Saturday 12 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লাশের রাজনীতি, খুনের স্বাভাবিকতা ও ‘ছত্রিশে জুলাই’র প্রত্যাশা

সুদীপ্ত শামীম
১২ জুলাই ২০২৫ ১৭:২০

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যেন এক শেষ না হওয়া লাশের মিছিলে পরিণত হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে মানুষ হত্যা এখন ‘নিয়মিত সংবাদ’-এর অংশ। প্রতিটি লাশ যেন পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দাবার এক একটি নিঃসংগ ঘুঁটিতে, যার মূল্য শুধু তখনই গণনা করা হয়, যখন সেটি দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর একটি এলাকায় একজন ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করার ভয়াবহ ঘটনায় জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ‘যুবদল’-এর স্থানীয় নেতার নাম উঠে এসেছে। চাঁদা না দেওয়ার অভিযোগে, দিনের আলোয়, জনসমক্ষে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যারা দম্ভের সঙ্গে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, তারা কেবল আইনের ব্যর্থতা নয়, একটি রাজনৈতিক দানবের অদৃশ্য আশ্রয়ে লালিত হচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ড নিছক একটি ফৌজদারি অপরাধ নয়, এটি গোটা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির মুখে এক করুণ করাঘাত। যেখানে নীতি নয়, আদর্শ নয়—রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে দখল, চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা এবং দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার। এই হিংস্র, নিষ্ঠুর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আজ প্রশ্ন উঠে, রাজনীতি কি এখন কেবলই ক্ষমতার জন্য ‘রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতা’? জনগণের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা কি একেবারে নির্বাসনে গেছে?

বিজ্ঞাপন

একটি ভিডিও না এলে কিছুই জানতাম না!

এই সময়ের বাংলাদেশে কোনো ঘটনা আলোড়ন তোলে না, যতক্ষণ না তার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে! সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও তার জ্বলন্ত প্রমাণ। যুবদল নেতার নেতৃত্বে একজন ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যার বিষয়টি গতকাল যুগান্তর-এর প্রতিবেদনে উঠে এলেও সেটি ছিল কেবল একটি রাজনৈতিক খবর মাত্র। কিন্তু আজ, এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া, তার মূল সূত্র একটিই; ভাইরাল হওয়া ভিডিও। সেই ভিডিও না এলে হয়তো এটিও ‘অন্তর্দ্বন্দ্বে নিহত একজন’ কিংবা ‘সংঘর্ষে প্রাণহানি’ জাতীয় ঠাণ্ডা খবরে পরিণত হতো। আর বিচার? হতো কি আদৌ? নাকি রাজনৈতিক পরিচয়ের জোরে ধামাচাপা পড়ে যেত?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরেকটি বড় প্রশ্ন সামনে আসে, আমরা কি এখন এমন একটি রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে হত্যার বিচার পেতে হলে আগে ভিডিও ছড়িয়ে দিতে হয়? আইন, তদন্ত, সাক্ষ্য, বিচার—এসব কি এখন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা? একটি অপরাধ বিচারযোগ্য হবে কি না, সেটা কি নির্ধারিত হচ্ছে ভিডিওর ভিউ-সংখ্যা দিয়ে? যদি তাই হয়, তাহলে তো ভবিষ্যতে প্রত্যেক নাগরিককে নিজেকে রক্ষা করতে হাতে রাখতে হবে ক্যামেরা, আইন নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় নয়, ভিডিও এডিটর। বিচারপতি নয়, ফেসবুক অ্যালগরিদম! এই বাস্তবতাই আমাদের বিচারব্যবস্থার ভয়াবহ ভঙ্গুরতা আর রাজনৈতিক প্রভাবাধীন দুর্বলতার নগ্ন উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে দোষীর রাজনৈতিক পরিচয়ই সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ, সেখানে আইন কেবল ‘প্রতীকী ন্যায়বিচার’-এর একটি যন্ত্রণা হয়ে থাকে। সেই দেশেই আজ ন্যায়বিচারের শেষ ভরসা, একটি মোবাইল ক্যামেরা! এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম? এটাই কি আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রাপ্তি?

স্মৃতি ঝাপসা নয়, রক্ত এখনো শুকায়নি

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় দিন। সেদিন ঢাকার রাজপথে লগি-বৈঠা হাতে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, তাতে শহীদ হয়েছিলেন জসিমসহ অসংখ্য সাধারণ কর্মী। শুধু হত্যাই নয়, সেদিনের বর্বরতাকে আরও নৃশংস করে তুলেছিল সেই লাশের ওপর নৃত্য। এ ছিল ক্ষমতার জন্য মানবতাকে পিষে ফেলার নগ্ন প্রকাশ। যারা তখন সেই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিল, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অনেকেই আজ নিজেই নতুন ‘লাশতন্ত্র’-এর ধারক হয়ে উঠছে। এই ভয়ংকর রূপান্তর শুধুই রাজনীতির নয়, এটি আমাদের সামষ্টিক নৈতিক বিপর্যয়ের চিহ্ন।
আমরা ভুলিনি বিশ্বজিৎ দাসের কথা। একজন সাধারণ টেইলার্স কর্মচারী, যার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না, কোনো দলের পতাকা তার কাঁধে ছিল না। তবু শুধুমাত্র ‘ভুল জায়গায় ভুল সময়ে’ দাঁড়িয়ে থাকার অপরাধে, দিনের আলোয়, শত মানুষের সামনে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় ঘটে এই বিভৎস ঘটনা। ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে না পড়লে হয়তো এটিও হারিয়ে যেত ‘অজানা আততায়ীর হামলা’ হিসেবে। বিশ্বজিৎ দাসের মৃত্যু আমাদের জাতিগত বিবেকের এক নির্মম পরীক্ষা ছিল, যাতে আমরা ব্যর্থতার চূড়ান্ত নিদর্শন রেখে এসেছি। দোষীরা ধরা পড়লেও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার আবরণে আজও বহু অপরাধী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

আজও মানুষ খুন হয়, দলীয় ক্ষমতার বলি হয়ে। পদ্ধতি বদলায়নি—বরং তা আরও চতুর, আরও হিংস্র হয়েছে। আজ যখন কোনো দল চাঁদাবাজি বা আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুন করে, আর আরেক দল সে ঘটনা নিয়ে শুধুই রাজনৈতিক ফায়দা তোলে, তখন বোঝা যায়—আমরা যেন প্রতিনিয়ত এক লাশ থেকে আরেক লাশের দিকে হাঁটছি, যার শেষ নেই। এই পরিস্থিতি স্মৃতির ঝাপসা নয়, এ এক সদা তাজা রক্তের ইতিহাস, যা এখনো মাটিতে শুকায়নি। এমন রক্তের ইতিহাসে দাঁড়িয়ে কারা আবার ‘গণতন্ত্র’ কিংবা ‘পরিবর্তন’-এর নাম নেয়, সেই প্রশ্ন আজ কাঁপিয়ে তোলে প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে।

বিএনপি কি থামাবে যুবদলকে?

যুবদল এক সময় ছিল পরিবর্তনের প্রতীক, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সহযোদ্ধা। গণতন্ত্র ও জনআকাঙ্ক্ষার পক্ষে সাহসী কণ্ঠস্বর হিসেবে সংগঠনটি তরুণ সমাজের মাঝে একসময় আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাপ্রবাহ সেই ভাবমূর্তিকে গভীর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনায় যুবদলের নেতার সরাসরি সম্পৃক্ততার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর জনমনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা আর সাধারণ কোনো ঘটনার মতো নয়। এই ভিডিও যদি সামনে না আসত, তাহলে হয়তো এটিও ‘অজ্ঞাতনামা খুন’ হিসেবেই ধামাচাপা দেওয়া হতো।

এ ধরনের ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং বড় একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটের ইঙ্গিত বহন করে। যেখানে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, দলীয় কোন্দলে সন্ত্রাস। এসব যদি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের রুটিনচিত্রে পরিণত হয়, তাহলে জনগণ প্রশ্ন করবেই; বিএনপি কি এই যুবদলকে আদর্শিক নেতৃত্ব দিতে পারছে? নাকি তাদের নিয়ন্ত্রণ এক প্রকার হারিয়ে ফেলেছে? একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সামনে এখন একটি স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের উচিত নিজেদের ভেতরের সহিংস ও দুর্বৃত্তায়নের প্রবণতার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ও কঠোর অবস্থান নেওয়া। যদি তারা চুপ থাকে, নীরব প্রশ্রয় দেয়, কিংবা দায় এড়িয়ে চলে, তাহলে সেই নীরবতা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসঙ্কেত হয়ে উঠবে। কারণ জনগণ আজ পরিবর্তনের জন্য উদগ্রীব, কিন্তু সেই পরিবর্তন যদি আসে সহিংসতার হাত ধরে, তাহলে ভবিষ্যৎ আরও ভয়ানক হবে। আজ বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি আদর্শের পথে সংগঠন পরিচালনা করবে, নাকি ক্ষমতার রাজনীতির নামে সহিংসতার সংস্কৃতিকে মেনে নেবে। যুবদলকে থামাতে না পারলে বিএনপি নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলবে। আর জনগণ তখন বলবে, এরা কি সত্যিই গণতন্ত্র চায়, নাকি শুধু আরেকটি দমনমূলক শক্তি হয়ে উঠতে চায়?

চাঁদা, চক্রান্ত, চুপ থাকা—এই তিনেই গলা টিপে ধরা হয় মানুষকে

বাংলাদেশে আজ চাঁদাবাজি যেন একটি প্রাত্যহিক চর্চা, আর সেটির ভয়াল শিকার দেশের প্রান্তিক মানুষগুলো। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফুটপাতের হকার—এদের জীবন চলছে প্রতিদিন কোনো না কোনো ‘দলের ছায়ায় বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী’র চাঁদার দাবির সঙ্গে লড়াই করে। যারা দিনের আলোয় এসব মানুষকে জিম্মি করে রাখে, তারাই আবার রাতের আঁধারে ‘পরিবর্তনের প্রতীক’ হয়ে দেয়ালে উঠে যায়। দিনের বেলায় তারা ‘জনতার পক্ষে’ মানববন্ধন করে, সামাজিক মিডিয়ায় দেয়ালে দেয়ালে ‘আদর্শ’ পোস্ট করে, কিন্তু বাস্তবে তারা আদর্শ নয়, আদার বেপারী। এই যে দীর্ঘদিনের চাঁদাবাজির শিকার হওয়া মানুষদের চাপা ক্ষোভ, তার সামান্য প্রতিবাদ করলেই মূল্য দিতে হয় প্রাণ দিয়ে। সম্প্রতি রাজধানীতে যে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো, তার অপরাধ একটাই—সে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

এখানেই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা, একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে চাঁদার বিরুদ্ধে কথা বললে বিচার দূরের কথা, জীবনটিই অনিশ্চিত হয়ে ওঠে।

এভাবে কি কোনো জাতি সামনে এগোয়? না, বরং এমন সহিংস সংস্কৃতি ও চাঁদাবাজির দানবীয় ছায়ায় জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়, মূল্যবোধের শেকড় শুকিয়ে যায়, জনগণের রাষ্ট্র পরিণত হয় ‘গোষ্ঠীর বাজার’-এ। চুপ থাকলেই হয়তো কেউ বেঁচে যায়, কিন্তু তাতে জাতি মরে।

রাজনীতি কি কেবল ক্ষমতা? আদর্শ কোথায়?

দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পর আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতাচ্যুত। তারা এক সময় বলেছিল, ‘আমরাই জাতিকে শান্তি দেব।‘ কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেদের শাসনামলে গুম, খুন, দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও বিচারহীনতার এমন এক সংস্কৃতি তৈরি করেছিল, যা জনগণের মনে দীর্ঘস্থায়ী ভীতি ও অনাস্থা তৈরি করে।

অন্যদিকে ‘পরিবর্তনের’ আশ্বাস দিয়ে, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘জনগণের অধিকার’ রক্ষার কথা বলে যারা আজ নেতৃত্বে আসতে চায়—তারাই যদি খুন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? আদর্শ হারিয়ে ফেললে রাজনীতি আর জনসেবা থাকে না, তা হয়ে যায় নিছক দখলের লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে যারা জয়ী হয়, তারা শাসক হয় ঠিকই, কিন্তু জনতার প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারে না।

শহীদদের আত্মা কি কাঁদে না?

আবু সাঈদ, ওয়াসীম, মুগ্ধ, শান্ত, আলী রায়হান—যারা একদিন বুক চিতিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন দেশের ভবিষ্যৎ ও ন্যায়ের সংগ্রামে তাঁরা আজ কোথায়? তাদের আত্মা কি কাঁপে না, যখন দেখে— একই দলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আজ অন্যায় আর খুনের রাজত্ব চলছে? তাদের স্বপ্ন কি ছিল, চাঁদা না দিলে দলের নাম ব্যবহার করে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে?

এই জুলাই মাস শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণে মাথা নোয়ানোর মাস। অথচ এই মাসেই যখন চাঁদাবাজির বলি হয়ে কেউ প্রাণ হারায়, যখন দলের ছত্রছায়ায় খুন হয় একজন নিরীহ নাগরিক, তখন শুধু আমরা কাঁদি না, কাঁদে সেই শহীদরাও, যারা নিজেদের রক্ত দিয়ে রাজপথে ইতিহাস লিখেছিলেন। তাঁদের আত্মা হয়তো আজ প্রশ্ন করে, ‘আমরা কি এই রাজনীতির জন্য প্রাণ দিয়েছিলাম?’

পুনরায় ‘ছত্রিশে জুলাই’র অপেক্ষায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন কিছু দিন থাকে, যা কেবল পঞ্জিকার তারিখ নয়—একটি জাতির চেতনা, প্রতিরোধ এবং পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে ওঠে। তেমনই একটি দিন আজ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ‘ছত্রিশে জুলাই’। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে দেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ রাজপথে ফুঁসে উঠেছিল। একদিকে দুর্নীতির পাহাড় গড়া একনায়কতান্ত্রিক শাসন, অন্যদিকে গুম, খুন, দমন-পীড়ন, নির্বাচন নামক প্রহসনের বিরুদ্ধে জমাট ক্ষোভ— সবকিছু এক হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল রাজপথে। জনতার অব্যাহত প্রতিরোধে অবশেষে ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

সেই দিনটি সরকারি ক্যালেন্ডারে ‘৫ আগস্ট’ হলেও, জনগণের হৃদয়ে তা ‘ছত্রিশে জুলাই’ নামে খ্যাত। কারণ, জুলাই মাসজুড়ে চলা প্রতিরোধের রক্তাক্ত বাঁক এসে যেদিন চূড়ায় পৌঁছায়—সেই দিনটিই হয়ে ওঠে শেষ বিচারের দিন, মুক্তির দিন, নতুন সম্ভাবনার দিন। এই দিনটি ছিল শুধুই সরকার পতনের ঘটনা নয়; এটি ছিল এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্লান্তি, নৈতিক অবক্ষয় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুবসমাজের দাঁড়িয়ে যাওয়ার দিন। এই দিন নতুন প্রজন্ম জানিয়ে দিয়েছিল, আদর্শহীন রাজনীতির জায়গা বাংলার মাটিতে নেই। তারা দেখিয়ে দিয়েছিল, প্রতীক নয়, দরকার চরিত্র; ক্ষমতা নয়, চাই ন্যায়; দমন নয়, চাই পরিবর্তন।
আমরা এখন আবারও সেই অপেক্ষায় আছি, কবে ফিরবে আরেকটি ‘ছত্রিশে জুলাই’? যখন রাজনীতি হবে নির্মল, নেতৃত্ব দাঁড়াবে লাশের ওপর নয়—আদর্শের ওপর, এবং জনগণ ফিরে পাবে হারিয়ে যাওয়া ভরসা। কারণ আজও যখন আমরা দেখি চাঁদা না দেওয়ায় দলীয় নেতার হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ খুন হচ্ছে, তখন মনে হয়—এত আত্মত্যাগ, এত আন্দোলন, এত প্রতিবাদের পরও আমরা কোথাও থেমে গেছি। শহীদের রক্তে গড়া জুলাই মাসেই যদি এমন নৃশংসতা ঘটে, তবে আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ, শান্ত, আলী রায়হানদের আত্মা কি কাঁদে না? তাঁদের স্বপ্ন কি এই ছিল, দলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অন্যায় আর খুনের উল্লাস?

