২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হতে যাচ্ছে আগামীকাল। স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়ার একটা অনুভূতি কাজ করছে। কারো জিপিএ-৫ পাওয়ার চাপ, আবার কারো শুধু পাস করলেই চলে। অনেক শিক্ষার্থী ভাবছেন, মা-বাবার মানসম্মান রক্ষা হবে তো? কারো মনে চিন্তা, অমুকের থেকে ভালো গ্রেড পয়েন্ট না পেলে জীবনটাই বৃথা! সবমিলিয়ে প্রায় ১৯ লাখ শিক্ষার্থী ফলাফল পাওয়ার অপেক্ষায়। শুধু শিক্ষার্থী বললে ভুল হবে তাদের মা-বাবা, পরিবার-পরিজন জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় সন্তানদের সুখের মুহূর্ত দেখার অপেক্ষায়!
গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সন্ধ্যার মধ্যে ৯ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। কারণ আর কিছুই নয়, পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেনি তারা। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে আরও কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী! অনেক আত্মহত্যার খবর পত্রিকায় আসে না! এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ও হৃদয়বিদারক ঘটনা প্রতিবছর ঘটছে। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর দেখা যায় সবাই কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র কিংবা অভিভাবক কেউ থাকে না। একদিকে উল্লাস আরেক পাশে হতাশায় জর্জরিত হওয়া শিক্ষার্থীদের মন। পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশের পর একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর যত বেশি নীরব ও সংযতভাবে আনন্দ ফলাফল উপভোগ করার কথা অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি মাত্রায় উল্লাস করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের সাথে অনেক অভিভাবক এই মহাউল্লাসে ফেটে পড়েন! পাশাপাশি ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এসব কাণ্ডকারখানা দেখে যতটা না মেনে নেওয়ার কথা তার চেয়ে বেশিমাত্রায় হতাশা ও বিষন্নতায় ডুবে যান একজন অকৃতকার্য শিক্ষার্থী। অকৃতকার্য শিক্ষার্থী নিকটজনের কাছ থেকে কটূক্তি, গালমন্দ ও পাশে না থাকার মতো চিত্র দেখতে পান। হতাশা ও গ্লানি ধারণ করে অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত বেছে নেয়! একজন শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার দায় কার? পরীক্ষায় ভালো ফলাফল শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। ঠিক একইভাবে চিন্তা করলে পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার দায় সম্মিলিতভাবে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের। আরও বৃহৎভাবে চিন্তা করলে পরিবার-পরিজন এমনকি সমাজও এর দায় এড়াতে পারে না। শুধু এককভাবে শিক্ষার্থীকে দোষারোপ করা বোকামির কাজ।
পরীক্ষায় ভালো ফলাফল মানেই যে সবকিছু তা কিন্তু নয়! পুরো জীবনের দীর্ঘযাত্রায় এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল এক বিন্দু সাফল্যের মতো। বিশাল জীবনকে শুধু একটি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে বিচার করা কতটা সমীচীন? চীনের বিখ্যাত সফল ব্যবসায়ী চ্যাক মা, প্রযুক্তি জগতের গুরু স্টিভ জবস, বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন, ভারতের প্রেসিডেন্ট ও অনুপ্রেরণাদানকারী ব্যক্তিত্ব এ পি জে আবদুল কালাম, মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন, ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল- এর মতো মহান ব্যক্তিরাও জীবনের শুরুতে একাধিক পরীক্ষায় খারাপ করেছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আবার ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ। ফলাফল প্রকাশের পরপরই অভিভাবক, পরিবার-পরিজন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নিজের ফলাফল দেখানোর প্রবণতা ও প্রচার চলে সবার মধ্যে। কিন্তু ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি যেন অন্যদের বা অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর কিংবা তার পরিবারের জন্য ব্যথার কারণ না হয় সেদিকে সদয় হওয়াও জরুরি। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া একজন শিক্ষার্থীর স্বাভাবিকভাবে একটু মন খারাপ হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার এই মন খারাপ কখনোই আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত পরিবার তার পাশে থাকবে। পরিবার ও শিক্ষকরা পাশে থাকলে কোনো অকৃতকার্য শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিবে না – এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
আত্মহত্যা থেকে রক্ষার উপায় _
প্রায় প্রতিবছরের এসএসসির ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মোটাদাগে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র একটা অকৃতকার্য শিক্ষার্থী হতাশায় ডুবে জীবন নিয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়! শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে সেসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে তা হলো-
১. পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর সন্তান অকৃতকার্য হলেই মা-বাবা, পরিজন সবাই মিলে সন্তানকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে। তার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে হবে। কেননা ফলাফল প্রকাশের পর প্রথম কয়েকটা দিন আত্মহত্যার ঝোঁক খুব বেশি থাকে।
২. অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে হবে।
৩. পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষণের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। কেননা অনেক সময় হিসাব-নিকাশে সামান্য ত্রুটির কারণে ফলাফল খারাপ আসতে পারে! অতঃপর কয়েক সপ্তাহ পর শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক মিলে পরীক্ষায় কেন আশানুরূপ ফলাফল করতে পারলো না তার হিসাব-নিকাশ করতে হবে।
৪. সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের প্রতি সমাজের সব স্তর থেকে সদয় ভাব দেখাতে হবে।
একজন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য মানেই সে মেধাবী নয়, এটা একেবারেই ভুল ধারণা। পড়ালেখায় মেধাবী হলেই যে সবকিছুতে ভালো এমনটি ভাবার কারণ নেই। মেধাবী হওয়ার মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল একটা ক্যাটাগরি মাত্র। কেউ পড়ালেখায় ভালো না হলেও গানে ভালো, কেউ খেলাধুলায় ভালো, কেউ নৃত্যে ভালো, কেউ আবৃত্তিতে ভালো, কেউ লেখালেখিতে ভালো, কেউ কৃষিকাজে ভালো, কেউ ব্যবস্থাপনায় ভালো, কারো মধ্যে বিজ্ঞানের নেশা রয়েছে, কেউ আঁকাআঁকিতে ভালো। সুতরাং মেধার অভাব নেই। সবাই কোনো না কোন দিক দিয়ে মেধাবী। সুতরাং প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবন মূল্যবান। মেধাকে লালন করতে পারলেই জীবন সুন্দর। শুধু পরীক্ষার ফলাফল সব নয়। প্রতিটি শিশু শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা সক্ষমতা রয়েছে। এই সক্ষমতা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বের করে আনতে পারলেই জীবন সুন্দর, জীবন স্বার্থক।
লেখক: জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী, সদস্য; বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)