বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘদিন ধরে দারিদ্র্যকে শুধু আয়ের ভিত্তিতে পরিমাপ করে আসছি। কারো দৈনিক আয় একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপরে থাকলেই ধরে নেওয়া হয়েছে, সে দরিদ্র নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি কিছু ক্ষেত্রে আমাদের কাজে এসেছে, সন্দেহ নেই। আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য অনেকটা কমেছে, অর্থনীতির আকার বেড়েছে, শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে, মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার একেবারে গভীরে তাকালে বোঝা যায়, টাকার অঙ্কে কেউ গরিব না হলেও, জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ দিকেই তারা বঞ্চিত।
এই বঞ্চনার চিত্রকে বোঝাতেই আমরা বলি ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র্য’। দারিদ্র্য মানে শুধু পকেটে টাকা থাকা নয়; বরং দারিদ্র্য মানে একটি মানুষের ন্যায্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি, বাসস্থানের অধিকার থেকেও বঞ্চিত থাকা। অনেকেই আয়ের দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছেন, অথচ বসবাস করেন ভাঙাচোরা জীর্ণশীর্ণ ঘরে, সন্তানদের পাঠাতে পারেন না ভালো স্কুলে, ন্যূনতম চিকিৎসাও পান না, তাহলে কি তারা সত্যিই দরিদ্র নন?
সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ২৫% মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। সংখ্যায় তা ৪ কোটিরও বেশি মানুষ। আরও প্রায় ৩ কোটি মানুষ আছেন যারা খাদের কিনারায়। অর্থাৎ, সামান্য কিছু ধাক্কা খেলেই দারিদ্র্যের অতলে পড়ে যাবেন। এই সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, এই সংখ্যার আড়ালে রয়েছে অজস্র কষ্টের গল্প, যেগুলো আমরা প্রতিদিন রাস্তাঘাটে, গ্রামে, পাড়ায় দেখতে পাই।
চোখ মেলে তাকালেই আমরা এই দারিদ্র্য দেখতে পাই। এমন অসংখ্য পরিবার আছেন যারা এখনও কুয়া বা পুকুরের পানি খাচ্ছেন, বিদ্যুৎহীন ঘরে দিন কাটাচ্ছেন, রান্না করছেন কাঠ জ্বালিয়ে। ছেলে-মেয়েরা যাচ্ছে এমন স্কুলে যেখানে শিক্ষকই নেই, বই নেই, টয়লেট নেই। বয়স্ক মা-বাবা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন কারণ চিকিৎসা করানোর টাকা নেই। এই মানুষগুলো কি শুধু আয়ের দৃষ্টিতে বিচার করলেই যথাযথ হবে?
করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, সামান্য আয় বাড়লেই মানুষ নিরাপদ নয়। বহু পরিবার যারা আগে গরিব ছিল না, একবার লকডাউন, একবার অসুস্থতা, একবার প্রাকৃতিক দুর্যোগেই সব হারিয়ে ফেলেছে। কারণ তাদের জীবন ছিল ভিতর থেকে দুর্বল, অবকাঠামো ছিল না, স্বাস্থ্যসেবা ছিল না, সুরক্ষা ছিল না। অর্থনীতির কলেবর বড় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি পৌঁছাচ্ছে না সবার কাছে।
জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে, তবে এইসব সূচকে জীবনের গুণমান ধরা পড়ে না। আপনি হয়তো একজন গার্মেন্টস কর্মীর আয় বেড়েছে শুনে খুশি হবেন। কিন্তু যদি সেই কর্মী এখনও খুপরি ঘরে থাকেন, সন্তান স্কুলে যায় না, অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতে যেতে পারেন না তবে সেই আয় আদৌ তার জীবনমানের উন্নয়ন করেছে?
শিক্ষাক্ষেত্রেও চিত্র একই রকম। সরকারি প্রতিবেদন বলছে, শিশুরা স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, হ্যাঁ। কিন্তু পড়াশোনা শিখছে কতটা? শিক্ষক নেই, ক্লাস নেই, প্রেষণা নেই। শুধু উপস্থিত থাকলেই কি সেটা শিক্ষা? বিশেষ করে গ্রামীণ ও দরিদ্র এলাকায় এই চিত্র আরও করুণ।
স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দারিদ্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। আমরা যারা শহরে বাস করি, তারা হয়তো একরকম ব্যবস্থা পাই, কিন্তু গ্রামের চিত্র অনেক ভিন্ন। ক্লিনিক নেই, চিকিৎসক নেই, ওষুধ নেই। ফলে একটা সাধারণ অসুখই একটি দরিদ্র পরিবারকে পথে বসিয়ে দিতে পারে।
তার উপর যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বারবার ঘূর্ণিঝড় আসে, নদীভাঙনে গ্রাম হারিয়ে যায়, মানুষ স্থানচ্যুত হয়। তারা আবার ঘর তো বানায়, কিন্তু জীবন ফিরিয়ে আনতে পারে না। এইসব মানুষও হয়তো একটু উপার্জন করছে, কিন্তু প্রতিনিয়ত নতুন করে দারিদ্র্যের শিকারে পরিণত হচ্ছে।
এজন্যই বলছি, শুধু আয় বাড়ানো দারিদ্র্য দূর করতে যথেষ্ট নয়। আমাদের দরকার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি; বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে বুঝে নেওয়া এবং সেটা মোকাবেলার উপায় খোঁজা। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, আমাদের নীতিনির্ধারণে শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি, বিদ্যুৎ, বাসস্থান এই বিষয়গুলোকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
তবে, কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ইতোমধ্যেই এসেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৮ শতাংশ যা ২০১৯ সালে নেমে এসেছে ২৪ শতাংশে। অর্থাৎ আমরা চাইলে পারি। কিন্তু সামনের চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যে চলে যেতে পারে। সুতরাং এই মুহূর্তে থেমে থাকলে চলবে না।
সত্যি বলতে কী, আমাদের দারিদ্র্য দূরীকরণ মানেই এখন শুধুমাত্র ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ নয়, এটি মানেই এখন মানবিক উন্নয়ন। এমন একটি সমাজ গড়া, যেখানে একটি শিশু ভালো স্কুলে যেতে পারে, একজন মা চিকিৎসা পেতে পারে, একজন বাবা নিজের ঘরে নিরাপদে ঘুমাতে পারে। এই জীবনগুলোই উন্নয়নের আসল মানদণ্ড।
বাংলাদেশের সামনে সুযোগ রয়েছে। আমরা চাইলে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে জয় করতে পারি। কিন্তু তার জন্য দরকার সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আন্তরিকতা, এবং পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা। কারণ দিনশেষে, উন্নয়ন মানেই মানুষ।
লেখক: উন্নয়নকর্মী