বৈদেশিক সাহায্য এখন আর শুধু মানবিক বিষয় নয়। গাজার দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এটি এক ভয়ংকর অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল চায়, ফিলিস্তিনিরা অনাহারে ভেঙে পড়ুক। তারা যেন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এটি সাম্রাজ্যবাদী কৌশলেরই পুরনো ধারাবাহিকতা। ছয় সপ্তাহ ধরে কোনো সাহায্য না পাওয়া গাজার মানুষকে খাবারের আশ্বাস দিয়ে গুলি করে মারা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে গঠিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) ত্রাণের নামে ফাঁদ পেতেছিল। অনাহারে মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ‘ভিক্ষার টোকেন’। পরে ওই মানুষগুলোকেই গুলি করে হত্যা করা হয়।
এই ভয়াবহ প্রতারণার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। অথচ পশ্চিমা শক্তিগুলোর অবস্থান এখনো দ্বিচারিতায় ভরা। ব্রিটিশ সরকার বলছে, ‘মানবিক সাহায্য কখনোই রাজনৈতিক হাতিয়ার বা সামরিক কৌশল হতে পারে না।’ অথচ বাস্তবে তারা দেড় বছর ধরে ফিলিস্তিনে কোনো সহায়তা পাঠায়নি। তাদের অজুহাত—এই সহায়তা হামাসের হাতে যেতে পারে। অথচ এটিই দেখায়—ফিলিস্তিনি জনগণের জীবন নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এই অবস্থায় ব্রিটেনসহ অনেক পশ্চিমা দেশের মন্ত্রীরা গণআন্দোলনের চাপে লজ্জিত ও বিব্রত। কেউ কেউ অবস্থান বদলাতেও বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিতে কোনো বদল নেই। ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যা আকস্মিক কিছু নয়। এটি এক দীর্ঘ সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের অংশ। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে মানবিক সাহায্যের ব্যবহার নতুন নয়, গাজার ঘটনাগুলো ওই ধারাকেই টেনে এনেছে সামনে।
গাজার জন্য এখন জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু ইতিহাস বলে, এমন সহায়তা নিছক মানবিক নয়। বরং তা রাজনৈতিক শর্ত, সামরিক চক্রান্ত ও কূটনৈতিক চাপে মোড়ানো থাকে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যে বহুবার দেখা গেছে, সহায়তার আড়ালে কীভাবে দখলদারি কাঠামো শক্তিশালী করা হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ‘সহায়তা’ দিয়ে ভিক্ষুক বানিয়ে রাখা হয়। অথচ এই দরিদ্রতা ও দুর্যোগের উৎসই হলো ওই সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাগুলো, যেগুলো নিজেই সহায়তা দেয়।
একই কৌশল দেখা যায়, ১৯৪৩-৪৪ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষে লাখো মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। এটি ছিল প্রতিরোধযোগ্য মানবিক বিপর্যয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুনাফালোভী ও বর্ণবাদী নীতিই এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘ভারতীয়রা বিশ্বের সবচেয়ে পশুর মানুষ’ এবং হিন্দুরা ‘একটি জঘন্য জাতি’। দুর্ভিক্ষ চলাকালে ব্রিটিশরা বাংলার কৃষিজাত খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চাল ও গম, হাজার হাজার টন বিদেশে রপ্তানি করে। এই খাদ্য মজুদ রাখলে লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করা যেত। ভারতের ভাইসরয় ফিল্ড মার্শাল ওয়াভেল বারবার সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু চার্চিল তা প্রত্যাখ্যান করেন। দুর্ভিক্ষের সময়ও চাল বিদেশে পাঠাতে একটি জাহাজও থামানো হয়নি। এই দুর্ভিক্ষে ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ মারা যায় অনাহার, রোগ ও হতাশায়। এটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অপরাধের এক ভয়াবহ উদাহরণ।
চার্চিলের এই নিষ্ঠুরতা নতুন কিছু ছিল না। এক শতাব্দী আগে ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন আয়ারল্যান্ড ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ব্রিটিশরা আয়ারল্যান্ড থেকে নিয়মিত শস্য পাঠাতো ইংল্যান্ডে। ‘শস্যের দামে মুনাফা মানুষের প্রাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’ এই নীতির কারণে ১ কোটি আইরিশ জনগণ অনাহারের ঝুঁকিতে পড়ে। মারা যায় অন্তত ১০ লাখ মানুষ। দেশ ছাড়ে আরও ২০ লাখ। এই অনাহার ছিল এক প্রকার পরিকল্পিত গণহত্যা।
১৯৬২ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছিল, ‘সাহায্য হলো বৈদেশিক নীতির একটি অস্ত্র।’ ব্রিটেন তখন তার পুরনো উপনিবেশগুলোর ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে এই ‘সহায়তা’কেই ব্যবহার করে। উদ্দেশ্য ছিল দুটি—একদিকে সস্তা খাদ্য ও কাঁচামাল নিশ্চিত করা, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণে প্রভাব খাটানো।
পূর্বতন ঔপনিবেশিক শক্তির মতো আধুনিক সাম্রাজ্যবাদও সাহায্যকে প্রভাব বিস্তারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হলো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া ও ইসরায়েল পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র মিশরকে নিজের প্রভাবে আনার কৌশল নেয়।
যুদ্ধাপরাধী হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রক্রিয়ায়’ অংশ নেওয়ার পুরস্কার হিসেবে মিশর ব্যাপক পরিমাণ সাহায্য পায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মিশর যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাহায্যপ্রাপ্ত দেশ হয়ে ওঠে। এই সাহায্যের পেছনে ছিল এক নির্লজ্জ উদ্দেশ্য—মিশর যেন আর ইসরায়েলের বিরোধিতা না করে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে নীরব থাকা, ইসরায়েলের আগ্রাসন মেনে নেওয়া—এগুলোই ছিল সাহায্যের মূল শর্ত। একদিকে মিশর ‘যুক্তিসঙ্গত’ মিত্র হয়ে ওঠে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার করে। এই প্রক্রিয়ায় গাজা, পশ্চিমতীর ও ফিলিস্তিনজুড়ে দখলদারি চলে অব্যাহতভাবে।
অফ্রিকায় ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষের সময় একই কৌশল দেখা গেছে। ১৯৮৩-৮৫ সালের দুর্ভিক্ষে লাখো মানুষ মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র কোনো তৎপরতা দেখায়নি। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান বলেছিলেন, ‘অনাহারের কারণে খাদ্য পাঠানো দুর্বলতার পরিচায়ক।’ তাঁর এক উপদেষ্টা বলেন, ‘খাদ্য সহায়তার উদ্দেশ্য ক্ষুধা দূরীকরণ নয়।’ এ কারণেই দুর্ভিক্ষের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সহায়তা দেয়নি। ১৯৮৪ সালে বাধ্য হয়ে তারা ত্রাণ পাঠায়, তবে সেটিও রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়েছিল।
রিগ্যান প্রশাসন চেয়েছিল মেঙ্গিস্তু সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করে সোভিয়েত মডেলকে হেয় করতে। তখন ত্রাণ হয়ে ওঠে ঘৃণা ছড়ানো ও প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার। পাশাপাশিই ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষ ‘লাইভ এইড’ এর মতো উদ্যোগে কোটি কোটি টাকা দান করেছিল। অনেকেই বলেছিল শুধু ত্রাণ নয়, দরকার কাঠামোগত পরিবর্তন। দারিদ্র্য ও সাহায্য-নির্ভরতাকে চিরস্থায়ী না করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রয়োজন।
আরেকটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত—ইরাকের ‘তেল-খাদ্য কর্মসূচি’। ১৯৯০-এর দশকে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে চালু হয় এ কর্মসূচি। বলা হয়েছিল, তেল বিক্রি করে খাদ্য ও ওষুধ কিনবে ইরাক। বাস্তবে এটি ছিল ইরাকের তেল লুটের বৈধ পন্থা। ৫০ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের তেলের আয়ের মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ গিয়েছিল জনগণের জন্য। বাকিটা চলে যায় করপোরেট ও কর্মকর্তাদের পকেটে। এক সময় জাতিসংঘের কর্মকর্তা জানান, এই দুর্নীতির প্রমাণপত্রও গায়েব করা হয়। আর এই কর্মসূচির কারণে ৫ লাখ শিশু মারা যায় অনাহারে ও ওষুধের অভাবে। যখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অলব্রাইটকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই মৃত্যুর মূল্য কি ‘যোগ্য’? তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, মূল্যটি তার উপযুক্ত।’ এটি ছিল মানবিকতার মুখোশের নিচে এক নির্মম স্বীকারোক্তি।
এই মানবিকতার মুখোশ পরে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ তার দখলদারি চালিয়ে যায়। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে এই ‘সহায়তা রাজনীতি’ চলে নতুনরূপে। ১৯৮৩ সালে তিউনিসিয়ায় রুটির দাম বাড়িয়ে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করা হয়। শুরু হয় ‘রুটি দাঙ্গা’। এরপর ভেনেজুয়েলা, ঘানা, মিশরসহ বহু দেশে এই শর্তের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে বিক্ষোভ। ১৯৯২ সালের মধ্যে অন্তত ৩৯টি দেশে ১৪৬টি ‘আইএমএফ দাঙ্গা’ হয়।
সহায়তা নয়, এসব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। আজও এই দখলদার শক্তিগুলো ‘সহায়তা’কে একদিকে পুরস্কার, অন্যদিকে শাস্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যারা শাসকদের পছন্দের নীতি অনুসরণ করে, তারা সাহায্য পায়। আর যারা ভিন্নমত পোষণ করে, তারা বঞ্চিত হয়। ফিলিস্তিনের চিকিৎসকরা বলেন—‘আমাদের খাদ্য নয়, দরকার স্বাধীনতা।’
আজকের বাস্তবতায় সাহায্যকে ‘মানবিক’ বলা যায় না। এটি এক নির্মম রাজনৈতিক অস্ত্র। যখন গাজায় ক্ষুধার্ত শিশুকে হত্যা করা হয়, ইরাকে শিশুদের অনাহারে মারা যেতে দেওয়া হয়, তখন বোঝা যায়—সাহায্য নয়, এটি এক পরিকল্পিত সহিংসতা। এই সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করাটাই আজকের প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রাম।
এই সংগ্রাম শুধু খাবার কিংবা অর্থের জন্য নয়। এটি আত্মমর্যাদা, অধিকার ও শোষণের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক লড়াই। যারা এই লড়াইয়ে শামিল, তারাই সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ ছিঁড়ে দিতে পারে। কারণ তারা জানে, সাহায্য নয়—স্বাধীনতাই মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক