বর্তমান সমাজে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ হয়ে গেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তামাকজাত পণ্যের সেবন বেশি করে। বাংলাদেশ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে নবম স্থানে আছে। তারা সেবন করার জন্য রাস্তার গলি, ফুটওভার ব্রিজ, বিভিন্ন পার্কে অবস্থান করে। এতে শুধু তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং জনসম্মুখে ধুমপান করাতে আশেপাশের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ যিনি ধূমপান করেন, তিনি পুরো ধোঁয়া সেবন করেন না। ধোঁয়া তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু পাশের মানুষ ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ জনসম্মুখে ধুমপান করে। সেখানে বিশ্বের প্রথম দেশ ভূটানে জনসম্মুখে ধুমপান নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশে প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোন ভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। কিন্তু বিজ্ঞাপন বা প্রচার ঠিকই করা হয় নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন মিউজিক ভিডিওতে। উল্লেখ্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা হয়েছে, কোন সিনেমার কাহিনীর প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক হলে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার দৃশ্য রয়েছে। এমন কোন সিনেমা প্রদর্শনকালে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে লিখিত সতর্কবাণী, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, পর্দায় প্রদর্শনপূর্বক তা প্রদর্শন করা যাবে।
বর্তমানে সব নাটক, সিনেমাতে লিখিত সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতি নাটক, সিনেমায় কেন তামাকজাত পণ্যের কাহিনি থাকবে? এখন তামাকজাত পণ্যের সেবনের দৃশ্য ছাড়া সিনেমা খুবই বিরল। একশন সিনেমায় দেখানো হয় সিগারেট সেবন করলে সে অনেক স্মার্ট। ফলে যুবসমাজ এমন সিনেমা দেখে প্রভাবিত হয় আর তামাকজাত পণ্য সেবন করে। সিনেমা নাকি সমাজ বদলে দেওয়ার জন্য কাহিনি অনুসারে নির্মাণ করা হয়। তাহলে ধূমপান, তামাকজাত পণ্যের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে কেন সিনেমা তৈরি হয় না?
সম্প্রতি এক সিনেমা দেখে এক যুবক সম্ভাব্য নাম নিশান তালুকদার দাবি করেন পরবর্তী চিত্রজগতের সুপারস্টার হবেন তিনি। তাই তিনি ৩০ মিনিটের শর্ট ওয়েব ফিল্ম তৈরি করেন। যা প্রচারিত হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবের TSB Vision চ্যানেলে। সেখানে সচারাচর সিনেমার মত ধূমপানের দৃশ্য দেখানো হয়েছে ২৩ ও ২৬ মিনিটে। সে সিনেমা দেখে প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু ধূমপানের দৃশ্য দেখানোর সময় কোনো লিখিত সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। সুতরাং এমন দৃশ্যের সিনেমা যুবসমাজ বদলে দিতে নয়, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।
এছাড়া আইনে বলা হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়ে প্রলুব্ধকরণের উদ্দেশ্যে কোন নমুনা, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে, জনসাধারণকে প্রদান বা প্রদানের প্রস্তাব করা যাবে না। কিন্তু ছোট চায়ের দোকানে, রাস্তার ধারে ফুটপাতে তামাকের বিভিন্ন স্টিকার, লিফলেট থাকে। যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের দোকানে এমন দৃশ্য পাওয়া যায়। ফলে আইন অমান্য করে তামাকজাত পণ্যের প্রচারণা চালাচ্ছে। আরো বলা হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে (point of sales) যে কোন উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তামাকজাত কোম্পানি ছোট ব্যানার বা লিফলেট দোকানে স্পনসর করে। সেখানে লেখা থাকে অমুক সিগারেট এখন আরো আকর্ষণীয়, প্রতি শলাকা এত দাম।
বিশ্বে আইনের প্রচলন হয়েছে অপরাধ দমন করার জন্য, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়। পৃথিবীতে কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। সুতরাং আইন থাকলে নয়, আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় আইন অর্থহীন। কোন ব্যক্তি এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করলে শাস্তি বৃদ্ধি পাবে৷ কিন্তু বাংলাদেশে তা যথাযথভাবে প্রয়োগ হয় না।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) অনুসারে, পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ। এই আইন লঙ্ঘন করলে প্রথমবার ৩০০ টাকা জরিমানা করা হয়। যদি কোনো ব্যক্তি একই অপরাধ বারবার করেন, তবে জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা সাধারণত ৩০০ টাকার দ্বিগুণ বা তার বেশি হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বাস, রিকশা, ফুটপাত, বাজারে অহরহ প্রকাশ্যে পাবলিক প্লেসে ধূমপান করে। এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়, অপরাধ দমনে ও আইন বাস্তবায়নে নিয়োজিত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও পাবলিক প্লেসে ধূমপান করেন।
তাই এখনই উত্তম সময় তামাকজাত পণ্য প্রতিরোধ করা। ফলে পরিবার থেকে সচেতনতা শুরু করতে হবে। কারণ একজন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবার। অনেক সময় শিশু তার বাবার দেখে সিগারেট সেবন করা শেখে। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রচারণা চালাতে হবে। যেমন বিভিন্ন পথনাটক, কমিউনিটি ক্যাম্পিং, যুবকদের জন্য কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা, মাদকের চোরাচালান বন্ধ করা যেতে পারে। তবে যুবকদের জন্য কাউন্সেলিং সেন্টার খুবই উপযোগী। কারণ বয়ঃসন্ধিকালে আবেগের বশবতী হয়ে অনেক ঝুকিপূর্ণ কাজ করে থাকে। কিন্ত তাদের যথাযথ কাউন্সেলিং করতে পারলে তামাকজাত পণ্যে আসক্ত হবে না। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা। কারণ আইনের শাসন ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়, যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে আছে তারাও তামাকজাত পণ্য সেবন করে। সুতরাং আমাদের উচিত তামাকজাত পণ্যের ভয়াবহতা মানুষের সামনে তুলে ধরে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। উল্লেখ্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এন্টি টোব্যাকো ক্লাব বিভিন্ন ক্যাম্পেইন, সেমিনার, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ইত্যাদি করছে।
লেখক: শিক্ষার্থী; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সদস্য; এন্টি টোব্যাকো ক্লাব