Sunday 13 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রেডিও কি ফিরে পাবে তার হারানো সোনালী যুগ?

সুমন বৈদ্য
১৩ জুলাই ২০২৫ ১৭:৪৫

একটা সময় ছিল, যখন সন্ধ্যা নামতেই রেডিওর শব্দে মুখরিত হতো গ্রামের চৌচালা ঘর কিংবা শহরের ব্যস্ত ড্রয়িংরুম। সকালবেলার খবর, বিকেলের নাটক কিংবা রাতে বেতারের গানে মুগ্ধ হতো মানুষ। রেডিও ছিল তখন তথ্য, বিনোদন আর ভাবনার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বাংলাদেশ বেতার, বিবিসি বাংলা, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও তেহরানসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক রেডিও স্টেশন বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু কালের চাকা ঘুরে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় আজ সেই রেডিও যেন হারিয়ে গেছে ডিজিটাল তরঙ্গের ধুলোর নিচে। প্রশ্ন উঠে—বাংলাদেশে রেডিওর এই পতন শুরু হলো কখন? আর আদৌ কি রেডিও কি ফিরে পাবে তার হারানো সোনালী যুগ?

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের সাথে রেডিওর পরিচয় হয় ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৩৯ সালে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পিছনে এই রেডিও স্টেশনের অবদান ছিলো অনেক বেশি। মুক্তিযুদ্ধকালীন জনমনে সাহস জোগানোর প্রধান হাতিয়ার ছিলো এই রেডিও। বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের বার্তা, স্বাধীনতার খবর—সবই প্রথম শোনা গিয়েছিল রেডিওর মাধ্যমে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, রেডিও পাকিস্তান সেখানে সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ বেতার রাখা হয়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে নব্বই দশক পর্যন্ত রেডিও যেনো বাঙ্গালীদের কাছে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিল। কারণ ৯০-এর দশকে গ্রামাঞ্চলে টেলিভিশনের উপস্থিতি ছিলো সীমিত। বিদ্যুৎ না থাকা ও টিভির উচ্চমূল্য অনেকের নাগালের বাইরে ছিলো। ফলে রেডিও-ই ছিলো সহজলভ্য মাধ্যম।

অনেক পরিবারে সকালে ও সন্ধ্যায় রেডিও শোনা ছিলো অনেক পরিবারের দৈনন্দিন অভ্যাস। এটি এক ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিলো। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচের ধারাভাষ্য রেডিওতেই শোনা হতো। বিশেষ করে আইসিসি বা ফিফার ম্যাচে গ্রামের বাজারগুলোতে রেডিও কেন্দ্র করে ভিড় জমতো। অনেক দিনমজুর, রিকশাচালক বা ট্রাকচালকদের সময় কাটানোর বড় মাধ্যম ছিলো পোর্টেবল রেডিও।

তবে রেডিওতে নতুন মাত্রা যোগ হয় ২০০০ সালের পর। তৎকালীন কিছু বেসরকারি এফএম রেডিও (যেমন: রেডিও টুডে, এবিসি রেডিও, রেডিও ফুর্তি) তখনকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো কিন্তু তা ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং সীমিত।

মোটামুটিভাবে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল এফএম রেডিওর সোনালী সময়। এমন একটা সময় পার করছিলো তখনকার প্রজন্ম, যখন ঢাকা থেকে শুরু করে সব জেলার মানুষ হাবিব ওয়াহিদ, হৃদয় খান তপু থেকে শুরু করে যেকোনো ভাষারই হোক ,মানুষ তার পছন্দনীয় গান শোনার জন্য রেডিওতে অপেক্ষা করতো, সেইসাথে কাজ করতে করতে, পথ চলতে চলতে কানে দেখা যেত হেডফোন। তখন নতুন গানগুলো প্রথমে রেডিওতেই মুক্তি পেত। হাজার হাজার শ্রোতা ম্যাসেজ করে অনুরোধ করতেন তাদের প্রিয় গান বাজানোর। সে সময়ে এতটাই এফএম রেডিওর জয়জয়কার ছিল, যে মানুষ তাদের গাড়ির সিডি প্লেয়ারের জায়গায় রেডিও বসিয়ে নিত। আর উন্মাদনার কেন্দ্রে ছিলেন আরজে’রা (রেডিও জকি)।

শুধু কি গান, এফ এম, লাভ গুরু, হ্যালো ৮৯২০ এই অনুষ্ঠান সমূহ ছিলো দর্শকদের চাহিদার শীর্ষে। এমন জনপ্রিয় রেডিও জকির কথা বলা যাক। নাম আরজে সায়েম, তার ফ্যানবেইজও ছিল বেশ বড়। একবার তার সিলেটের ভক্তরা একটি ফ্যান ক্লাব খুলে বসে এবং তাকে অনুরোধ জানায় সেটির উদ্বোধন করার। সিলেটে যাওয়ার টিকেট থেকে শুরু করে হোটেল ঠিক করা পর্যন্ত ভালোবেসে পুরোটাই করে দেয় তার ভক্তরা। আর সেখানে গিয়ে এত এত উপহার পান, যে সেগুলো আনার জন্য আরেকজনের সাহায্য নিতে হয়েছিল।

সেই সোনালী দিনের রেডিও জকিদের ঝুলিতে আছে– তাদের ভক্তদের সাথে অনেক মজার গল্প; যা তারা স্মৃতির ভাণ্ডারে রেখেছেন পরম যত্নে।

কিন্তু বর্তমানে ইউটিউব, পডকাস্ট, ফেসবুক লাইভের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণ প্রজন্মকে রেডিও থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। শ্রোতা কমার ফলে রেডিও স্টেশনগুলো কনটেন্টে রূপান্তর এনে বাণিজ্যিকভাবে টিকে থাকার পথ খুঁজছে— সাংবাদিকতার গুণমান বজায় রাখা সেখানে অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।

মূলত, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল নাগাদ রেডিওতে বিজ্ঞাপন অনেক কমে যায়, বা নেই বললেও চলে। গানের অনুরোধ বা কোনোকিছুর জন্য ম্যাসেজ আসত না, বরং রেডিও কতৃপক্ষের নিজেদেরই ম্যাসেজ পাঠাতে হতো। ফেইসবুকে এসে শ্রোতাদের কমেন্টের অনুরোধ জানাতে হতো। এখন কেবল খেলাধূলার ধারাভাষ্যের জন্যেই রেডিওগুলো কোনোমতে টিকে আছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপে রেডিওর জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিবিএস তথ্য মোতাবেক, মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ রেডিও শোনেন। অন্যদিকে ৯৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ মানুষ রেডিওর প্রতি অনাগ্রহী।

জরিপ অনুযায়ী, রেডিও না শোনার পেছনে কয়েকটি যুক্তি খেয়াল করলে দেখা যায়, ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন, রেডিও শোনার প্রয়োজন নেই। ৩৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ মনে করেন, বর্তমান রেডিওর যে বেহাল দশা তাতে করে তাতে রেডিও উপভোগ করাটা অনেকটা সহজলভ্য নয়।

৭ শতাংশ মানুষের দাবি সময়ের অভাবে রেডিও শোনেন না। অন্যদিকে ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে রেডিও কিনতে পারেন না। পাশাপাশি শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ মনে করেন, রেডিওর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে গেছে।যা সত্যিকার অর্থেই বলতেই হয় রেডিও এখন সত্যিই অতীতের গল্প।

একটা সময় ছিলো মিডিয়ায় কাজ শুরু করার ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম ছিল রেডিও। বিনিয়োগ, বিজ্ঞাপনের জন্য এটি ছিল অসামান্য এক গন্তব্য, এবং শ্রোতাদের কাছেও ছিল বড় কিছু। তবে ইউটিউব, ফেইসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম এসে একে একে বিনোদনের সেই জগত কেড়ে নেয়– যা এতদিন ছিল রেডিওর দখলে। শ্রোতা কমে যাওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারা মুখ ঘোরাতে শুরু করল, ফলে কমে গেল টাকা। রেডিও স্টেশনগুলো প্রত্যাশিত বেতন দিতে না পারায় দক্ষ এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আরজেরা অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যেতে শুরু করল, আর সেই সাথে কমতে শুরু করল অনুষ্ঠানগুলোর মান। রেডিওর গোড়াপত্তনের অন্যতম একটি কারণ যথাসময়ে ডিজিটাল বলয়ের সাথে তাল না মেলানো।

রেডিও যে একেবারেই নেই- তা নয়। এখনো অনেক এফএম রেডিও চালু আছে, তবে আগের মতো আর সেগুলো মানুষের কথোপোকথনের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই, যেমনটি আগে ছিল। এর পেছনে অনেক কারণ আছে, প্রথমত রেডিওর প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ কমে গেছে। আর ঘণ্টাপ্রতি বিজ্ঞাপনের সময় ২০ মিনিট থেকে গড়ে পাঁচ মিনিটে নেমে আসায় কমেছে আয়। (অর্থাৎ রেডিও স্টেশনগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে স্লটগুলো ঘণ্টাপ্রতি মাত্র পাঁচ মিনিট পূরণ করতেও হিমশিম খায়)।

বর্তমানে যেসব রেডিও স্টেশন আছে, তাতে প্রয়োজনীয় সৃজনশীল নির্ভর দক্ষ জনবল নেই। অন্যদিকে অনেক মানহীন বেশি রেডিও চ্যানেল চালু হওয়ায়, দক্ষ আরজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে।তাছাড়াও এফএম রেডিওগুলো এখন ফেইসবুক এবং ইউটিউবে তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যা খুবই একটা সুবিধার না এবং চমকপ্রদ নয়। ভিউজের চক্কর এবং দৃষ্টিনন্দন কন্টেন্টের অনুপস্থিতি।

অন্যদিকে এখনকার আরজেদের মধ্যে মাত্রারিক্ত কর্মাশিয়াল মনোভাব পরিলক্ষিত করা যায়। আগের প্রজন্মের মধ্যে কীভাবে দর্শকদের কাছে কন্টেন্ট চমকপ্রদ করে তোলা যায় তা নিয়ে গভীর কঠোরভাবে চেষ্টা থাকতো। পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রবণতা থাকতো। নিজেদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যেতো। তাদের কাছে রেডিও-ই যেনো ছিল জীবনের সব।

কিন্তু বর্তমানে রেডিওর পতন হওয়ার পিছনে আরো একটি কারণ হলো রেডিওর কাজের প্রতি সৃজনশীল মনোভাবের উপর অনাগ্রহতা। কারণ রেডিও একটি সৃজনশীল ক্ষেত্র। তবে বর্তমান এই সৃজনশীল ক্ষেত্র হয়ে গিয়েছে ব্যবসার জায়গা। যেমন: রেডিও স্টেশনগুলোর আয়ের প্রধান উৎস এখন বিজ্ঞাপন। এর ফলে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষণীয় ট্রেন্ডি কনটেন্ট বা শো তৈরিতে জোর দেওয়া হচ্ছে।

যেসব বিষয় শ্রোতা টানতে পারে না বা বিজ্ঞাপনদাতার আগ্রহ নেই— তা সম্প্রচারের ঝুঁকি নেয় না স্টেশনগুলো। ফলাফল— জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু উপেক্ষিত থেকে যায়।

বর্তমান অনেক রেডিও স্টেশনে সাংবাদিকতা বিভাগের বদলে কেবল বিনোদনমূলক ও কমার্শিয়াল কন্টেন্টের জন্য কর্মী নিয়োগ করা হয়। মূলধারার সাংবাদিকতা শিক্ষায় দীক্ষিত, অনুসন্ধানী মানসিকতা সম্পন্ন সংবাদকর্মীদের সংখ্যা এখানে হাতেগোনা। যে কারণে অনুসন্ধানী রিপোর্ট বা জনস্বার্থের প্রতিবেদন প্রায় অনুপস্থিত।

রেডিওতে এখন গানের অনুষ্ঠান, সেলিব্রিটি চ্যাট শো, রোমান্টিক আরজে টক— যা অনেকটাই ট্রেন্ডিধর্মী। আগের প্রজন্মের সময় যে রোমান্টিক আরজে টকশো, গানের অনুষ্ঠান, সেলিব্রিটি চ্যাট শোতে শালীনতা ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা হতো। এই যেমন: ভালোবাসা বা সম্পর্ক নিয়ে কথা বললেও সেটা হতো বিনয়ের সঙ্গে, রুচিসম্মত উপমা সাহিত্যপ্রেমে মোড়ানো শব্দে এবং নান্দনিক গল্প বলার ভঙ্গিতে। সেইসাথে ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি অনধিকার চর্চা পরিহার করা হতো।

ব্যক্তিত্বকে সম্মান করে প্রশ্নের কাঠামো নির্ধারণ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে দর্শকদের চাহিদা ধরে রাখার যে বিষয়সমূহ রাখতো তা যেনো অনেকটাই অনুপস্থিত। সেইসাথে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা কিংবা জনগণের সমস্যা তুলে ধরার কাজ যেন একপ্রকার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারণ এগুলো রেটিং বাড়ায় না, বিজ্ঞাপন টানে না।

বর্তমানের অনেক আরজে তরুণ-তরুণীদের মাঝে কেবল জনপ্রিয়তা ও ফলোয়ার বাড়ানোর মাধ্যম হয়ে উঠেছে। দায়িত্বশীল উপস্থাপনা কিংবা জনগণের কথা তুলে ধরা নয়, বরং ট্রেন্ডি কথা, মজাদার কৌতুক, প্রেম-ভালোবাসার গল্পই তাদের শো’র মূল উপকরণ। ফলে শ্রোতারা ‘সাংবাদিকতা’ নয়, পান কেবল ’শ্রুতি বিনোদন’।

তার চেয়েও বড় কথা কিছু রেডিও স্টেশন কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকানায় পরিচালিত হয়, যাদের উদ্দেশ্য থাকে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বা জনস্বার্থের খবর এবং অনুষ্ঠান প্রকাশ করার মতো স্বাধীনতা রেডিও সাংবাদিকদের থাকে না। মালিকের ইচ্ছা মতোই চলে কনটেন্ট কৌশল।

তাছাড়াও চ্যানেলগুলোর একে অন্যকে নকল করার প্রবণতা। একটা স্টেশন একটা অনুষ্ঠান শুরু করে; আরেক স্টেশন সেই একই অনুষ্ঠান শুরু করে, তারা নকল করতে শুরু করে। ফলে নতুন কোনো কন্টেন্ট বা আইডিয়া আসে না। এর ফলে মান কমতে থাকে। অনেক নতুন আরজে আজকাল রেডিওকে কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যারিয়ার স্টেপিং-স্টোন হিসেবে দেখছে।

আমাদের দেশে আরো একটি বড় সমস্যা হলো সিনিয়র হটাও। সিনিয়র হয়ে গেলে অন্যান্য দেশে বেতন বাড়ে, আর আমাদের দেশের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, ‘আচ্ছা, সে সিনিয়র হয়ে গেছে, তার জায়গায় আরও দুইজনকে আনো।’ রেডিও যদি এইসব সৃজনশীল ব্যক্তিদের ধরে রাখতে পারতো, তাহলে বর্তমান যুগে এসেও চিত্রটা কিছুটা ভিন্ন হতে পারতো।

বর্তমানে রেডিও মানেই যে গান শোনার অনুষ্ঠান কিংবা অতিথি ডেকে এনে গল্প করে গান শোনানো অনুষ্ঠান দিয়ে যে চলে না তা যেনো পাশ্ববর্তী দেশ রেডিও মিরচি করে দেখিয়েছে। রেডিও মিরচিকে যেভাবে জনপ্রিয় অভিনেতা, উপস্থাপক এবং আরজে মীর আফসার আলী যেভাবে রেডিও মিরচিকে ধরে রেখেছিল– এফএম রেডিওগুলো সেভাবে বাংলাদেশের কন্টেন্ট এবং আরজেদের ধরে রাখতে পারেনি।

তাদের শোতে দেখা যায়, বিভিন্ন সপ্তাহে বিভিন্ন টপিকসে উপর ভিডিও তৈরি করে যেমন: সানডে সাসপেন্স। যেখানে বিভিন্ন কবির কবিতা এবং লেখকের গল্পকে ভিন্ন আঙ্গিকে তারা প্রচার করছে, তাও ইউটিউবের মতো উন্মুক্ত প্লাটফর্মে। তা দর্শকরা বিনামূল্যে সাদরেই উপভোগ করছে। সেইসাথে বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। শুধু কি অনুষ্ঠান, ছোটখাটো শর্ট নাটকের আয়োজনও তারা করে থাকে।

সেইসাথে রেডিও মিরচি শুধুমাত্র এফএম নয়, তাদের ডিজিটাল কনটেন্ট, ইউটিউব শো, ওটিটি ফরম্যাটের উপস্থাপনা, স্মার্ট অ্যাপের মাধ্যমে শোনা সুবিধা— সব মিলিয়ে এক বিশাল মাল্টিপ্ল্যাটফর্ম হাব। তারা ব্র্যান্ডিং, রেডিও ক্যাম্পেইন, ইন্টারেকটিভ সেগমেন্ট-সবকিছুতেই আধুনিক।

বাংলাদেশে এখনো অনেক রেডিও স্টেশন ডিজিটাল হাব হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে ব্যর্থ। ইউটিউব বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট আপলোড সীমিত ও অগোছালো পাশাপাশি মানহীন। শ্রোতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে এই দিকটি বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাশ্ববর্তী দেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে রেডিও সম্প্রচারের ওপর উপরমহল থেকে নিয়মিত নীতিমালা, প্রতিযোগিতা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বিভিন্ন রাজ্যে রেডিওকে স্থানীয় কণ্ঠস্বর হিসেবে বিবেচনা করে উৎসাহিত করা হয়।

বাংলাদেশে রেডিও সেক্টরের ওপর নজরদারি ও সহযোগিতা তুলনামূলকভাবে কম। দক্ষ কর্মী উন্নয়ন, গবেষণা, প্রযোজনার মান উন্নয়নে কোনো পরিকল্পিত নীতি কার্যকর হয়নি।

একটা সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পড়া ছাত্রছাত্রীরা বেতারে ইন্টার্ন করত, যা তাদের বাস্তব সাংবাদিকতার অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠত। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা হয়ে গিয়েছে উল্টো। বর্তমান প্রজন্মের তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা রেডিওকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিতে চায় না।

বর্তমান রেডিও পেশায় অল্প বেতন, অনিয়মিত ইনকাম এবং দীর্ঘ সময় কাজ করার পরেও আর্থিক স্বাধীনতা পাওয়া কঠিন। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এখন ক্যারিয়ার হিসেবে এমন পেশা খোঁজেন যেটিতে দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্থিতিশীলতা ও উন্নতির সুনির্দিষ্ট স্কেল আছে—যা রেডিও সেক্টরে অনেকটাই অনুপস্থিত।

রেডিও পেশায় গ্রোথ খুব সীমিত। একজন আরজে হয়ে বেশি হলে সিনিয়র আরজে বা প্রোগ্রাম হেড হওয়া যায়, তাও নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায়।

চাকরি বদল বা আন্তর্জাতিক স্কেলে রেডিও অভিজ্ঞতা খুব কম গ্রহণযোগ্য, অন্য সেক্টরের মতো ট্রান্সফারেবল স্কিলের স্বীকৃতি নেই। আজকের সমাজে রেডিও আর আগের মতো ‘মিডিয়া গ্ল্যামার’ বহন করে না। টেলিভিশন, ইউটিউব, ওটিটি কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা বেশি জনপ্রিয় ও আদর্শচিত্র হয়ে উঠেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা এটিকে ‘ডেড-এন্ড ক্যারিয়ার’ বলে বিবেচনা করে।

তাই রেডিওর সোনালী যুগ ফিরিয়ে আনতে হলে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্ৰহণ করা যায়। যেমন-

সৃজনশীল নির্মাতাদের ফিরিয়ে আনা _

রেডিওর ইতিহাসে সৃজনশীল উপস্থাপক, প্রযোজক ও কনটেন্ট নির্মাতারা ছিলেন প্রাণ। তারা অনুষ্ঠানকে কেবল একঘেয়ে তথ্য কিংবা গান দিয়ে সাজাতেন না—বরং প্রতিটি পর্বে নতুন গল্প, নতুন আবহ, নতুন চমক আনতেন। আজকের দিনে অনেক প্রতিভাবান নির্মাতা টেলিভিশন, ইউটিউব বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলে গেছেন।

রেডিওতে তাদের ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন যথাযথ সম্মান, স্বাধীনতা ও সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম। এটি রেডিওর কনটেন্টকে আবার প্রাণবন্ত, ভিন্নধর্মী ও চিন্তাশীল করে তুলবে।

ডিজিটাল রেডিও ও অন-ডিমান্ড প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর _

আজকের শ্রোতারা নির্দিষ্ট সময় নয়, নিজেদের সুবিধামতো সময়ে কনটেন্ট উপভোগ করতে চান। সেই কারণে ট্র্যাডিশনাল রেডিওর সীমিত সময়সূচির বাইরে গিয়ে অন-ডিমান্ড কনটেন্ট, পডকাস্ট স্টাইল শো ও মোবাইল অ্যাপভিত্তিক ডিজিটাল রেডিও নির্মাণ সময়ের দাবি। উদাহরণস্বরূপ স্পোটিফাই, অ্যাপল পডকাস্টস বা হইচই এর মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রেডিও শো আপলোড করে শোনার সুযোগ থাকলে শ্রোতা ফিরে আসবে। শ্রোতারা এখন গ্লোবাল চিন্তা করে— তাদের হাতের মুঠোয় রেডিও পৌঁছাতে না পারলে আগ্রহ ধরে রাখা অসম্ভব।

ইন্টারঅ্যাকটিভ ফরম্যাট ফিরিয়ে আনা _

রেডিওর একটা মূল আকর্ষণ ছিল শ্রোতা ও আরজের মধ্যকার সরাসরি আলাপ। চিঠিপত্র, ফোন কল, এসএমএস—এমনকি লাইভ কলের মাধ্যমে শ্রোতার অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানকে জীবন্ত করত।

এখন সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপ, লাইভ কমেন্টিং-এর যুগে এই ইন্টারঅ্যাকটিভিটিকে আরও আধুনিকভাবে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। যেমন: রিয়েল-টাইম রেডিও পোল,শ্রোতা দ্বারা নির্বাচিত গান, কমিউনিটি ফিডব্যাক ও প্রতিক্রিয়া ব্যবহার করে অনুষ্ঠান সাজানো, লাইভ রিভিউ ও প্রশ্নোত্তর সেগমেন্ট

শিক্ষামূলক ও অনুপ্রেরণামূলক অনুষ্ঠান বাড়ানো _

রেডিও যেমন দেশ স্বাধীন করতে ভূমিকা রেখেছিল ঠিক তেমনি সমাজ গঠনেও রেডিওর ভূমিকা অব্যাহত রাখা দরকার। যেমন: শিক্ষার্থীদের জন্য ভোকেশনাল গাইডেন্স শো, ইউনিভার্সিটি/বোর্ড এক্সাম প্রস্তুতি শো, ক্যারিয়ার ইনফো, নারী ক্ষমতায়ন বিষয়ক অনুষ্ঠান আবার চালু করা দরকার।অনুপ্রেরণামূলক জীবনের গল্প, উদ্যোক্তা শো, সাফল্যের সাক্ষাৎকার—এসব অনুষ্ঠান শ্রোতার সঙ্গে বাস্তব জীবনের সেতুবন্ধন গড়ে তুলবে।তাছাড়া গ্রামীণ অঞ্চলের শ্রোতাদের জন্য কৃষি, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি নিয়ে উপকারী তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান চালু করা যেতে পারে।

রেডিওর সোনালী যুগ কেবল অতীতের স্মৃতি নয়—তা ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। আধুনিক প্রযুক্তি ও শ্রোতার মনস্তত্ত্ব বুঝে সৃজনশীলতা, সম্মানজনক যোগাযোগ এবং অংশগ্রহণমূলক অনুষ্ঠানই পারে রেডিওকে আবার জীবন্ত করে তুলতে। তবে এর জন্য দরকার নিরবিচারে কপি করা নয়, বরং মূল চেতনাকে আধুনিক পরিমণ্ডলে ফিরিয়ে আনা। এর ফলে রেডিও যেমন একদিকে তার পুরোনো জৌলুস ফিরে পাবে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও রেডিওতে আরজে হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

সারাবাংলা/এএসজি

মুক্তমত রেডিও সুমন বৈদ্য সোনালী যুগ