আদিমকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে আমাদের সামনে। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের যত অগ্রগতি হচ্ছে দিনে দিনে মানবসমাজ ততোই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহারই পারে আমাদের একটি সুন্দর আগামীর বিশ্ব উপহার দিতে। প্রযুক্তির ধ্বংস মানুষের ব্যবহার এবং পরিচালনার উপর নির্ভর করে। এটি কখনোই নিজেকে নিজে ধ্বংস করতে পারে না। মানুষ যখন নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে এর অপব্যবহার শুরু করে পরিবেশের ক্ষতি করে তখনই প্রযুক্তি বিপজ্জনক হয়ে উঠে। উদাহরণস্বরূপ পারমাণবিক অস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার, সাইবার হামলা সমস্যাগুলো প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। আলবার্ট আইনস্টাইন বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন “আমি জানি না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কী অস্ত্র দিয়ে হবে, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাঠি ও পাথর দিয়ে।” আইনস্টাইনের এই উক্তিটি কেবল একটি ভবিষ্যৎবাণী নয়, বরং পারমাণবিক যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এবং যুদ্ধের পর মানব সমাজের সম্ভাব্য অবনতির বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গভীর উপলব্ধি। এর মাধ্যমে তিনি পারমাণবিক যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এবং এর পরবর্তী সম্ভাব্য অবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন। যা যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সভ্যতার সম্ভাব্য পতনের ইঙ্গিত দেয়। তিনি মনে করতেন, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর মানুষ হয়তো আবার আদিম যুগের মত পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে পারে। যেখানে লাঠি ও পাথরই হবে তাদের প্রধান অস্ত্র।
বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি ধ্বংস হয়ে গেলে মানব সভ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলশ্রুতিতে আধুনিক জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাপী এর সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, পরিবহন, এবং অর্থনীতি সহ জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে সঠিক নিয়ন্ত্রণ, সুশিক্ষা, এবং নৈতিক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রযুক্তিকে মানবজাতির উন্নতির জন্য কাজে লাগানো সম্ভব। প্রযুক্তিকে ধ্বংস না করে বরং এর সদ্ব্যবহার দ্বারা মানবজীবনকে আরও উন্নত এবং সহজ করা সম্ভব। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। এদিকে বিশ্ব পারমাণবিক যুদ্ধের মুখোমুখি হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় তবে শহর, শিল্প এবং বিজ্ঞান গবেষণাগার সহ ব্যাপক এলাকা ধ্বংস হয়ে যাবে। এর ফলে মানব সভ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়াও যুদ্ধের কারণে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হবে। অপরদিকে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিলম্ব হবে অথবা সম্ভাবনা থাকবে না। এছাড়াও যুদ্ধের কারণে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষ জনবল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার ফলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে । তৃতীয় হলে বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য, সুপেয় পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দেখা দেবে। ফলশ্রুতিতে জীবনযাত্রার মান আরও খারাপ হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কমে যাওয়ায় রোগের প্রাদুর্ভাবও বাড়তে থাকবে। বিশেষ করে গবেষণার ক্ষেত্রে মারাত্ম ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।
যুদ্ধ বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজে বাধা সৃষ্টি করবে। যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে দুর্বল করে দেবে। যুদ্ধের কারণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, জনবল এবং সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে। যার ফলে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং উন্নয়ন থমকে যাবে। যুদ্ধের কারণে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হবে। পারমাণবিক অস্ত্রের তেজস্ক্রিয়তা এবং রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে পরিবেশের উপর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এর ফলে তথ্য আদান-প্রদান এবং গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। মোটকথা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য একটি বিপর্যয় ডেকে আনবে। এই যুদ্ধ মানবতাকে কয়েক দশক বা তারও বেশি সময়ের জন্য পিছিয়ে দিতে পারে।
এদিকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতে রণক্ষেত্রের বাইরেও শুরু হয়েছিল আরেকটি যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ হচ্ছে তথ্যযুদ্ধ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে বানানো ভুয়া ভিডিও, ভিডিও গেমের ফুটেজকে বাস্তব লড়াই হিসেবে প্রচার এবং চ্যাটবট থেকে ছড়ানো মিথ্যা তথ্য ইত্যাদি এসব প্রযুক্তিনির্ভর বিভ্রান্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য-মিথ্যার সীমা ভেঙে ফেলেছে। যুদ্ধের সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহার ঘটবে। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ করার জন্য এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরি এবং সেগুলো ব্যবহারের ফলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটবে । তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে এক বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে। যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী এবং ধ্বংসাত্মক। এর ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা কমে যাবে।
লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়