খেঁটে খাওয়া মানুষগুলো দুঃখ-দুরদশাকে তাদের নিয়তি মনে করে। তারা জানে না তাদের ভাগ্য অনেকটাই বন্ধকী রয়েছে সরকারি অফিসের দরজা ও টেবিলে। প্রায় প্রতিটি অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে মহাপরাক্রমশালী একজন পিয়ন বা দারোয়ান। সেবাপ্রার্থী এই পিয়নের গর্জন ছিন্ন করে স্যারের সাথে দেখা করবে যা পানিপথের যুদ্ধে জয়ী হওয়ার চেয়েও কঠিন। অধিকাংশ সময়ে আপনি শুনতে পাবেন একটি কথা। স্যার এখন জরুরী কাজে ব্যস্ত আসেন অথবা স্যার মিটিং এ আছেন; ভিতরে যাওয়া যাবে না। পরে আসেন। লাঞ্চের পরে আসেন। লাঞ্চের পরে আসলে বলে স্যার এখন আর কোন ফাইল ধরবেন না। স্যার এখন রেস্টে আছেন। কাল আসেন। কাল আসলে বলে স্যার অফিসের কাজে ঢাকায় গেছেন।
সেবাগ্রহীতা অনেক সময় বাধ্য হয়ে পিয়নকে টাকা বা অন্য কিছু দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে। অনেক সময় মামা-খালুর মাধ্যমে তদবির করে ঐ বসের সঙ্গে দেখা করেন বা সেবা নেন। অনেক সময় দালালের হাত ধরে সরকারী অফিসের সেবা নিতে মানুষ বাধ্য হয়। আবার অনেকে বিরক্ত হয়ে আর অফিসেই যাচ্ছে না। তারা অভিশাপ দিচ্ছে, রাগ ঝাড়ছে সরকারি অফিসের উপর। অন্যদিকে, ঢাকায় অফিসের কাজের কথা বলে দিনের পর দিন অফিস ফাঁকি দিচ্ছে অনেক সরকারি কর্মকর্তা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তারা নিজের দায়িত্ব অন্যের কাছে হস্তান্তর না করেই অফিসে অনুপস্থিত থাকছেন যা সমস্যাকে বহু বাড়িয়ে তোলে। ফলে টেবিলে মানুষের ভাগ্যের ফাইল জমতে জমতে ছাদ স্পর্শ করে, তাতে কার কী আসে-যায়?
সরকারি অফিস সেবার মান বাড়াতে বা পরিবর্তনে খুব কম ক্ষেত্রেই বিশ্বাসী। তারা বলে এই পরিবর্তন হলে ওই সমস্যা হবে, ওই সমস্যা হবে; না এটা করা যাবে না। অধিকাংশই কোন সিস্টেম বা কাঠামো পরিবর্তন করতে চায় না; কারণ পরিবর্তন করতে গেলে নিতে হবে রিস্ক, করতে হবে পরিশ্রম। এটা করতে অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তারা রাজী নয়। তারা জানে, যা কিছু করি না কেন আমার চাকরি যাবে না, বেতনও বন্ধ হবে না। ঊর্ধ্বতন বসরাও তেমন কিছু বলবেন না, কারন সবাই মাসতুতো ভাই। সবাই একই সিন্ডিকেটের শক্তিশালী সদস্য।
সচিবালয় ও এনবিআর-এর আন্দোলন এগুলোরই জলজ্যান্ত উদাহরণ। অফিসে বসে বসে সবাই সরকার বা নীতি নির্ধারকদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেন। পদোন্নতি দেয় না, বেতন বাড়ায় না কেন, সিস্টেমের পরিবর্তন করে না কেন। কিন্তু তারা নিজেরা পরিবর্তন হবে না। কোন রকমে যদি তারা কেউ বড় পদে পোস্টিং পায় সঙ্গে সঙ্গে তারা হয়ে যান প্রভু। সিস্টেম পরিবর্তন তো দূরের কথা তারা সারাদিন ব্যাস্ত থাকেন নিজের সুবিধা কত বেশি বাড়ানো যায় সেই তদবিরে। এভাবে তারা অধিকাংশই জনগণের প্রভুতে পরিণত হয়ে যান। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
গ্রামের নিম্নবিত্ত কম শিক্ষিত মানুষ সরকারি অফিসে গেলে অনেক সময় অফিসের বারান্দাতেই উঠতে পারেন না, সেবা তো দূরের কথা। অফিসগুলো সবসময় প্রভাবশালী লোকে লোকারণ্য থাকে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আনাগোনায় অফিসগুলো গরম থাকে। সরকারি অফিসাররা তাদের সেবা দেওয়ার মধ্যেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেন। তারা একসময় মনে করতে থাকেন প্রভাবশালীদের সুবিধা দিতে পারলেই তাদের চাকরি নিরাপদ। আসলে এতে তাদের বিপদ আরো বাড়ে বলে আমি মনে করি। সরকার পরিবর্তন হলেই ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। সুতরাং রাষ্ট্রীয় সম্পদ প্রভাবশালীদের পকেটেই বেশী চলে যায়।
অন্যদিক, গ্রামের নিম্নবিত্ত কম শিক্ষিত মানুষ বরাবরই বঞ্চিত হচ্ছে। অফিসারগণ জানেন এদের সেবা না দিলেও এদের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই। তাই অফিসে তারা অপাংতেও হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত মানুষগুলো আশ্রয় নেয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে; কিন্তু বিধি বাম তারাও ঐ মানুষগুলোকে সেবার নামে ফতুর করে দেয়। এটাই আমাদের বাংলাদেশ।
সরকারি অফিসগুলোতে আছে জুজুর ভয়। সব কিছুতেই তারা জুজুর ভয় খুঁজে পায়। সব কিছুতেই তারা অডিটের ভয় দেখতে পায়। তারা নেয় না কোন রিস্ক, নেয় না কোন বড় প্রকল্প বা বড় কর্মসূচী। অনেক পরিবর্তন আটকে যায় অডিটের জুজুর ভয়ে। সরকারি প্রতিষ্ঠান তাই দেখা যায় যুগ যুগ ধরে একই নিয়মে চলে চলে সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে।
সচিবালয় থেকে যে বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় তাতে কি পরিমান অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় তা আমাদের সবারই জানা। আর মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোর হালচাল তথৈবচ। ভালো কাজ করে অডিটের দ্বারা কোন অফিসার বড় ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা দেখা যায় না। আমি যদি অনিয়ম করি তখন তো সমস্যা হবেই। তাই বলে ভালো কোন কাজের রিস্ক নিবো না? তাহলে দেশ কিভাবে আগাবে? দেশের কাছে শুধু চাইবো কিন্তু বড় কাজ করব না, রিস্ক নিবো না তা তো হতে পারে না।
নতুন কোন কাজ করতে গেলেই আইনের দোহাই খুজতে থাকে অধিকাংশ সরকারি অফিস। হ্যাঁ, আইন অবশ্যই দেখতে হবে; কিন্তু আইনের দোহাই দিয়ে নতুন কাজ হাতে না নেওয়া, ভালো কাজে হাত না দেওয়া কর্তব্যে অবহেলার শামিল। ভালো কাজ করতে গেলে ছোট-খাটো অনেক বিষয় অভারলুক করতে হয়। সারা পৃথিবী এভাবেই এগিয়ে যায়।
অনেক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করতে হয়, নিয়মের অনুকূল ব্যবহারের জন্য মানুষের মতামত নিতে হয়। দালিলিক মতামত নিলে আর কোন রিস্ক থাকে না। কিন্তু আমি যদি কাজই করতে না চাই তখন ভিন্ন বিষয়। আমি কাজ করবোই, আমি পরিবর্তন আনবোই এই মনোভাব থাকলে কোন কিছুই সমস্যা না। জনগণের জন্য ভালো কিছু করা, দেশের জন্য কিছু করা কী ইবাদত নয়? ভালো কাজ করা কী আনন্দের বিষয় না, সুখের বিষয় না? ‘প্রকৃতির আশীর্বাদ’ বলে একটা কথা আছে। মানুষের জন্য কিছু করলে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা তার সহায় হন।
অফিস কেবল টাকা উপার্জনের মেশিন হতে পারে না। শুধু নিজের সুবিধা-অসুবিধা চিন্তার জায়গা না। এটা দেবার জায়গা, নেবার জায়গা। না দিলে নেবার অধিকার কী থাকে? অফিসগুলোতে নিজের এবং নিজের পরিবারের সুবিধা-অসুবিধার কথা যতটা ভাবা হয় ততটা যদি পেশাদারিত্বের কথা ভাবা হতো তাহলে দেশকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। নিজের কথা, পরিবারের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ, আমরা পরিবারের জন্যই চাকরি করি। কিন্তু সেটা হতে হবে নৈতিক, যৌক্তিক এবং আইন দ্বারা জবাবদিহিমূলক। পরিবার বাঁচলে দেশ বাঁচতে নাও পারে। কিন্তু দেশ বাচলে পরিবার ও আমি বাঁচবো। দেশ এগিয়ে গেলে আমিও তার সুবিধা পাবো। আমার পরিবারও সুবিধা পাবে। অফিসে আমি কাউকে হয়রানি করলে আমার সন্তানও অন্যের দ্বারা হয়রানি হবে এটাই চিরন্তন।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক