একটুখানি ছায়া, একটু নির্মল বাতাস, আর নিঃশ্বাসে শুদ্ধ অক্সিজেন জীবন বাঁচাতে এর চেয়ে বড় চাহিদা আর কী হতে পারে? অথচ এই স্রষ্টার আশীর্বাদগুলো আমাদের কাছে আসে এক নিঃশব্দ সহচর গাছের মাধ্যমে। সভ্যতার চাকা যতই ঘুরুক, প্রযুক্তির জোয়ার যতই প্রবল হোক, প্রকৃতি আর বৃক্ষ ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকাটা কল্পনাও করা যায় না।
আমরা প্রতিনিয়ত এই গাছ ধ্বংস করছি। উন্নয়নের নামে, অবহেলার নামে, কখনো না বুঝে, কখনো ইচ্ছা করেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি বুঝতে পারছি, সবুজ ধ্বংস করে গড়ে তোলা সভ্যতা একদিন আমাদেরই নিঃশেষ করে দেবে?
প্রতিটি গাছ নিঃশব্দে কাজ করে চলে। তারা কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে, অক্সিজেন দেয়, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, মাটি ধরে রাখে, বৃষ্টি ডাকে, পাখিদের আশ্রয় দেয়, আমাদের ছায়া দেয় এবং সেটা বিনিময়ে কিছু না চেয়ে। এমন নিঃস্বার্থ সত্তা আর কোথায় পাওয়া যায়?
একটা পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ১২০ কেজি অক্সিজেন দিতে পারে। কল্পনা করুন এমন ১০টি গাছ মানে একটা পরিবারের প্রায় পুরো বছরের নিঃশ্বাসের যোগান। অথচ সেই গাছকে আমরা কাটতে দ্বিধা করি না!
আজকের পৃথিবী ভয়াবহ জলবায়ু সংকটে। কোথাও খরা, কোথাও বন্যা, কোথাও উষ্ণতার রেকর্ড। গলে যাচ্ছে হিমবাহ, ডুবছে দ্বীপ, হারিয়ে যাচ্ছে প্রজাতি।
গবেষকদের মতে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই ভয়াবহ বিপর্যয় আসবে। আর এই তাপমাত্রা রোধে গাছ লাগানোই সবচেয়ে কার্যকর ও সাশ্রয়ী উপায়। একটি গাছ এক বছরে গড়ে প্রায় ২২ কেজি কার্বন শোষণ করতে পারে। ভাবুন, যদি কোটি কোটি গাছ আমরা লাগাতে পারি, তবে পৃথিবীকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব।
গাছ শুধু পরিবেশ রক্ষাই করে না, অর্থনৈতিকভাবেও সহায়ক। কাঠ, ফল, ফুল, ওষুধ, কাগজ সবই আসে গাছ থেকে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গাছের অবদান বিশাল। একটি নারকেল গাছ বা সুপারি গাছও অনেক পরিবারের জন্য আয়ের উৎস।
বনজ ও ফলদ বৃক্ষরোপণ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই আনে না, বরং কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি করে। তাই গাছ লাগানো মানে শুধু পরিবেশ ভালো করা নয়, বরং তা উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতার পথও খুলে দেয়।
আজকের শহরগুলোতে গাছ একটা বিলাসিতার মতো। রাস্তায় রোদে হাঁটা যায় না, গরমে হাঁসফাঁস লাগে, বাতাস ভারী আর ধুলোয় চোখ জ্বলে। প্রতিদিন আমরা টের পাই শহরটা যেন ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
কিন্তু এই শহরেও যদি প্রতিটি রাস্তার পাশে ছায়াদানকারী গাছ থাকে, প্রতিটি ভবনের ছাদে কিছু গাছ থাকে, তাহলে শহরটা বদলে যেতে পারে। শুধু ছায়া নয়, মানসিক প্রশান্তিও আসবে।
‘বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ’ এলেই দেখি চারদিকে গাছ লাগানো উৎসব। কিন্তু উৎসব শেষে চারাগুলো কী অবস্থায় থাকে, সেটা দেখার কেউ নেই। আসলে বৃক্ষরোপণ একটা একদিনের কাজ নয়, এটা হতে হবে অভ্যাস।
আমরা যেমন একটা শিশুকে জন্ম দিয়ে দায়িত্ব নেই তাকে বড় করার, তেমনই গাছ লাগানো মানে তাকে জল দেওয়া, আগাছা তুলে রাখা, বেড়া দেওয়া, ভালোবাসা দেওয়া-এই সব কিছু। যদি সেই দায়িত্ব কেউ না নেয়, তাহলে চারাটি বড় হতে পারে না।
বৃক্ষরোপণের কথা যতই বলি, তার চেয়ে বেশি গাছ কেটে ফেলছি আমরা প্রতিদিন। রাস্তা বানাতে গিয়ে, বিল্ডিং তুলতে গিয়ে, বিদ্যুতের খুঁটি বসাতে গিয়ে শতবর্ষী গাছও আমরা কেটে ফেলি চোখের পলকে। বিকল্প চিন্তা নেই, পরিকল্পনায় পরিবেশের স্থান নেই।
আমরা কি ভাবি না একটি গাছ বড় হতে লাগে ২০-৩০ বছর, কিন্তু তা কাটা যায় ২০ মিনিটে? এই ধ্বংসের দায় কার?
বৃক্ষরোপণ করা এবং বৃক্ষনিধন রোধ করার এই দায়িত্ব আমাদেরই বেশি। আমরা যারা এখনো তরুণ, আমরা চাইলে এই সবুজ রক্ষার কাজটা চালিয়ে যেতে পারি। প্রতিটি স্কুল-কলেজ যদি বছরে অন্তত একবার গাছ লাগানোর ক্যাম্পেইন চালায়, প্রতিটি ছাত্র যদি নিজের বাসায় একটা গাছ লাগায়, তাহলেই শুরু হয় পরিবর্তন।
আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করি, ট্রেন্ড ফলো করি, কিন্তু একটা গাছ লাগানোর ছবি পোস্ট করলে তার প্রভাব হয় অনেক গভীর। শুধু তাই না বন্ধুর জন্মদিনে উপহার হিসেবে একটি গাছ দিলে, সেটাও হয় ভালোবাসার নতুন রূপ।
আমরা নিজেরা গাছ লাগানো, গাছের যত্নের পাশাপাশি পরিবারের ছোটদের গাছের প্রতি ভালোবাসা শেখাতে পারি। বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা এবং স্কুল-কলেজে গাছের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা সভা আয়োজন করাও হতে পারে শুভ উদ্যোগ।
প্রতিদিন আমরা যেভাবে নিঃশ্বাস নিই, সেভাবেই আমাদের উচিত গাছের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। আমরা যদি গাছ না লাগাই, গাছ না বাঁচাই তাহলে একদিন নিঃশ্বাস নেয়ার মতো বাতাসও থাকবে না। পরিবেশ আমাদের শত্রু হয়ে উঠবে, যদি আমরা তাকে বন্ধু না ভাবি।
একটি গাছ মানে একটি আশ্রয়, একটি জীবন, একটি ভবিষ্যৎ। আমরা যারা নতুন প্রজন্ম, আমাদের হাতেই আছে ভবিষ্যতের চাবি। আসুন, আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি প্রতিবছর অন্তত একটি করে গাছ লাগাবো, এবং তাকে আগলে রাখবো যত্নে। সবুজ থাকলে তবেই বাঁচবে পৃথিবী, বাঁচবো আমরা।
লেখক: শিক্ষার্থী