Thursday 22 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জীববৈচিত্র্য হ্রাস: পৃথিবীর নিঃশব্দ আত্মহত্যা

সুদীপ্ত শামীম
২২ মে ২০২৫ ১৮:৫৪

আধুনিক সভ্যতার দাপটে প্রকৃতি যেন এক এক করে হারিয়ে ফেলছে নিজের সন্তানেরা– কেউ বিপন্ন, কেউ বিলুপ্ত। কিন্তু মানুষ কি থেমেছে? বরং অগ্রগতির নামে সে যেন নিজেই কবর খুঁড়ছে নিজের অস্তিত্বের। প্রতিটি বিলুপ্ত প্রজাতি কেবল প্রকৃতির একক ক্ষতি নয়, বরং তা একটি বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যচ্যুতির সতর্ক ঘণ্টা। এই নিঃশব্দ ধ্বংসযজ্ঞে হারিয়ে যাচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল, দূষিত হচ্ছে বাতাস, কমে যাচ্ছে পানি ধারণের ক্ষমতা, ধসে পড়ছে কৃষি ও জলজ সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা। অথচ আমরা ব্যস্ত উন্নয়নের বাহারি ব্যাখ্যায়, ভুলে যাচ্ছি যে প্রকৃতির মৃত্যু মানে মানুষের আত্মহনন।

বিজ্ঞাপন

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ১৫০-২০০ প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৬৯ শতাংশ। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়, যেখানে বন ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত শিকার ও দূষণের কারণে বাস্তুতন্ত্র বিপর্যস্ত। এছাড়া আন্তঃসরকারীয় জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র পরিষদের (IPBES) রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে, যাদের অধিকাংশই কয়েক দশকের মধ্যেই হারিয়ে যেতে পারে। সামুদ্রিক পরিবেশেও চলছে বিপর্যয়– প্রতি মিনিটে সমুদ্রে যাচ্ছে প্লাস্টিক, যা সামুদ্রিক জীবের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। পৃথিবীর মাটির গুণগত মান দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে পরাগায়নকারী পতঙ্গ, যাদের অনুপস্থিতিতে ফসল উৎপাদন হুমকিতে পড়বে। এমনকি আবহাওয়ার চরমতা– অপরিকল্পিত বর্ষণ, খরা, ঘূর্ণিঝড়– প্রকৃতির এই সংকটকেই আরও ঘনীভূত করছে। অথচ আমরা এখনও অনেকেই জানি না, একটির পর একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়া মানে ধীরে ধীরে মানবজাতির জন্যই মৃত্যু ডেকে আনা। এই সংকেত উপেক্ষা করার আর কোনো অবকাশ নেই।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশে একসময় যেসব এলাকায় শেয়াল, বনরুই, কাস্তেচড়া, ঘড়িয়াল চোখে পড়ত, এখন সেসব নাম কেবল গল্পে শোনা যায়। বাংলাদেশের ৩৮টি স্তন্যপায়ী ও ৫০টিরও বেশি পাখির প্রজাতি ইতোমধ্যে বিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত। মধুপুর বন, সুন্দরবন, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন এলাকার জীববৈচিত্র্য তীব্র হুমকিতে। অথচ আমাদের দেশের সংবিধানে (অনুচ্ছেদ ১৮-ক) জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হলেও কার্যকর প্রয়োগের ঘাটতি চোখে পড়ে প্রতিনিয়ত।

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত কয়েক দশকে প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামীণ জলাশয় ভরাট হয়েছে বসতি বা কৃষিজমিতে রূপান্তরের কারণে, যার ফলে স্থানীয় মাছ ও জলজ উদ্ভিদের বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। গ্রামীণ এলাকায় প্রচলিত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার ধ্বংস করছে পরাগায়নকারী পতঙ্গ ও উভচর প্রাণীর আবাস। পাহাড়ি এলাকায় নির্বিচারে গাছ কাটার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ঝিরি ও জীবজগত। এমনকি শহরাঞ্চলেও পার্ক, বনানী ও খালবিল দখল করে তৈরি হচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গল। অথচ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রয়েছে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প, কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই হয় জনসচেতনতাবিহীন, নয়তো স্বল্পমেয়াদী ও কাগুজে সাফল্যে ভরা। বাস্তব মাঠপর্যায়ে যে দুর্বলতা, সেটাই আজ প্রকৃতিকে করে তুলছে আরও নিঃসঙ্গ।

জীববৈচিত্র্য না থাকলে প্রথমেই আমরা হারাবো খাদ্য নিরাপত্তা। একটিমাত্র প্রজাতির ধান কিংবা গমের ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের করে তুলবে ঝুঁকিপূর্ণ। হারাবো ঔষধের উৎস, কারণ আজকের অনেক ওষুধ উদ্ভিদ কিংবা প্রাণিজ উৎস থেকেই এসেছে। হারাবো জলবায়ুর ভারসাম্য, কারণ বন ধ্বংস মানে কার্বন শোষণের ক্ষমতা কমে যাওয়া। এমনকি হারাবো সাংস্কৃতিক পরিচয়ও, কারণ অনেক জনগোষ্ঠীর জীবন ও উৎসব জীববৈচিত্র্যের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর বাইরে হারাবো কৃষি ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা, কারণ পরাগায়নকারী মৌমাছি বা প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কাজ করা পাখি ও কীটপতঙ্গের অভাব কৃষি উৎপাদনকে করে তুলবে অনির্ভরযোগ্য। গ্রামীণ মানুষের জীবনধারা, ঐতিহ্যবাহী মাছ শিকার, গাছ নির্ভর ওষুধ ব্যবহার– সবকিছুই আজ জীববৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল। বনভূমি কমে গেলে বাড়বে ভূমিধস ও বন্যার আশঙ্কা, যা আবার ধ্বংস করবে কৃষিজমি ও আবাসন। এমনকি শহরাঞ্চলেও পরিবেশ দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বড় কারণ হলো বৃক্ষ ও সবুজের সংকট। সব মিলিয়ে, জীববৈচিত্র্য হারানোর অর্থ হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনিশ্চিত ও সংকটময় পৃথিবী তৈরি করে যাওয়া।

অনেকেই জীববৈচিত্র্য হ্রাসের জন্য কেবল বন উজাড়কে দায় দেন। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে আরও বহু কারণ– জলাশয় ভরাট, একফসলি চাষের প্রবণতা, রাসায়নিকের অপব্যবহার, অজৈব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা, শহরায়ন ও পর্যটনের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। প্রযুক্তি যেমন জীবন সহজ করেছে, তেমনই তা অদৃশ্যভাবে শেষ করছে একটি একটি করে জীবনের ধারা। পাহাড় কেটে অবৈধভাবে বসতি তৈরি, নদীশাসনের নামে প্রকৃতির গতিপথ রুদ্ধ করা, শিল্পবর্জ্যের সরাসরি জলাশয়ে নিক্ষেপ, এমনকি অবৈধ শিকার ও পাচার– এসবই জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতের কৃত্রিম আলো ও শব্দদূষণও ক্ষতি করছে নিশাচর প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনচক্রে। শহর কেন্দ্রিক জীবনধারার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পরিবেশ-পরিকল্পনায় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অবহেলিত থেকে যাচ্ছে, উন্নয়নের নামে প্রকৃতিকে যেভাবে কেটে-ছেঁটে সাজানো হচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জন্যই অভিশাপ ডেকে আনবে। এই বহুমাত্রিক কারণগুলো চিহ্নিত করে, সমন্বিত পরিকল্পনা না নিলে আমরা জীবনের এই জটিল অথচ অপরিহার্য নিটোল ছন্দকে আর ফিরিয়ে আনতে পারব না।

জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে শুধু গাছ লাগিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলেই চলবে না। দরকার বাস্তবায়নভিত্তিক নীতিমালা, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, প্রকৃতি-ভিত্তিক শিক্ষা এবং জবাবদিহিমূলক প্রশাসন। কৃষি ও পরিবেশ নীতিকে একসূত্রে গেঁথে পরিকল্পনা করতে হবে। প্রথম ধাপে প্রয়োজন– সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে স্কুল-কলেজে জীববৈচিত্র্য বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনকে বিবেচনায় রেখে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের আগে অবশ্যই পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা জরুরি। পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশ ব্যবস্থাপনার বদলে প্রাকৃতিক ও টেকসই পদ্ধতির চর্চা বাড়াতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট তহবিল ও গবেষণা জোরদার করা উচিত। অবশেষে, জীবন ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ক পুনরুদ্ধারই হতে পারে জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রকৃত সূচনা। এই যাত্রা শুরু হোক আজ থেকেই– নিজ নিজ জায়গা থেকে, আন্তরিকতায়।

জীববৈচিত্র্য রক্ষা মানে শুধু একটি গাছ বা একটি প্রজাতিকে রক্ষা নয়– এটা হলো একটি পরিপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখা। আর প্রকৃতি বাঁচলেই আমরা বাঁচবো। না হলে, প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া প্রজাতি আমাদের ভবিষ্যতের একেকটি অন্ধকার ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে থাকবে। আমরা যদি আজ প্রকৃতির আর্তনাদ না শুনি, তবে কাল প্রকৃতি আমাদের কান্না শুনবে না। উন্নয়ন ও আধুনিকতার নামে অন্ধ দৌড়ে ছুটতে ছুটতে আমরা যেন ভুলে যাচ্ছি– এই পৃথিবীতে মানুষ একমাত্র বাসিন্দা নয়। অন্যান্য প্রাণী, গাছপালা, পাখি, কীটপতঙ্গ– সবাই মিলে এই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষা মানে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া। আমাদের চিন্তা-চেতনায় জীববৈচিত্র্যকে দিতে হবে যথাযোগ্য স্থান। নীতি নির্ধারক, প্রশাসন, নাগরিক– সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সম্মিলিতভাবে। কারণ জীবনের সুরক্ষাই হলো প্রকৃত উন্নয়ন আর প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন উন্নয়ন হলো আত্মঘাতী বিভ্রম।

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

জীববৈচিত্র্য মুক্তমত সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর