Wednesday 28 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকার জলাবদ্ধতা: রাজধানী যেন প্রমত্তা পদ্মা

ফাহমিদা আক্তার তৃষ্ণা
২৭ মে ২০২৫ ১৬:১০

গ্রীষ্মকালে যখন তাপমাত্রা চরমে ওঠে, তখন বৃষ্টির আগমন নগরবাসীকে এনে দেয় স্বস্তির নিঃশ্বাস। গরম থেকে সাময়িক মুক্তি এবং পরিবেশের সতেজতা মানুষের মনকে প্রসন্ন করে তোলে। তবে এই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। এই জলাবদ্ধতা ঢাকার নিত্যনৈমিত্তিক চিত্রে পরিণত হয়েছে, যা নগরবাসীর জন্য চরম ভোগান্তি বয়ে আনে। সেই সাথে তীব্র যানজটের সমস্যা তো আছেই। সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। শুধুমাত্র ভারী বর্ষনেই যে এমন দুর্ভোগের চিত্র ফুটে ওঠে তা নয়, ঢাকা শহরে মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিতেও শহরের নানান জায়গা তলিয়ে যেতে দেখা যায়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে জনসাধারণ বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীরা।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক সময়ে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গিয়েছে চরম জলাবদ্ধতা। অনেক সড়ক ও অলিগলি ডুবে গেছে। ঢাকার নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাব, মিরপুরের ১৪ নম্বর থেকে ১০ নম্বর যাওয়ার সড়ক, বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনের ফুটপাত, রোকেয়া সরণির শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম ও নৌবাহিনী সদর দপ্তরের সামনের সড়ক, এবং ধানমন্ডির বিভিন্ন এলাকাসহ পুরোনো ঢাকার অনেক এলাকায় বর্ষার আগেই হাঁটুসমান বা কোমরসমান পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এতে করে জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ।

বিজ্ঞাপন

বর্ষাকাল শুরু হওয়ার আগেই যদি হয় এমন অবস্থা তাহলে বর্ষাকালে ঢাকার চিত্র কেমন হবে তা মোটামুটি সুবিদিত। বর্ষাকালে ঢাকাকে সাগর, মহাসাগরের সাথে তুলনা করা না গেলেও; নদীর সাথে তুলনা করলে খুব একটা অন্যায় হবে না।

এই সংকট কেবল সমসাময়িক দুর্ভোগ নয় বরং দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার ফল _

বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাশয় দখল, দুর্বল ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। এছাড়াও জনসাধারণের সচেতনতার অভাব তো আছেই। শহরের অনেক এলাকায় প্রায় ১৫০ বছরেরও আগের নির্মিত পাইপগুলো এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব পাইপলাইন পুরোনো হয়ে যাওয়ায় এবং লিকেজ থাকার কারনে পানি নিষ্কাশনে সমস্যা সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং(IWM) এর গাণিতিক মডেলিং দেখায় যে, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে ও ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং জবাবদিহিতার অভাব জলাবদ্ধতা সমস্যার সবচেয়ে বড় বাধা। উপযুক্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবও শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এপ্রিল ২০২৫ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী,ঢাকা শহরে ৯০% এরও বেশি এলাকা ওয়াসা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতার বাইরে। যা শহরে ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলেছে।

বৃষ্টির পানিতে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতার কারণে বন্ধ হয়ে পড়ে যানবাহন চলাচল, দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় রাস্তা সরু হয়ে যায়, ঘন্টার পর ঘন্টা একই স্থানে গাড়ি আটকা পড়ে। শিক্ষার্থী, কর্মজীবী এবং জরুরি সেবার যানবাহনও এর শিকার হয়। ফলে সড়কগুলো অবরুদ্ধ হয়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি করে। অনেক সময় প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বিদ্যুতায়িত হওয়ার দুর্ঘটনার খবরও পাওয়া যায়। এছাড়াও জলাবদ্ধতার কারণে রাস্তার গর্ত ও ভাঙ্গা অংশ ঢেকে যাওয়ার ফলে প্রায়ই গাড়ির চাকা আটকে বা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দূর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।

এই দুরবস্থা দিনের পর দিন চলতে থাকলেও তা রোধে নেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ। গত এক দশকে জলবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা খরচ হলেও সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। দীর্ঘদিনের এসব সমস্যা সমাধানে সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। এক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ড্রেন নির্মাণ ও তার নিয়মিত পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে যেন পলিথিন,প্লাস্টিক ও অন্যান্য অপচনশীল বর্জ্য ড্রেনে আজকে না যায়। ঢাকার ৫২ টি খালের সাথে নদীর সংযোগ উন্মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি সহজেই নদীতে চলে যেতে পারে। পানি নিষ্কাশনের পথ যেন কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এছাড়াও রাস্তার অবকাঠামগত পরিবর্তন এবং রাস্তার গর্ত ঠিক করা প্রয়োজন যেন পরবর্তীতে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। এর পাশাপাশি সমাজে সর্বস্তরের নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে।

বৃষ্টিতে ঢাকাবাসীর সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান সময় সাপেক্ষ। উপরন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকারের নানান সংকটে জর্জরিত। তবু সরকারের উপযুক্ত নজরদারি, সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরবাসীর দুর্ভোগ সম্পূর্ণ না হোক বেশখানিকটা লাঘব করা সম্ভব।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

ঢাকার জলাবদ্ধতা ফাহমিদা আক্তার তৃষ্ণা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর