Saturday 13 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্লাস্টিক দূষণ: সভ্যতার অগ্রযাত্রায় আত্মঘাতী চোরাবালি

সুদীপ্ত শামীম
৫ জুন ২০২৫ ২০:১১

প্রতি বছর ৫ জুন যখন বিশ্ব পরিবেশ দিবস আসে, তখন ঘটা করে কিছু আলোচনার আয়োজন হয়, কিছু রঙিন ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙানো হয়, দুই-একটা সেমিনারে উপস্থিত থেকে বক্তারা শোনা কথার পুনরাবৃত্তি করেন—এরপর দিবসের পরদিন সবকিছু আবার আগের মত। কিন্তু সময়ের দাবি ছিল, এবার ভিন্ন হবার। কারণ ২০২৫ সালের পরিবেশ দিবস এসেছে এমন এক প্রতিপাদ্য নিয়ে, যা সভ্যতার টিকে থাকার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ।

‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’—এই স্লোগান শুধু একটি পরিবেশগত দাবি নয়, এটি মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চূড়ান্ত আহ্বান।

প্লাস্টিক: আধুনিকতার ছদ্মবেশে এক বিষাক্ত বিপদ

প্লাস্টিক আবিষ্কারের শুরুর দিকে এটি ছিল এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন। হালকা, টেকসই, সাশ্রয়ী ও বহুবিধ ব্যবহারে সক্ষম এই পদার্থ একসময় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই আশীর্বাদ পরিণত হয়েছে অভিশাপে। এখন বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪৩০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়, যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়—এগুলোই ‘সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক’।

বিজ্ঞাপন

এই প্লাস্টিক বর্জ্যের সিংহভাগই যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে, চলে যায় নদী-নালা, সাগর কিংবা মাটির নিচে। কিছু প্লাস্টিক ধীরে ধীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপ নেয়—যা অদৃশ্য অবস্থায় আমাদের পানীয় জলের মধ্যে, খাবারের মধ্যে এমনকি বাতাসের মধ্যেও প্রবেশ করে। বর্তমানে গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে একজন মানুষ প্রতিদিন এমন পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে নিচ্ছে, যা একটি ক্রেডিট কার্ডের সমান!

পরিবেশ ধ্বংসের ছদ্মনায় রাজনীতি ও পুঁজির খেলা

পরিবেশ রক্ষার কথা যত বলা হোক না কেন, বাস্তবে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ও কর্পোরেট স্বার্থের বড় এক ময়দান। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) ২০২৫ সালকে একটি মোড়বদলের বছর হিসেবে দেখতে চায়। তারা বাধ্যতামূলক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণয়নের দিকে এগোচ্ছে, যার লক্ষ্য হবে প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। বাস্তবতা হলো, তেল ও গ্যাসভিত্তিক বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এই চুক্তির বিপক্ষে। কারণ প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি—তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। প্রতিবছর বৈশ্বিকভাবে উত্তোলিত মোট তেলের ১২% এবং গ্যাসের ৮.৫% চলে যায় প্লাস্টিক উৎপাদনে।

এছাড়া এক ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, বিশ্বজুড়ে গ্রিনহাউস গ্যাসের মোট নিঃসরণের প্রায় ৩.৪% প্লাস্টিক উৎপাদন থেকেই আসে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে প্লাস্টিক একটি বড় কারণ হলেও, প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ১৯৪টি দেশের মধ্যে ১৮৩টি দেশই তাদের পরিকল্পনায় (NDC) এই তথ্য অন্তর্ভুক্ত করেনি।

প্লাস্টিকের নিষ্কাশনে ব্যর্থ বিশ্ব ব্যবস্থাপনা

আমরা এখন এমন এক জগতে বাস করছি, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে—যার বেশিরভাগ অংশ কোনো রকম পুনঃপ্রক্রিয়াজাত না করেই সরাসরি পরিবেশে ফেলে দেওয়া হয়। এই বর্জ্য জমা হয় আমাদের শহরের নর্দমা, গ্রামীণ খাল-বিল, কৃষিজমি, পাহাড়ি ঝরনা, নদী, হ্রদ ও সাগরের গভীরে—এমনকি বরফে মোড়ানো হিমালয়ের চূড়াতেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে।

প্লাস্টিক একটি অপচনশীল বস্তু। এর একটি বোতল বা ব্যাগ মাটিতে পড়ে শত বছরের বেশি সময় পরও ঠিক যেমন ছিল, তেমনই থেকে যায়। এর দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি শুধু প্রকৃতিকে বিষিয়ে তুলছে না, বরং খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে আমাদের শরীর ও স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্লাস্টিকের রাসায়নিক উপাদান বিভিন্ন প্রাণী ও মানুষের দেহে প্রবেশ করে ক্যান্সার, হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা, লিভার ও কিডনির রোগ, বন্ধ্যত্বসহ জটিল ও প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করছে। এই দূষণ শুধু স্থলভাগে নয়, জলজ জীববৈচিত্র্যের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ হিসেবে প্লাস্টিক এখন এককভাবে অন্যতম বড় হুমকি। এক গবেষণা অনুযায়ী, প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতিবছর সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিমি, ডলফিন, কচ্ছপ ও নানা প্রজাতির মাছ প্লাস্টিককে খাদ্য ভেবে গ্রহণ করে, ফলে তাদের অন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়, খাদ্য গ্রহণে অক্ষম হয় এবং মৃত্যু ঘটে অকালে।

এটা কেবল প্রাণিকুলের জন্য নয়, আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যও এক ভয়াবহ হুমকি। কারণ, আমরা যারা সমুদ্র ও জলজ উৎস থেকে খাবার গ্রহণ করি—আমরা সবাই এই ‘নীরব বিষ’ এর শিকার হচ্ছি, অজান্তেই। এখনও যদি এই প্লাস্টিক দূষণ রোধে বিশ্ব একসঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই গ্রহে জীবন টিকিয়ে রাখা চরম কঠিন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ ও আমাদের দায়

বাংলাদেশে এখনো ‘সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক’ নিষিদ্ধ করার কোনো সুস্পষ্ট ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। যদিও ২০০২ সালে দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে সেটি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। শহর হোক কিংবা গ্রাম—সবখানেই এখনো অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন ও বিভিন্ন ধরণের প্লাস্টিকের ব্যাগ, পানির বোতল, চিপস-প্যাকেট, প্লাস্টিকের গ্লাস, চামচ, স্ট্র, খাবারের প্যাকেজিং সামগ্রীসহ অগণন একক-ব্যবহারের সামগ্রী।

এমন বাস্তবতায় সচেতনতার অভাব, পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে না তোলা এবং আইন প্রয়োগে দুর্বলতা—এই ত্রিমাত্রিক ব্যর্থতার কারণে আমরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পথ রচনা করছি। এই ক্ষতিকর প্লাস্টিক বর্জ্য শুধুমাত্র পরিবেশ দূষণ করছে না, বরং দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাভূমি, জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিভিত্তিক জীবিকার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের সাধারণ মানুষ—যারা প্রতিদিন দূষিত পানি, মাটি ও বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিকের শিকার হয়ে নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছে। প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব শুধু পরিবেশগতই নয়, এটি একটি ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকটের দিকেও ইঙ্গিত করছে, যার পরিণতি হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি ও প্রজন্মান্তরের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের তাই এখনই প্রয়োজন বাস্তবধর্মী নীতি, কঠোর আইন প্রয়োগ, গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্পের দিকে দ্রুত রূপান্তর—নইলে এই দায়ভার আমাদের সবাইকে বহন করতে হবে, খুব শিগগিরই।

সমাধানের পথ: এখনো সময় আছে

প্লাস্টিক দূষণ রোধে সমন্বিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, আমাদের পদক্ষেপগুলো কার্যকর ও সুসংহত হতে হবে।

আইন কঠোর করা: সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং তা বাস্তবায়নে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। শুধুমাত্র আইন তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বাস্তবে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় জরিমানা ও শাস্তি, বিশেষত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে, অতি দ্রুত কার্যকর করতে হবে, যাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধ করা যায়।

বিকল্প পণ্য তৈরি ও প্রণোদনা: পাট, কাগজ, জুট এবং অন্যান্য পরিবেশবান্ধব উপকরণের ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। এর জন্য সরকার ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগ ও গবেষণায় প্রণোদনা দিতে হবে, যেন এসব উপকরণের উৎপাদন সহজ ও লাভজনক হয়। এক্ষেত্রে কৃষি খাতের সম্ভাবনাও বিশাল, যেমন পাটজাত পণ্যগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

গণসচেতনতা বৃদ্ধি: প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা ও এর প্রভাব নিয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য পাঠ্যবই, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, সচেতনতা প্রচারের জন্য ডকুমেন্টারি, বিজ্ঞাপন ও ক্যাম্পেইন পরিচালনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসন: প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথকীকরণ, পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণে সঠিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং বাজেটের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে, জাতীয় স্তরে সমাধান পাওয়া কঠিন হবে।

আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি: প্লাস্টিক দূষণ বৈশ্বিক সমস্যা। এজন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে বাধ্যতামূলক চুক্তি তৈরি এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে, যার মাধ্যমে দেশগুলো নিজেদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (NDC) অনুযায়ী প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। পাশাপাশি, বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট স্বার্থকে নিয়ন্ত্রণে এনে প্লাস্টিক উৎপাদন সীমিত করা যেতে পারে।

এখনো সময় আছে, তবে সময় বেশি নেই। যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে প্লাস্টিক দূষণ আমাদের জন্য এক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ভবিষ্যতের চোখে আমরা

আজকের সভ্যতা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে এমন এক বিপথে হাঁটছে, যার শেষ প্রান্তে রয়েছে ধ্বংস, দুর্ভোগ আর অনুতাপ। প্রযুক্তি, আরাম ও লাভের দৌড়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি—এই পৃথিবী আমাদের একমাত্র বাসস্থান, আর এর ভারসাম্য নষ্ট হলে কোনো বিকল্প গ্রহ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। প্লাস্টিক দূষণ এই ধ্বংসযজ্ঞের সবচেয়ে নীরব, ধূর্ত এবং সর্বগ্রাসী অস্ত্র—যে অস্ত্রের বিষক্রিয়ায় প্রতিদিন একটু একটু করে মরছে মাটি, পানি, প্রাণ আর মানুষ।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস আমাদের কেবল একটি দিন উদযাপনের উপলক্ষ নয়, বরং নিজেদের দায়বদ্ধতা স্মরণ করার দিন। আমাদের ভাবতে হবে—আমরা কী রেখে যাচ্ছি আমাদের সন্তানদের জন্য? তারা কী দেখবে—নদীহীন, গাছহীন, বিষাক্ত বাতাসে ভরা এক নিষ্প্রাণ পৃথিবী?

নিজেকে রক্ষা করতে হলে, ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে হলে, এখনই শুরু করতে হবে সচেতনতার পথচলা। এখনই গর্জে উঠতে হবে এই নীরব হত্যার বিরুদ্ধে। না হলে, ভবিষ্যতের ইতিহাসে আমরা এক নির্মম পরিচয়ে চিহ্নিত হব। তখন মানুষ বলবে, ‘তারা জানত, কিন্তু কিছুই করেনি!’

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

বিজ্ঞাপন

‘চিঠি দিও’
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:৩২

খুলনায় যুবদল নেতাকে কুপিয়ে জখম
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:২৫

আরো

সম্পর্কিত খবর