বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি বরাবরই একটি অগ্রাধিকার খাত হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনায় কৃষি এক বিষ্ময়কর সাফল্য নিয়ে আমাদের কাছে আর্বিভূত হয়েছে বিশেষত: কৃষি ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে ধানের উৎপাদন গত আট বছরে বেড়েছে ষাট লক্ষ মেট্রিক টন যার কৃতিত্ব সবটুকুই কৃষকদের এবং এই জটিল কাজটি সম্ভব হয়েছে কৃষকের ঐকান্তিক পরিশ্রম, সরকারের কৃষি বন্ধব নীতি, সময়মত প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ, কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা, দশ টাকা মূল্যে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা, সোয়া দু’কোটি কৃষি উপকরণ কার্ড বিতরণ ইত্যাদির মাধ্যমে। বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্ণকারী দেশই নয়, খাদ্য বিশেষত: চাল রপ্তানীকারি দেশ হিসাবে বিশ্বের কাছে আবির্ভূত হয়েছে। দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সহ জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম এর আওতায় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ভৌগলিক অঞ্চল ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং তদীয় জাতগুলোকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌছানোর এক অভিবন উদ্যোগ নিয়ে চল্ছে যা আমাদের কৃষি উন্নয়নের একটি আলোচিত দিক।
কৃষি ক্ষেত্রে এত সাফল্যের পরও সরকারের কাছে কৃষি এখনও একটি অবহেলিত খাত বিশেষত: বিনিয়োগের অঙ্কে এবং চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্ধ হলো মোট বাজেটের ৫.৯ শতাংশ যা কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য নয় ।সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশে সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্ট নেতারা জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে ৪০ শতাংশ উন্নয়ন বরাদ্দসহ কৃষকের স্বার্থে ১২ দফা দাবি জানিয়েছে অর্থ উপদেষ্টা বরাবর ।এই দলের নেতাদের বক্তব্য হলো কৃষি হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তম খাত; কিন্তু এই খাতটি দীর্ঘদিন ধরেই চরম অবহেলার শিকার। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ এবং গ্রামীণ নারীদের প্রায় ৬০ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। কৃষি খাত দেশের জিডিপিতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ অবদান রাখলেও সরকারিভাবে এর গুরুত্ব নেই বললেই চলে। কৃষি ও কৃষক ক্ষেতমজুর না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। কৃষি ও কৃষকের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত না হলে, দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে পড়বে।তারা বলেন, কৃষি উপকরণের দাম যেমন বেড়েই চলেছে, তেমনি কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে প্রতিবছর প্রায় ১১ লাখ কৃষক জমি হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। বাজার ভরে গেছে ভেজাল সার, বীজ ও কীটনাশকে। যার ফলে কৃষকরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ক্ষেতমজুরদের বছরে গড় কাজ থাকে ১৮০ দিনেরও কম। ‘আর্মি রেটে’ গ্রামীণ রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবিও বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। দেশের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ লক্ষ্যে তিনি জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে উন্নয়ন বরাদ্দের ৪০ শতাংশ নিশ্চিত করার জোর দাবি জানান । তাদের দাবিগুলো হলো- ১. জাতীয় বাজেটে উন্নয়ন বাজেটের ৪০% কৃষি খাতে বরাদ্দ করা; ২. কৃষি শ্রমিকদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড, রেশন ও স্বাস্থ্যসুবিধা নিশ্চিত করা; ভূমিহীন, ক্ষেতমজুর ও বর্গা চাষিদের কৃষি কার্ড দেওয়া;৩. কৃষি শ্রমিকদের সারা বছর কাজের নিশ্চয়তা এবং ১২০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্প চালু; ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস; ন্যূনতম মজুরি দৈনিক ৮০০ টাকা নির্ধারণ; পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সরকারি উদ্যোগে কাজের এলাকায় থাকার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। বড় পাথার, হাওড় এলাকায় সরকারি উদ্যোগে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা করা; ৪. নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য দূর করা; ইউনিয়ন স্বাস্থকেন্দ্রে এমবিবিএস ডাক্তার, ১০ শয্যার হাসপাতাল, পর্যাপ্ত ওষুধ ও সিজার সুবিধাসহ মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করা; ৫. বিএডিসিকে সচল করা, সার-বীজ, কীটনাশকসহ সব কৃষি উপকরণ ন্যায্যমূল্যে যথাসময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ করা; ভেজাল বীজ, সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া; ৬. কৃষি ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করা; প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র খুলে খোদ কৃষকের কাছ থেকে কৃষি ফসল ক্রয় করা। চলতি মৌসুমে কমপক্ষে ৫০ লাখ টন ধান খোদ কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করা;৭. বন্যা-খরা, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; ৮. সরকারি খাসজমি সমবায়ের মাধ্যমে ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের মধ্যে বিতরণ (হস্তান্তর অযোগ্য) কর; সব ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য সরকারি আবাসন নিশ্চিত করা;৯. দশ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ সুদ ও আসলসহ মওকুফ করা। বিনা সুদে কৃষিঋণ দিতে হবে এবং সার্টিফিকেট মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার কর; ১০. চাল, ডাল, তেল-চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানো, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া; আর্মি রেটে রেশন দেওয়া; ১১ ব্যাংক-সেটেলমেন্ট, তহশিল ও ভূমি অফিসসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুস-দুর্নীতি ও দলীয়করণ বন্ধ করা। এনজিও ঋণের অস্বাভাবিক সুদ কমানো ও হয়রানি বন্ধ করা; ১২. আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভূমি ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করা।
এই দাবিগুলো বিশ্লেষনে দেখা যায় যে আসলে সবই যৌক্তিক এবং পূরনযোগ্য । কারন এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষি খাতের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ৪-৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এজন্য কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। ২০১১-১২ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৪ দশমিক ৭৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে তুলনায় কৃষি বাজেট বাড়েনি। এ সময় কৃষি বাজেট বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৮ গুণ। ২০১১-১২ অর্থবছরের মোট বাজেটে কৃষি বাজেটের অংশ ছিল ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা নেমে আসে ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশে। একইভাবে কৃষি ভর্তুকির অংশ নেমে আসে ৬ দশমিক ৪ থেকে ২ দশমিক ১৬ শতাংশে। অর্থাৎ যে হারে মোট বাজেট বেড়েছে সে হারে কৃষি বাজেট ও ভর্তুকি বাড়েনি। চলতি অর্থবছরে কৃষিবিষয়ক পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪৭ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শস্য কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২৭ হাজার ২৪১ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভূমি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। এটা ছিল অপ্রতুল। ফসল কৃষি খাতের বরাদ্দে আগের বছরের সংশোধিত বরাদ্দ থেকে ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষি ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা কমিয়ে রাখা হয় ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কোন খাতে কোন ধরনের সংস্কার হবে, তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনে কতটা পড়বেÑ সে সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারছেন না। তাই সরকার তার মেয়াদে কোন কোন সংস্কার করতে আগ্রহী এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কি হবে, তা বাজেট বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতি নেই। ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বিভিন্ন শিল্প কারখানা বন্ধের কারণে লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছে। কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বাজেটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার। কর ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। প্রতি কর ছাড়ের আদেশ এর সঙ্গে কত রাজস্ব ক্ষতি হলো তার একটা প্রাক্কলন দেয়া। বাজেট কাঠামো, বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বাজেটকে একটি উদ্ভাবনী এবং ব্যবসাবান্ধব করার আকাক্সক্ষা সরকারের থাকলেও শেষ মুহূর্তের বিভিন্ন কারণে বিচ্যুতি ঘটে। যার ফলে অনেক হতাশার সঙ্গে, এটি কেবল সংখ্যার সমন্বয় সাধনের একটি এলোমেলো অনুশীলনে পরিণত হয়। সন্দেহ নেই আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নানা কারণেই ভিন্নতর হবে। এবার বাজেট জনবান্ধব, জাতীয় স্বার্থ সামাজিক উন্নয়ন ও মূল্যস্ফীতি প্রাধান্য পাবে, এটাই প্রত্যাশিত।সাথে সাথে কৃষি সংক্রান্ত দাবিগলো পূরন হবে এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি ও জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা