়ে পুরোনো কর্মস্থল বা নতুন কোনো স্থানে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, বৈধ বা অবৈধ যে পথেই হোক। এই সুযোগটিই নিয়েছে মাফিয়া চক্রগুলো।
মাদারীপুরের তরিকুল এবং রুবেল নামের দুই তরুণের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানব পাচারের ভয়াবহতা। ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে দালালদের মাধ্যমে লিবিয়া গিয়েছিলেন তারা। সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় নৌকাডুবিতে দুজনই নিখোঁজ হন। এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা মাদারীপুরের অনেক তরুণের জীবনেই ঘটেছে, তবুও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা কমছে না।
আমরা এখনো দেখছি, কীভাবে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটের সহযোগীরা সমুদ্রপথসহ অন্যান্য পথে অবৈধভাবে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমজীবীকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, লিবিয়া এবং ইতালিতে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে ভয়ংকর নির্যাতন চালাচ্ছে এবং বাংলাদেশে থাকা তাদের পরিবারের কাছ থেকে নানা কৌশলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অনেক সময় এসব আদম ব্যবসায়ীর হাতে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে নির্যাতনের কারণে করুণ মৃত্যুও হচ্ছে।
আইন ও প্রতিরোধ
মানব পাচার ও প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ধারা ৩ অনুসারে, মানব পাচার বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, বলপ্রয়োগ, অপহরণ, প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহার বা অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অবৈধভাবে স্থানান্তর করা, যার উদ্দেশ্য হলো যৌন শোষণ, শ্রম শোষণ বা অন্য কোনো ধরনের নিপীড়ন। প্রতি বছর আনুমানিক ৪ মিলিয়ন মানুষ বিশ্বব্যাপী পাচারের শিকার হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
দারিদ্র্যকে মানব পাচারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দরিদ্র মানুষগুলো ভালো জীবনের প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে পাচারের ঝুঁকিতে পড়ে। পাচারকারীরা এই সুযোগটিই গ্রহণ করে।
বাংলাদেশের শিশু পাচারের অন্যতম হাতিয়ার হলো বাল্যবিবাহ। বিশেষত, গ্রামের মানুষ বিদেশি ছেলেদের হাতে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের তুলে দিতে দ্বিধা করে না, যা প্রতারণা চক্রের সদস্যদের জন্য বিদেশে পাচার করার সুযোগ তৈরি করে। এছাড়া পাচারকারীরা তরুণীদের শিক্ষা, ভালো চাকরি ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দ্বারা প্রলুব্ধ করে। অপহরণকারী চক্রও শিশুদের পাচার করে। পাচারকৃত শিশুদের দাসের মতো আটকে রাখা হয়, জোর করে ভিক্ষা করানো হয়, এবং প্রায়শই তাদের পরিবারের সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। জার্নাল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশি শিশু বিভিন্ন সময়ে ভারতে পাচারের শিকার হয়েছে। এস্কাড়া রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতি বছর প্রায় ৪ হাজার ৫০০ নারী ও শিশু পাকিস্তানে পাচার হয়।
ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘মানব পাচার রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর মানব পাচারের শিকার ভিকটিমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের রণাঙ্গনেও মানব পাচার চক্রের ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে, যেখানে বাংলাদেশি তরুণদের উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়েছে।
প্রতিকার ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা
মানব পাচারের মতো জটিল সমস্যার এককভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন বেসরকারি সামাজিক সংগঠন এবং সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণকে একত্রিত হয়ে নারী ও শিশু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
পাচার প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা, এবং ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন ও সহায়তা প্রদান – এই সবগুলো ক্ষেত্রেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। নারী ও শিশুদের নিরাপদ করতে হলে পাচারকারীদের শক্ত হাতে দমন ও নির্মূল করা অপরিহার্য।
মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়