Saturday 19 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধনসম্পদ কী শান্তির গ্যারান্টি?

রিয়াজুল হক
১৯ জুলাই ২০২৫ ১৮:০৮

প্রাচীন একটি প্রবাদ আছে, ‘ধন থাকিলে ধনী বলা যায়, শান্তি থাকিলে সুখী বলা যায়’। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে, জীবনধারাও বদলেছে। কিন্তু এই প্রবাদটির সত্যতা আজও তেমনি অমলিন। বর্তমানের ভোগবাদী সমাজে ‘সফলতা’ শব্দটির সাথে সমার্থক করে ফেলা হয়েছে ‘অর্থ’। আমরা যেন ধরে নিয়েছি, যিনি বেশি উপার্জন করেন, তিনিই বেশি সুখী। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং গবেষণা বলছে অন্য কথা, অপরিসীম টাকা মানেই শান্তি নয়।

আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে মানুষের জীবন ধীরে ধীরে এক অন্তহীন দৌড় প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে। এই দৌড়ে কে কত টাকা উপার্জন করল, কার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কত শূন্য আছে, তা দিয়েই বিচার হয় তার গুরুত্ব। অথচ এই প্রতিযোগিতা থেকে যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং একাকীত্ব জন্ম নিচ্ছে, সবাইকেই তার খেসারত দিতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

টাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ, নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা কিংবা কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অর্থ অপরিহার্য। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত তখনই হয়, যখন অর্থ হয়ে ওঠে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আমরা ভুলে যাই, টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্য শান্তি এবং নিরাপত্তা; টাকার উপার্জনই যদি সেই শান্তিকে গ্রাস করে, তাহলে সেই টাকা কিসের জন্য?

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পর আয় বৃদ্ধি পেলেও মানুষের মানসিক সন্তুষ্টি খুব একটা বাড়ে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে প্রায় ৭৫ হাজার ডলারের বেশি আয় করলেও মানুষের মানসিক শান্তি বা সুখে তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন আসে না। কারণ তখন মানুষ আর মৌলিক চাহিদা নয়, বরং তুলনামূলক বিলাসিতা, সামাজিক স্বীকৃতি কিংবা অহমিকার তাড়নায় ছুটতে থাকে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও একই চিত্র দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ধনসম্পদের কেন্দ্রীভবন বেড়েছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটি চাপযুক্ত শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে, এবং সমাজে অসমতা বেড়েই চলেছে। কিন্তু এই অর্থবিত্ত বৃদ্ধির সাথে সাথে কি মানুষের মানসিক শান্তি বেড়েছে? পরিসংখ্যান বলছে, ‘না’। বরং আত্মহত্যা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, ঘুমহীনতা, এসবই বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা সময় দিচ্ছি না নিজের ভেতরের মানুষটিকে। পড়ে থাকছে সম্পর্ক, অবহেলিত হচ্ছে আত্মার আহ্বান। যান্ত্রিক জীবনে আমরা ভুলে যাচ্ছি প্রকৃতি, বন্ধুত্ব, সাহচর্য এবং একাকীত্বে নিজেকে বোঝার মুহূর্তগুলো। অথচ এ সবকিছুই মানুষকে মানসিকভাবে সুস্থ ও সুখী করে তুলতে পারে।

আজকের সমাজে একটা প্রচলিত বাক্য হচ্ছে, সুখ কেনা যায়। দামী গাড়ি, বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, আধুনিক ফোন কিংবা বিদেশ ভ্রমণেই নাকি লুকিয়ে আছে শান্তির চাবিকাঠি। কিন্তু এই মোহ যখন শেষ হয়ে যায়, তখনই জন্ম নেয় এক ধরণের শূন্যতা। মানুষ আর নিজেকে খুঁজে পায় না।

অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং মানসিক শান্তির মধ্যে সম্পর্ক আছে। স্বাচ্ছন্দ্য মানে ভোগসর্বস্বতা নয়। বরং একজন মানুষ যদি তার জীবনের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারেন, যদি কোনো অনিশ্চয়তার ভয় না থাকে, তাহলে তিনি অনেকটাই মানসিকভাবে প্রশান্ত থাকেন। কিন্তু যখন অর্থের প্রতি লোভ, হিংসা, এবং প্রতিযোগিতা এসে পড়ে, তখনই শান্তি হারিয়ে যায়। আমরা ভুলে যাই, জীবনের সত্যিকারের সম্পদ হচ্ছে স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, আত্মোপলব্ধি এবং মানসিক স্বস্তি। যে ব্যক্তি চিন্তা মুক্তভাবে ঘুমাতে পারেন, তিনিই প্রকৃত অর্থে ধনী।

ধনসম্পদের প্রতি আকর্ষণ থাকুক, কিন্তু তা যেন না হয় অন্ধ আসক্তি। আমাদের প্রয়োজন জীবনের একটি ভারসাম্য, যেখানে অর্থ উপার্জন থাকবে, কিন্তু তার চেয়েও বড় হবে আত্মিক প্রশান্তি । কারণ শেষ পর্যন্ত মানুষ শান্তিই খোঁজে।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সারাবাংলা/এএসজি

ধনসম্পদ মুক্তমত রিয়াজুল হক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর