Sunday 13 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লবণাক্ততা ও উপকূল: এক নীরব বিপর্যয়ের ধ্বনি

ফাহিম হাসনাত
১৩ জুলাই ২০২৫ ১৮:৪৭

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, যা দেশের অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের এক নির্মম শিকার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং এর ফলস্বরূপ লবণাক্ততার আগ্রাসী বিস্তার এই অঞ্চলের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। এই সমস্যা কেবল প্রকৃতির ভারসাম্যকেই নয়, বরং মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অধিকারকেও চরমভাবে বিপন্ন করছে।

কৃষি ও খাদ্য সুরক্ষায় লবণাক্ততার প্রভাব:

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল লবণাক্ততার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। মাটিতে লবণের ঘনত্ব উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে ৯ মিলিসিমেন্স/সেন্টিমিটার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যা কৃষিকাজ এবং পানির ব্যবস্থাপনার জন্য একটি গুরুতর বিপদ সংকেত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (Department of Agricultural Extension – DAE) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ৯৩টি উপজেলা লবণাক্ততায় আক্রান্ত। এর মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাটের মতো জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে শুষ্ক মৌসুমে এই সংকট আরও তীব্র হয়, যখন বৃষ্টিপাত কম থাকে এবং লবণাক্ত পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করে।

বিজ্ঞাপন

লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের জাতের অভাব এবং প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির কারণে কৃষকরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। ধান, যা বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য, লবণাক্ততার প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। ফলে কৃষকদের বাধ্য হয়ে কম উৎপাদনশীল এবং অ-ঐতিহ্যবাহী ফসল চাষ করতে হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।

জনস্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব:

লবণাক্ততা কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি ভয়াবহ মানবিক সংকটও। উপকূলীয় অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মানদণ্ড অনুযায়ী নিরাপদ পানির চেয়ে অনেক বেশি লবণ এখানকার পানিতে বিদ্যমান। এই লবণাক্ত পানি পান করার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়রিয়া, চর্মরোগ এবং অপুষ্টির মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং গর্ভকালীন জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (ICDDR,B)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ত পানি পানের ফলে গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে প্রি-এক্লাম্পসিয়া (উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

এছাড়াও, লবণাক্ততার কারণে জীবিকার উৎস সীমিত হয়ে পড়ছে। কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলো বাধ্য হচ্ছে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকতে, যার মধ্যে অনেকে কাজের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে, যা সামাজিক অস্থিরতা এবং স্থানচ্যুতি ঘটাচ্ছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে লবণাক্ততা:

লবণাক্ততা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ১৪০ কোটি হেক্টরেরও বেশি জমি ইতোমধ্যে লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আরও ১০০ কোটি হেক্টর জমি হুমকির মুখে রয়েছে। যদিও লবণাক্ততার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ বিবেচনায় বাংলাদেশ শীর্ষে না থাকলেও, এর ভৌগোলিক এবং ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বেশি। অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, কাজাখস্তান, রাশিয়ার মতো দেশগুলোতে বৃহৎ ভূভাগ লবণাক্ত হলেও, তাদের প্রতিরোধ সক্ষমতা, উন্নত প্রযুক্তি এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। এই দেশগুলো লবণাক্ততা মোকাবেলায় বড় ধরনের বিনিয়োগ এবং গবেষণা পরিচালনা করছে।

অভিযোজন ও সমাধানের পথ:

লবণাক্ততার এই ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে একটি দীর্ঘমেয়াদী, সমন্বিত এবং অভিযোজনভিত্তিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (SRDI) কর্তৃক প্রস্তাবিত সুপারিশমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ _

লবণসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে লবণসহিষ্ণু ধানের জাত (যেমন: বিআরআরআই ধান ৬৭, বিআরআরআই ধান ৭৩) এবং অন্যান্য ফসলের (যেমন: সূর্যমুখী, ভুট্টা, বার্লি) উন্নত জাত উদ্ভাবনে আরও জোর দিতে হবে।

মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনা: বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমানো এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থাপনা জরুরি। ড্রিপ ইরিগেশন বা ফোয়ারা সেচের মতো আধুনিক সেচ পদ্ধতি লবণাক্ততা সহনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

নদী ও খাল পুনঃখনন: পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়া নদী ও খালগুলো পুনঃখনন করে মিঠাপানির প্রবাহ নিশ্চিত করা গেলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ অনেকটাই কমানো সম্ভব।

ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ: অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে লবণাক্ত পানি উপরের দিকে উঠে আসছে। এর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং বিকল্প পানীয় জলের উৎস (যেমন: বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর সংস্কার) ব্যবহার করা উচিত।

প্রযুক্তিগত সমাধান: পানীয় জলের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি (Rainwater Harvesting), পুকুর বালু ফিল্টার প্রযুক্তি (Pond Sand Filter – PSF) এবং লবণমুক্তকরণ ইউনিট (Desalination Unit) স্থাপন ও বিস্তৃত করা প্রয়োজন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা অপরিহার্য। অস্ট্রেলিয়ার লবণাক্ততা মোকাবেলায় সরকারের বিনিয়োগ, গবেষণা এবং মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি প্রয়োগ এক সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইন্দোনেশিয়ার ‘সর্জন’ পদ্ধতি, যা লবণাক্ত জমিতে উঁচু বেড তৈরি করে চাষাবাদ করা হয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপাপটেও একটি কার্যকর অভিযোজন কৌশল হতে পারে।

সম্মিলিত উদ্যোগের অপরিহার্যতা:

উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান রক্ষায় এবং লবণাক্ততার আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে একটি সমন্বিত অভিযোজন পরিকল্পনা জরুরি। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়; স্থানীয় জনগণ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (NGOs) এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের যৌথভাবে এগিয়ে আসতে হবে। লবণাক্ততাকে কেবল একটি গবেষণার বিষয় না রেখে, এর প্রতিকারে বাস্তব ও তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, বাংলাদেশের উপকূল হারাবে তার সোনালি সম্ভাবনা, এবং দেশ হারাবে তার খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের মৌলিক জীবন ধারণের অধিকার। এই মানবিক ও পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক কঠিন বাস্তবতা অপেক্ষা করছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

ফাহিম হাসনাত মুক্তমত লবণাক্ততা ও উপকূল