আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘নবযুগ’ প্রবন্ধের সূচনালগ্নে লিখেছেন— ‘আজ মহাবিশ্বে মহাজাগরণ, আজ মহামাতার মহাআনন্দের দিন’। সত্যি কবি নজরুল, তোমার জন্মতিথির কারণেই বাঙালি জাতিসত্তার মহাআনন্দের দিন আজ। বাংলা ১৩০৬ সনের জৈষ্ঠ্যমাসের ১১ তারিখ কাজী ফকির আহমদ ও জাহেদা খাতুনের কোলজুড়ে ভূমিষ্ট হন কবি নজরুল। আজ জাতীয় কবির ১২৬তম জন্মজয়ন্তী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি মনীষার এক মহত্তম বিকাশ, বাঙালির সৃষ্টিশীলতার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন। সাহিত্যের ও সঙ্গীতের প্রায় সর্বাঞ্চলে তার দৃপ্ত পদচারণা।নজরুল তার বহুমাত্রিক প্রতিভার স্পর্শে বাংলা সাহিত্য-সংগীতে যুক্ত করেছেন যুগ-মাত্রা। তিমিরকে পেছনে ফেলে দীপ্তিমান প্রতিটি সাহিত্যে, তার সৃষ্টিশীল কর্মে। যার বচন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। তার উচ্চকিত দ্রোহের দামামায় সবকিছু তছনছ হয়েছে।
কবি নজরুল মৌলিক কবি-প্রতিভার অধিকারী এক জাগ্রত সত্তা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় সমকালীন দেশকাল ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের ঘটনাবলী নিয়ে প্রকাশিত তার বিভিন্ন রচনা ও নিবন্ধে। সমকালীন রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানবিক জাগরণ ইত্যাদির বিষয়ে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ক. ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, নজরুলের আমিত্ব এবং সমকালীন সমাজ বাস্তবতা
সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় নজরুলের বিচরণ ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছন্দচিত্ত। কবিতা ও সংগীতে তার লেখার সংখ্যা বেশি হলেও গদ্য সাহিত্যে তার অবদান অতুলনীয়। তার প্রবন্ধ সাহিত্য বিশেষত রাজনৈতিক প্রবন্ধসমূহ অসাধারণ। এসব লেখায় পরাধীনতার গ্লানির পাশাপাশি মানবিকতা ও মানবতাবোধ স্পষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। ঔপনিবেশিক প্রভু ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্যবোধ তার লেখায় যেভাবে ফুটে উঠেছে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে জেগে উঠার জন্য,সোচ্চার হবার জন্য সাধারণ জনগনকে তিনি তার লেখায় আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর আর কোন সাহিত্যিকের এরকম লেখা বিরল। ‘যুগবাণী’, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’,’দুর্দিনের যাত্রী’, ‘রুদ্র-মঙ্গল’ তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। তন্মধ্যে প্রাবন্ধিক নজরুলের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নাম প্রবন্ধটি বিশেষ দৃষ্টান্ত ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। যা তিনি ১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি কলিকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বসে লিখেছেন।
প্রবন্ধের শুরুতেই নজরুল বলেছেন— ‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে রাজার মুকুট; আর ধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড। রাজার পক্ষে—নিযুক্ত রাজবেতনভোগী রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক,আদি অন্তকাল ধরে সত্য—জাগ্রত ভগবান’। প্রাবন্ধিক নজরুল রাজকারাগারে বন্দী তবুও তার প্রাণভয় নেই। তিনি একমাত্র স্রষ্টার উপর অকৃত্রিম রসনা চেয়েছেন। কবি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এ জগতে যাই হোক না কেন, তিনি যদি সত্যকে তুলে ধরে থাকেন তাহলে স্রষ্টাই তাকে সহযোগিতা করবে। কেননা নজরুল যা লিখেছেন তা স্রেফ স্রষ্টা তার মাধ্যমে লিখিয়েছেন অর্থাৎ স্রষ্টা তাহার হাতের কাণ্ডারি,তিনি (নজরুল) নন। অতএব, স্রষ্টা তাকে বিন্দুমাত্র অসহযোগিতা করবে না। তাই সবসময় তিনি নির্ভীক থাকতেন। তিনি আরও লিখেছেন, ‘রাজার বাণী বুদ্বুদ, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র। আমি কবি,অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য,অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত’। তিনি দৃপ্ত কন্ঠে নিজেকে শানিত রেখেছেন। সদা সত্যকে তিনি কলমের আঁচড়ে তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করতেন স্রষ্টা নিজে তাকে অপ্রকাশিত সত্য প্রকাশ করবার জন্য প্রেরণ করেছেন। তিনি মনে করতেন সত্য স্বয়ংপ্রকাশ। সত্য কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না—সত্য বহমান নদীর স্রোত ধারার মতো প্রকাশ্য। নজরুল সত্য প্রকাশের বীর বল যন্ত্র । নজরুল এ প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করেছেন, ‘আমি মর, কিন্তু আমার বিধাতা অমর’। অর্থাৎ নজরুলকে হয়তো রাজদণ্ড-কারাদণ্ড প্রদান করে মারতে পারবে কিন্তু বিধাতাতো অমর, তাকে (বিধাতা) কে মারবে। এরকম অজস্র প্রশ্ন করেছেন প্রবন্ধে। তিনি বারবার বলেছেন, তার লেখায় ফুটে উঠেছে সত্য,তেজ আর প্রাণ। তিনি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি,বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তিনি লিখেছেন,’আজ এই আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় একা আমি দাঁড়িয়ে নেই, আমার পশ্চাতে স্বয়ং সত্যসুন্দর ভগবানও দাঁড়িয়ে। যুগে যুগে তিনি এমনি নীরবে তার রাজবন্দী সত্য-সৈনিকের পশ্চাতে এসে দণ্ডায়মান হন।’ নজরুলের দৃঢ় বিশ্বাস, একাগ্রতায় মিশ্রিত প্রবন্ধটি।
‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধে পরাধীনতার বিরুদ্ধে কঠোর শব্দোচ্চারণ করেছেন তিনি। একসময় ভারতের অধিবাসীরা দাস ছিল। এটা নির্জলা সত্য। তবে তৎকালীন তা বলা যেতো না। অন্যায়কে অন্যায় বললে তা হতো রাজদ্রোহ। যা বর্তমান সমাজ বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘জোর করে সত্যকে মিথ্যা,অন্যায়কে ন্যায়,দিনকে রাত বলানো—একি সত্য সহ্য করতে পারে?
নজরুল এই প্রবন্ধের শেষাংশে বলেছেন, তিনি পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই তিনি যা অন্যায় বলে বুঝেছেন,তাকে অন্যায় বলেছেন,অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছেন,মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন। তিনি কাহারো তোষামোদ করেননি, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কাহারো পিছনে পোঁ ধরেননি। তিনি শুধুমাত্র রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে তার সত্য তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। সত্যকে তুলে ধরতে ঘরে বাহিরে বিদ্রুপ, অপমান,লাঞ্ছনা, আঘাত অপর্যাপ্ত পরিমানে পেতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেছেন, ‘আমি যে কবি,আমার আত্মা যে সত্য দ্রষ্টা ঋষির আত্মা। আমি অজানা অসীম পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। এ আমার অহংকার নয়, আত্ম-উপলব্ধির আত্মবিশ্বাসের চেতনা লব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি। আমি অন্ধ-বিশ্বাসে,লাভের লোভে,রাজভয় বা লোকভয়ে মিথ্যাকে স্বীকার করতে পারি না। অত্যাচারকে মেনে নিতে পারি না। তাহলে যে আমার দেবতা আমায় ত্যাগ করে যাবে।’ অর্থাৎ নজরুল তার আমি সত্ত্বার উপর অটল বিশ্বাস প্রতিস্থাপন করেছেন স্রষ্টাকে উপলব্ধি করতে পেরে। সর্বশেষ লিখেছেন—’ঐ অত্যাচারীর সত্য পীড়ন/ আছে তার আছে ক্ষয়;/ সেই সত্য আমার ভাগ্য-বিধাতা/ যার হাতে শুধু রয়।’
খ. কবিতা ‘বিদ্রোহী’ এবং নজরুল সাহিত্য
বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুল সবচেয়ে খ্যাতিমান ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য। ‘অগ্নীবীণা’র দ্বিতীয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’। এ কবিতার ১৩৯ চরণে মোট এগারোটি স্তবক স্থান পেয়েছে। তন্মধ্যে নজরুল ‘আমি’—এই শব্দটি ১৪৫ বার উচ্চারণ করেছেন। যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। কবিতায় বিদ্রোহী চেতনার ঝাঁঝালো, বহুমাত্রিক, উচ্চকণ্ঠ প্রকাশের মাধ্যমেই কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী অভিধালাভ। কাজী নজরুল ইসলাম আত্মজাগরণের পদ্যভাষ্য ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। কবিতায় প্রকাশিত বীরসত্তা এবং উত্তম পুরুষে বর্ণিত দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠেছে কবির আত্মভাষ্য। আজন্ম লালিত বেড়ে ওঠা সংসার, সমাজ আর লড়াইয়ের মাঠে জীবনের যে পাঠ তিনি নিয়েছিলেন,তা ছিল গ্লানিকর আর বীভৎস। দারিদ্র্য আর দাসত্বের শৃঙ্খলাবদ্ধ বিপন্ন মানবতাকে উদ্ধারকল্প কবির বিদ্রোহী। আত্মােপলব্ধিব কবিকে অমিত শক্তিতে বলীয়ান করেছে,হয়েছেন আত্মপ্রত্যয়ী বীরপুরুষ। আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ‘বিদ্রোহী’র, দীপ্তিমান আত্মদর্শন হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।
‘বল বীর—
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!’
উপরোক্ত পঙক্তিতে কবি নজরুল তার অন্তরাবেগের সুতীব্র স্ফৃর্তির প্রকাশ ঘটেছে। যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সমাজের বৈষম্য যাতনার সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিকারের এক চিরন্তন প্রতিবাদের ঝড়-স্বর্বস্ব কাব্যগাথা উপাখ্যান তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। কবিতাটি প্রথম সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত হলে নজরুলের নাম মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সুখ্যাতি পেতে থাকেন। বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরে যায়। সাহিত্যাঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বাঙালিসমাজ প্রবলভাবে জেগে ওঠে। গণমানুষকে জাগিয়ে তোলার বিপ্লবী চেতনাসমৃদ্ধ দুঃসাহসী লেখা সনকালীন অন্যকোনো কবির রচনায় পাওয়া যায়নি।
কবি নজরুল পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে ঘুমন্ত দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি পরাধীনতার বিরুদ্ধে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন নির্ভীক চিত্তে। তার এই কবিতা উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনার মুক্তিমন্ত্র হয়েছে উঠেছিলো।তাই তিনি বীরদের দর্পে ডেকেছেন এই উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য। তিনি যথার্থ বলেছেন, ‘আমি বেদুঈন,আমি চেঙ্গিস / আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ। ‘কবির ইচ্ছা পৃথিবী জুড়ে চলমান অন্যায়,অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার এই বিদ্রোহ এবং প্রতিবাদ ততদিন উচ্চকিত থাকবে,যথদিন না তার মূল উৎপাটিত হয়। কবিতায় বলেছেন—’ আমি সেই দিন হব শান্ত,/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপান ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—’।
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। তিনি যুগমানসের প্রতীক, সমকালীন যুগের মানস-সন্তান। তবে নজরুলের বিদ্রোহের এমন একটা স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য আছে যা সকল সুর, সকল কণ্ঠ অতিক্রম করে আমাদের কর্ণগোচর হয়েছে। নজরুলের আবির্ভাবকালে সমকালীন সাহিত্যে বিদ্রোহের সুর ক্রমশ উচ্চকিত হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু তখনো পর্যন্ত অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে অসি চালানোর মতো দুঃসাহস কেউ অর্জন করেননি। এই দূরুহ কাজটি সম্পন্ন করেছেন নজরুল। নজরুল শুধু সরব বিদ্রোহ ঘোষণায় অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অসি ধারণই করেননি, স্বয়ং বিধাতা পুরুষের বুকে পদাঘাত হানার দুর্জয় শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠেন। এখানেই নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। তাই উচ্চকিত কণ্ঠে নজরুল বলেছেন, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ চিহ্ন’।
পরিশেষে, নজরুলের সত্য ভাষ্য, খোদার প্রতি অকুন্ঠ বল তাকে করেছে মহান। সারা পৃথিবী যখন সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা পদদলিত, অন্যায়,অত্যাচার, বৈষম্য ও শোষণের গ্লানি–এর মধ্যে কবি সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছেন। অন্যায়ের বিপরীতে ন্যায়কে, মিথ্যার বিপরীতে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য কবির দুর্মর আকুতি বিরাজমান ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়