Friday 04 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প

উম্মে সালমা
৪ জুলাই ২০২৫ ১২:০৬

লোকশিল্প বলতে দেশি জিনিস দিয়ে দেশের মানুষের হাতে তৈরী শিল্পসম্মত দ্রব্য, ঐতিহ্যবাহী দেশী পণ্যকে বুঝায়। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ যারা উন্নত সমাজের কাঠামোর মধ্যে বিরাজমান করে কিন্তু ভৌগোলিক অথবা সাংস্কৃতিক কারণে শিল্পের উন্নত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাদের নির্মিত এ শিল্পকে লোকশিল্প রূপে ধরা হয়। আয়তন ও বৈচিত্র্যের তুলনায় বাংলাদেশের লোকশিল্পের ভান্ডার অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে লোকশিল্পের অবস্থান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।

লোকশিল্পীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের অতি সাধারণ ও সুলভ উপকরণ দিয়ে কারুকার্য নয়নাভিরাম শিল্পদ্রব্য তৈরি করে। বাংলাদেশে ধর্ম, জীবিকা ও আনন্দবিধান এ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মিত বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকশিল্পের এক বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। লোকশিল্প বিভিন্ন ধরনের রয়েছে। যেমন: মৃৎশিল্প, তাঁতশিল্প, নকশি কাঁথা, আলপনা, পোড়ামাটির ফলকচিত্র ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

এখানে নকশিকাঁথার কথা না বললেই নয়।নকশিকাঁথার শিল্পীরা হচ্ছে ঘরের সাধারণ নারীরা, তাদের আলাদা কোনো পরিচয় নেই। আমরা সবাই নকশিকাঁথা পছন্দ করি। যুগ যুগ ধরে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে নকশিকাঁথা। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা এখন স্থান করে নিয়েছে বিশ্বের দরবারে। নকশিকাঁথা আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য। এ দেশের কারুশিল্পীদের নিপুণ হাতের অনবদ্য সৃষ্টি। সেই আদিকাল থেকে আজ অবধি নকশিকাঁথার আবদার একটুও কমেনি। বরং নকশিকাঁথার চাহিদা আরও বেড়েছে। নকশিকাঁথা হলো সাধারণ কাঁথার ওপর নানা ধরনের নকশা করে বানানো বিশেষ প্রকারের কাঁথা।

নকশিকাঁথা বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ। সাধারণত পুরাতন কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতিদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়। ঘরের মেঝেতে পা ফেলে পায়ের আঙুলের সঙ্গে কাপড়ের পাড় আটকিয়ে সুতা খোলা হয়। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নকশিকাঁথা।

বিভিন্ন গ্রামে মানুষ আছেন যারা নিজের ভাবনাকে মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়ে নানা ধরনের খেলনা ও সাজ-সরঞ্জাম তৈরি করে থাকেন। কাঠ, কাপড়, মাটি, সুতা, শঙ্খ, বাঁশ, বেত ইত্যাদি দিয়ে নানা ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়। সোনা, রুপা, পিতল, হাতির দাঁত প্রভৃতি উপকরণও ব্যবহার করা হয়।

লোকশিল্প সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের দায়িত্ব আমাদের, কারণ সুপরিকল্পিত উপায়ে, প্রসারের দিকে মনোযোগ দিলে এসব পণ্যদ্রব্যই হয়ে উঠতে পারে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনের মোক্ষম হাতিয়ার। বিদেশিদের কাছে আমাদের ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে রপ্তানির মাধ্যমে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। এ কারণেই লোকশিল্প সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের দায়িত্ব সকলেরই।

পৃথিবীর প্রাচীন অনেক সভ্যতার নিদর্শনে আমরা মৃৎশিল্পের ব্যবহার দেখতে পাই। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকশিল্পের ইতিহাসও দীর্ঘসময়ের। মৌর্য, গুপ্ত, সেন, পাল আমলে আমাদের ছিল গর্ব করার মতো লোকশিল্প। এই শিল্পের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতেন অনেকে। পরিবেশবান্ধব লোকশিল্পের পণ্য দামে সস্তা আর সৌন্দর্যবর্ধক ছিল। দুঃখজনকভাবে সেই চিত্র এখন আর দেখা যায় না।

শীতকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ধরনের মেলা। এসব মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে মাটির কলসি, ঢাকনা, ছোট-বড় তাগার, হুক্কা, বিভিন্ন রকম পুতুল, গার্হস্থ্য দ্রব্যাদি, মাটির ভাস্কর্য, শখের হাঁড়ি, ফুলদানি ইত্যাদি। বাংলাদেশের লোকশিল্পের শিল্পীরা অনেকটাই সহজাত প্রকৃতির। মানুষের যাপিত জীবন, প্রকৃতি থেকে তারা সংগ্রহ করেন তাদের শিল্পের ধারণা। সেই ধারণা ও কল্পনাশক্তি থেকেই তৈরি হয় এসব লোকশিল্প।

বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির এই যুগে লোকশিল্প অনেকটাই বিলুপ্তির পথে—এটা নিতান্ত দুঃখজনক। কালের বিবর্তনে লোকশিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। মানুষ এখন ঝুঁকে পড়েছে এর বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের দিকে। ফলে হস্তশিল্পের চাহিদা তো কমে গেছেই, পাশাপাশি লোকশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই হয়েছেন বেকার। অতীতে বাংলাদেশের লোকশিল্পের ছিল বিপুল চাহিদা। বর্তমান সময়েও এসব লোকশিল্পের রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। বর্তমানে নানাবিধ লোকশিল্পের পণ্যসম্ভার বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে এবং সেগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। কিন্তু তা আশানুরূপ নয়। অথচ উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লোকশিল্প থেকে আমরা আশানুরূপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লোকশিল্পে যোগ হবে নতুন মাত্রা।

লোকশিল্পের কিছু সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে লোকশিল্পীদের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের জন্য যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা জরুরি। লোকশিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল যেমন—বাঁশ, বেত ইত্যাদি চাষে সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।লোকশিল্প গবেষণা ও উন্নয়নে আধুনিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এভাবেই গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প আবারও তার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। এতে করে প্রতি বছর চাকরির বাজারে যে সংকট দেখা যায়, তা কমবে অনেকটাই। লোকশিল্পের যথাযথ প্রসারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার দখলের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। লোকশিল্প বিশ্বের বুকে আবারও উজ্জ্বল করবে বাংলাদেশের মুখ।

লেখক: শিক্ষার্থী; চট্টগ্রাম কলেজ, সদস্য; বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

সারাবাংলা/এএসজি

উম্মে সালমা বাংলাদেশের লোকশিল্প মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

সবজির বাজার চড়া
৪ জুলাই ২০২৫ ১৬:৩০

আরো

সম্পর্কিত খবর