শুধু আমরা নয়, শহীদরাও নিশ্চয় কাঁদেন। সেই কান্না থেকে উঠে আসুক আবারও জাগরণ, যেন সৃষ্টি হয় আরেকটি ‘ছত্রিশে জুলাই’। সেই দিন ফিরে আসুক, অন্তরে নতুন আলোর দীপ্তি নিয়ে, বাংলার প্রতিটি নিপীড়িত প্রাণের মুক্তির প্রত্যয়ে।

নৈতিক পতনের শেষ সীমানায় বাংলাদেশ

প্রতিটি হত্যাকাণ্ড শুধু একটি মৃত্যুর ঘটনা নয়; এটি আমাদের রাষ্ট্রের নৈতিকতার মুখোশ খুলে দেয়। একেকটি খুনের পেছনে লুকানো থাকে সমাজের গভীর সংকট, যেখানে বিচারহীনতা, দলীয় স্বার্থের অন্ধকার ও ক্ষমতার অপব্যবহার একাকার হয়ে ওঠে। আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা যে দৃষ্টান্ত, সেটি হলো—যখন হত্যার ভিডিও না থাকলে আইনের চোখ বন্ধ থাকে, এবং যখন অপরাধী দলীয় পরিচয় পেয়ে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে, তখন বুঝতে হবে আমরা নৈতিক পতনের এমন এক সীমানায় এসে পৌঁছেছি, যেখানে সংবিধান ও আইনকে কেউ মর্যাদা দেয় না। এই সংকটের মুখে আজ আমাদের দরকার আদর্শের এক অনিবার্য ঝড়, যে ঝড়ে শুদ্ধতা ও ন্যায়ের সুর বেজে উঠবে। দরকার সেই তরুণ প্রজন্মের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ, যারা শুধু কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী; যারা নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির কল্যাণে নিরলস লড়ে যাবে। আমাদের দরকার সেই ‘ছত্রিশে জুলাই’র পুনরাবির্ভাব, যে দিনটি আমাদের জাতিকে দেখিয়েছিল সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত, যেখানে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের মশাল হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল নতুন প্রজন্মকে।

অন্যথায়, এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতির দোহাই দিয়ে, ‘পরিবর্তনের’ নামে, ‘জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর’ কথা বলে যদি আমরা অব্যাহত থাকি বর্তমান অন্ধকারে, তাহলে আরও অনির্বচনীয় পরিমাণ রক্ত ঝরবে। আরও বহু শিশির বিনষ্ট হবে, আরও অনেক লাশ গার্ডিয়ানদের চোখ এড়িয়ে ‘সাধারণ খুন’ নামক ভঙ্গুর শিরোনামে গাঢ় নিস্তব্ধতায় বিলীন হয়ে যাবে।

আমাদের সামনে এখন দুটি পথ, একটি হলো নৈতিকতার পুনর্জাগরণ ও গণতান্ত্রিক মূল্যের পুনঃস্থাপন, অন্যটি হলো গভীর নিম্নগামী পতনের দিকে আরও ধাবিত হওয়া। দেশের ভবিষ্যৎ আজ আমাদের হাতে। দেরি করলে, এই নৈতিক অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া জাতি তারই ফল ভোগ করবে।

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

‘ছত্রিশে জুলাই’র প্রত্যাশা মুক্তমত লাশের রাজনীতি সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর