Sunday 06 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উত্তরাঞ্চল উন্নয়ন সংলাপ: দারিদ্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

সুদীপ্ত শামীম
৫ জুলাই ২০২৫ ১৯:১১

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষত রংপুর বিভাগ, একদিকে দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্যভাণ্ডার, অন্যদিকে দারিদ্র্যের সবচেয়ে গভীর রেখাচিত্র। এখানকার কৃষকেরা যেমন দিনের পর দিন মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে ফসল ফলান, তেমনি প্রতিদিন লড়াই করেন অনাহার, বৈষম্য আর অবহেলার বিরুদ্ধে। কিন্তু এই কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের পরও তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান কিংবা সুযোগটুকু পান না। তাদের জীবনের হিসাব-নিকাশ যেন শোষণ আর অবজ্ঞার অঙ্কেই বাঁধা পড়ে আছে।

এই জনপদের মানুষেরা স্বপ্ন দেখে মাঠে, ঘাম ঝরায় খেতে, আর ফলায় দেশের খাদ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য—ফসল ফলানোর গৌরব তাদের থাকলেও সেই ফসলের লাভ ঘরে ওঠে না। দাম পড়ে যায় মাঠেই, ন্যায্যমূল্য পান না, আর বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। বছরের পর বছর এই বৈষম্যমূলক চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে এক শ্রেণির মানুষ বেঁচে থাকেন নিছক প্রয়োজনের জন্য, অথচ তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।

বিজ্ঞাপন

শুকনো পরিসংখ্যানের পেছনে হাহাকার

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২৩ সালের তথ্য আরও করুণ বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায় আমাদের। দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত ১০টি জেলার মধ্যে ৭টি অবস্থিত রংপুর বিভাগে। দারিদ্র্যের হার কুড়িগ্রামে ৫৯ শতাংশ, গাইবান্ধায় ৫২, লালমনিরহাটে ৪৭, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪৫ শতাংশ—এগুলো কেবল সংখ্যাই নয়, হাজারো পরিবারের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। যেখানে জাতীয় গড় দারিদ্র্যের হার মাত্র ১৮ শতাংশের নিচে, সেখানে রংপুর বিভাগের এমন চিত্র একটি নির্মম বৈষম্য আর রাষ্ট্রীয় অবহেলার পরিষ্কার প্রমাণ।

অথচ এই জেলারাই প্রতি বছর দেশের সবচেয়ে বেশি খাদ্যশস্য, শাকসবজি ও কৃষিপণ্য উৎপাদন করে। কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, লালমনিরহাট—এসব জেলায় ধান, ভুট্টা, গম, পাট, আলু, পেঁয়াজ, মরিচ—সবই ফলে ব্যাপক হারে। শুধু আলু উৎপাদনেই উত্তরাঞ্চল শীর্ষে, যা দেশের মোট উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি। কিন্তু সে উৎপাদনের সুফল কি কৃষকের ঘরে পৌঁছে? উত্তর—না। বরং উল্টো ফসল ঘরে তুলেই তারা হতাশায় ডুবে যান: ‘এত খেটে লাভ কী?’

এই বৈপরীত্য— ‘অর্জন আছে, কিন্তু অধিকার নেই’—এটাই রংপুর অঞ্চলের বাস্তবতা। এই অঞ্চলের কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে জমা হয়েছে শোষণ, বঞ্চনা ও ন্যায্যতার অভাব।

কৃষিপ্রধান কিন্তু কৃষক-বঞ্চিত

রংপুর অঞ্চল দেশের অন্যতম কৃষিনির্ভর এলাকা। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ধান, আলু, পাট, ভুট্টা, গম, সরিষা, পেঁয়াজসহ নানা কৃষিপণ্যের উৎপাদনে শীর্ষেও থাকলেও কৃষকেরা বছরের পর বছর বঞ্চনার শিকার। ফসল ফলানোর পরও তারা ন্যায্যমূল্য পান না, বরং লাভের বড় অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগী, দালাল ও আড়তদারদের পকেটে।

মৌসুমে কৃষক মাঠে ঘাম ঝরিয়ে ফসল তোলেন, কিন্তু বাজারে দাম পড়ে এত নিচে যে উৎপাদন খরচই ওঠে না। সেচ, সার, বীজ, কীটনাশক, জমি প্রস্তুত, শ্রমিক খরচ মিলিয়ে ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। ডিজেলনির্ভর সেচ ব্যবস্থার কারণে জ্বালানির দামের ওপর কৃষকের খরচ নির্ভর করে, স্থিতিশীলতা নেই। সরকারি গুদামে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার কাঠামো গড়ে ওঠেনি। ফলে কৃষক বাধ্য হন দালালদের হাতে তার পরিশ্রমের ফসল তুলে দিতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়মিত বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, খরার মতো সংকট প্রায়ই ক্ষতি ডেকে আনে। কৃষি বিমা নেই, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা দুর্বল, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ অপ্রতুল—সব মিলিয়ে কৃষি এখন জুয়ার মতো।

‘মঙ্গা’র ভূত এখনো জীবিত

এক সময় রংপুর অঞ্চলের নাম শুনলেই উচ্চারিত হতো ‘মঙ্গা’ শব্দটি। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী—মঙ্গা এখন অতীত। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এর রূপ বদলেছে ঠিকই, তবে অস্তিত্ব এখনও আছে। এখন বলা হয়—‘ঋতুভিত্তিক খাদ্য নিরাপত্তার সংকট’। কিন্তু সংকটের গভীরতা, পরিণতি এবং কষ্ট—সবই প্রায় একই।

কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে যখন ফসল ঘরে ওঠেনি, আর নতুন চাষ শুরু হয়নি—এই ফাঁকে দিনমজুরেরা হয়ে পড়েন কর্মহীন, কৃষকের আয় বন্ধ হয়ে যায়। এই মৌসুমে খাবার কমে, আয়হীনতা বাড়ে, ঋণ বেড়ে যায়। পরিবারগুলো হয় অনাহারে, নয়তো ধার-দেনায় জীবন চালায়। শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে, অনেকেই স্কুল ছাড়ে।

চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত গ্রামে এই সংকট আরও তীব্র। সরকারি সহায়তা কর্মসূচি যেমন—ভিজিএফ, ১০ টাকা কেজি চাল—এসব থাকলেও তা সময়মতো পৌঁছায় না, কিংবা প্রকৃত দরিদ্রের হাতে যায় না। ফলে বাস্তবে দেখা যায়, মঙ্গা হয়তো শিরোনাম থেকে হারিয়ে গেছে, কিন্তু রংপুর অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের পাতে এখনো অনুপস্থিত নিরাপদ খাবার, আয় আর আশ্বাস।

খাদ্যনিরাপত্তা: সংখ্যায় পূর্ণ, বাস্তবে শূন্য

রংপুর বিভাগ দেশের প্রধান খাদ্য উৎপাদন কেন্দ্র হলেও এখানে বসবাসকারী অনেক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এখনও সংকটাপন্ন। বিশেষ করে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল, গাইবান্ধার নদীভাঙনপীড়িত এলাকা ও লালমনিরহাটের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের অভাব ব্যাপক। এই এলাকাগুলোর শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার অনেক বেশি, আর তাদের পরিবারগুলো প্রায়ই এক বেলা খাবারের জন্যও সংগ্রাম করে।

বর্ষাকালে বন্যার কারণে এসব এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট ডুবে গেলে সরকারি ত্রাণ কিংবা জরুরি খাদ্যসামগ্রী প্রয়োজনমতো পৌঁছায় না। এর ফলে খাদ্যসংকট আরও প্রকট হয়। এছাড়া, শুকনো মৌসুমে বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়, যা সরাসরি খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলে এবং জনস্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি পরিসংখ্যানে খাদ্য মজুদ যথেষ্ট বলে দেখালেও, বাস্তবে এসব প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ খাদ্য থেকে বঞ্চিত। তারা এখনও খাদ্য সংকট, অপুষ্টি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। খাদ্য নিরাপত্তার এই দ্বৈততার কারণে রংপুর বিভাগের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বড় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।

খাদ্য নিরাপত্তার সংকট ও সম্ভাবনাময় সমাধান

রংপুর অঞ্চলের খাদ্য সংকটের পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় গুদাম ও হিমাগার গড়ে উঠেনি। ফলে ফসল পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে নানা ধরনের ভুল এবং ব্যর্থতা রয়েছে, যা তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে চরাঞ্চলে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকট, যেখানে ত্রাণ বা খাদ্য সাহায্য সময়মতো পৌঁছায় না। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতেও দুর্নীতি এবং বৈষম্যের কারণে সুবিধাভোগী হয় কম সংখ্যক মানুষ।

সমস্যাগুলোর সমাধানে প্রয়োজন প্রতিটি উপজেলায় আধুনিক গুদাম ও হিমাগার স্থাপন। সেচে ডিজেলের পরিবর্তে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে খরচ কমানো যেতে পারে। কৃষকদের জন্য ডিজিটাল মাধ্যমে সরাসরি পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে দালালদের ওপর নির্ভরতা কমে। খাদ্য নিরাপত্তায় অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা উচিত। চরাঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ ইউনিট গড়ে তোলা জরুরি। সবশেষে, উৎপাদন খরচ বিবেচনা করে ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের কার্যকর নীতিমালা হাতে নিতে হবে, যা কৃষকের মুনাফা নিশ্চিত করবে।

উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য: জাতীয় চ্যালেঞ্জ

উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি মূলত রাজনৈতিক অবহেলা এবং দীর্ঘদিনের নীতিগত ব্যর্থতার ফলাফল। একদিকে এই অঞ্চল দেশের খাদ্য উৎপাদনের শীর্ষস্থান ধরে রাখলেও অন্যদিকে এখানকার মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন—এই বৈপরীত্য শুধু লজ্জাজনকই নয়, বরং দেশের রাষ্ট্রীয় বিবেকের এক দৃষ্টান্তহীন ব্যর্থতা। খাদ্যের উৎপাদন এবং মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে এমন বিশাল ফাঁক সৃষ্টি হওয়া মানে আমাদের উন্নয়নের ধারাটাই ভুল পথে চলে গেছে।

যদি আমরা সত্যিই একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে চাই, তাহলে শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন নয়, বরং স্মার্ট কৃষি এবং ন্যায্য খাদ্যনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দেশের সব মানুষ উন্নত জীবনযাপন করতে পারেন। আর এই পরিবর্তনের শুরু হোক উত্তরাঞ্চলের প্রতি রাষ্ট্রীয় মনোভাব ও নীতির মূলগত পরিবর্তন থেকে—সেই সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা ও স্থায়ী সমাধান নেওয়ার মাধ্যমে। তখনই এই জনপদের মানুষ তাদের অধিকার, উন্নয়ন ও স্বপ্নের পূর্ণতা পাবে।

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

উত্তরাঞ্চল উন্নয়ন সংলাপ খাদ্যনিরাপত্তার সংকট দারিদ্র্য মুক্তমত সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর