একটি দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, যিনি কর্মরত আছেন কিন্তু অহংকার ভরা আচরণ নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। তার চারপাশে বিভিন্ন কাজের জন্য ঘোরাঘুরি করছে অনেক জুনিয়র। অথচ, সেই ‘সিনিয়র’ অফিসার অনেক সময় এই জুনিয়রদের তুচ্ছ ভরা চোখে দেখেন। তাদের ছোট করে কথা বলেন, কখনো কখনো অপমান করাও যেন কাজের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ধরেই নেন, চেয়ারে বসার মানেই হলো, সম্মান পাওয়ার একচ্ছত্র অধিকার একমাত্র তার।
কিন্তু চেয়ারের মেয়াদ তো চিরস্থায়ী নয়। অবসরের দিন ঠিকই এসে যায়। তখন সেই তুচ্ছ জুনিয়ররাই হয়ে ওঠে শক্তিশালী, দায়িত্বপ্রাপ্ত, এবং সম্মানযোগ্য। অবসরের পরে দেখা যায়, যাদের একসময় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, তাদের কাছেই এখন গিয়ে স্নেহ, সহানুভূতি কিংবা সামান্য সাহায্যের আশায় বসে থাকতে হয়। এই অবশ্যম্ভাবী উল্টে যাওয়া সময়ের চাকা, আমাদের সমাজে এক নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরে।
চেয়ারে থাকতে ভেবে নেই, আমার কথাই শেষ কথা। কেউ যদি ভিন্নমত পোষণ করে, তখন তাকে বিদ্বেষের চোখে দেখা হয়। অথচ সেই মানুষটাই হয়তো ভবিষ্যতে এমন একটি অবস্থানে যাবে যেখানে তার স্বাক্ষর লাগবে, কিংবা তার সহানুভূতিই হয়ে উঠবে আপনার জীবনের পরবর্তী শান্তির চাবিকাঠি।
সময় থাকতে আমরা ভুলেই যাই, সম্পর্কই আসল সম্পদ। আমরা আরো ভুলে যাই, অফিসের আইডি কার্ড, চেয়ারের ক্ষমতা, অফিসের গাড়ি, সবই একসময় ফেরত দিতে হয়। যা থেকে যায়, তা হলো মানুষের মনে গেঁথে থাকা স্মৃতি। কেউ আপনাকে মনে রাখবে ভালোবাসা নিয়ে, কেউবা কষ্ট নিয়ে, কেউবা প্রতিশোধের আগুন নিয়ে। আপনি কী চান? সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে, এমন একটা মানসিকতা তৈরি হয়ে আছে, ‘আমি সিনিয়র, তাই আমিই ঠিক’। এই মনোভাব শুধু ভুল না, আত্মধ্বংসীও। কারণ, এটি একজন ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
অবসর একটা বাস্তবতা। এটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু অবসরের পরও তো জীবন থেমে থাকে না। তখন সামাজিক যোগাযোগ, মানসিক প্রশান্তি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় সঙ্গী। আপনি যদি কর্মজীবনে অন্যকে ছোট করে থাকেন, অবসরে তার প্রতিফলন পাবেন। কেউ ফোন ধরবে না, কেউ খোঁজ নেবে না, বরং সুযোগ পেলে আপনাকেও নাজেহাল করে ছাড়বে। আর যেসব জুনিয়রকে আপনি মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন, সহানুভূতি দেখিয়েছেন, তারাই আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে।
একজন সহকর্মী কখনোই শুধু একজন অধীনস্থ নয়, সে একজন মানুষ, যার আবেগ আছে, স্বপ্ন আছে, সম্ভাবনা আছে। কর্মজীবনে আপনি যদি একজন জুনিয়রের আত্মমর্যাদায় আঘাত করেন, সেটি শুধু একটা অপমান নয়, এটা আপনার ভবিষ্যতের জন্য একটি সুদে-আসলে ফেরত আসা ঋণ।
আমরা যদি কর্মক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করি, তাহলে সেই জুনিয়রটাই একদিন বলবে, ‘স্যার ছিলেন আমাদের অভিভাবকের মতো।’ চাটুকারিতা থেকে নয়, মন থেকেই বলবে। এমনকি অবসরের পরেও তারাই আপনার কাছে আসবে, আপনার উপকারে আসবে। চেয়ারের মর্যাদা নিজ থেকে আসে না, সেটা গড়ে তুলতে হয়। আর সে মর্যাদা তখনই দীর্ঘস্থায়ী হয় যখন আপনি মানুষের মন জয় করতে পারবেন।
একটা কথা মনে রাখা জরুরি, সময় বদলায়। আপনি যে অবস্থানে আছেন, সেটা চিরস্থায়ী নয়। আপনি যেমন আজ সিনিয়র, কাল অন্য কেউ সিনিয়র হয়ে আসবে। সুতরাং, কর্মজীবনের প্রতিটি ধাপে মানুষের প্রতি সম্মান, সহানুভূতি এবং উদারতা দেখানো জরুরি। তবেই আপনি হয়ে উঠবেন একজন একজন স্মরণীয় মানুষ।
চেয়ারে থাকা অবস্থায় ভুলে যাওয়া উচিত নয়, অবসরের পরও জীবন আছে। আর সে জীবনে আপনাকে ঘিরে থাকবে সেই মানুষগুলোই, যাদের আপনি জীবনের পথে পাশে রেখেছিলেন, ভালো ব্যবহার করেছিলেন।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক