Sunday 27 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দূর্ঘটনার বাংলাদেশ: কবে থামবে এই মৃত্যুর মিছিল?

সুমন বৈদ্য
২৭ জুলাই ২০২৫ ১৬:০১

২১ জুলাই যেন এক বিভীষিকাময় সকাল হয়ে ধরা দেয় বাংলাদেশের ইতিহাসে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে আছড়ে পড়ে প্রশিক্ষণরত একটি বিমান। মুহূর্তেই স্কুলচত্বর পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। পাইলটসহ প্রাণ হারায় বহু শিশু, যারা মাত্রই ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছিল। হাসপাতালের বেডে পুড়ে যাওয়া অগণিত শিশুর চিৎকার যেন গোটা জাতির বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট—তবুও, যেন আমরা প্রতিবারই অভ্যস্ত হয়ে উঠি এই মৃত্যুর মিছিলে। আর সেইসাথে ভুলেই যায় এই দূর্ঘটনার মধ্যে আটকে থাকা বাংলাদেশকে উদ্ধার করার অঙ্গীকার।

আমরা অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখেছি, দেখেছি নানা সহিংসতা ও দমন-পীড়নের পরিণতি। কিন্তু শিশুদের এমন নির্মম ও অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর মিছিল-তা কল্পনাকেও হার মানায়। একজন বাবা, একজন মা, একজন শিক্ষক বা সচেতন নাগরিক হিসেবে আজ আমরা সবাই অসহায়, সবাই ব্যথিত। এমন ঘটনায় শুধু একজন সন্তানের মৃত্যু ঘটে না; একেকটি পরিবারের সব সুখ যেন চোখের সামনে ছারখার হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

এই দুর্ঘটনার জন্য দায় কার? শুধুই প্রশিক্ষণ বিমানের ত্রুটি? নাকি এর গভীরে লুকিয়ে রয়েছে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার ভয়াবহ পরিণতি? আমরা কি প্রশ্ন তুলতে পারি না—শহরের অভ্যন্তরে এমন ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল কিভাবে সম্ভব হয়? কারা এসব অনুমোদন দেয়? কাদের গাফিলতিতে প্রতিনিয়ত এমন ভয়ঙ্কর অনিরাপত্তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে?

আজকের এই ভয়াবহতার দায়ভার পুরোপুরি ব্যবস্থাপকদের কোনোমতেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। উন্নয়নের কথা বললেই সব দায় মিটে না। শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত কোনও সমাজ সভ্য হতে পারে না। দুর্নীতি, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবেই এসবের মূলে আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো ধসে পড়েছে। একটি কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের মানুষ নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিলো, কিন্তু মাঝপথে এসেই যেনো পথভ্রষ্ট হয়ে গেলো‌।

শুধু কি বিমান দুর্ঘটনা? অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে সড়ক দুর্ঘটনায় বিভিন্ন বয়সের হাজারো মানুষকেই অকালেই পৃথিবীর মায়া চলে যেতে হয়। ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা আজও দেখতে পাই—একটি দুর্ঘটনা ঘটার পর হইচই হয়, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কিছুদিন সংবাদমাধ্যমে আলোচনা চলে, তারপর সব ভুলে যাই। যে মা-বাবা তার সন্তানের পোড়া দেহ বুকে নিয়ে কাঁদছেন, তার কাছে এসব খবরে আসা ‘দায়িত্ববান উচ্চারণ’ এক ধরনের নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।তাই সেই ক্ষত কোনোদিন শুকায় না।

সন্তানদের উপর মা-বাবাদের গভীর ভালোবাসার প্রকাশ দুই চার লাইনে লিখলেও শেষ হবার মতো নয়। তাদের এই স্বার্থহীন ভালোবাসার প্রকাশ দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়াতেও দেখা যায়। মায়ের মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন সন্তানদের শেকলবন্দি করার ছবি, সন্তানকে একা ছেড়ে দিলে কোথায় চলে যাবে, দেখার কেউ নেই এইরকম দুশ্চিন্তার কথাও লিখে থাকেন অনেকেই। এমনকি চা বাগানে পিঠে শিশু সন্তানকে কাঁধে নিয়ে কাজের দৃশ্যও দেখা যায়। সময়ের সাথে এটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক চিত্র মনে হলেও কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিশুদের নিয়ে মা-বাবাদের দুশ্চিন্তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এতে করে সন্তান ও অভিভাবকদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে ‌।

বর্তমানে দেখা যায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোথায় স্কুল করা যায়, কোথায় শপিং মল , কোথায় সরকারের অফিস হবে; কোথায় মাঠ হবে; কোথায় পার্ক হবে; এইসব উচ্চবিলাসী চিন্তায় মগ্ন হয়ে ঘনবসতিপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রতিনিয়ত উপরের দিকে দালান তৈরি করেই যাচ্ছে। কিন্তু এই ঊর্ধ্বমুখী দালানগুলো যখন একটা সময় পর সেকেলে হয়ে যাবে তখন কী হবে তার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রাখে না কেউ। ফলে আমজনতাগণ প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতার ফাঁদের পড়ে যায়, সেই সাথে নানা দুর্ঘটনাৎ মারা যায় বহু মানুষের স্বপ্ন।

দেশে আকস্মিক কোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা ঘটলেই একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিশেষ করে ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় এই বিশৃঙ্খলা বেশি দৃশ্যমান হয়। যানজট ও প্রশস্ত রাস্তা না থাকার কারণে প্রায়ই ফায়ার সার্ভিসের দলকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়। অনেক যুদ্ধ করে পৌঁছানোর পর পানি উৎস পেতে সমস্যা হয়। কোনো বড় শহরেই যথেষ্ট জলাশয় ও হাইড্রেন্ট নেই। রয়েছে সরঞ্জামের সংকটও।

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক আর অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনার মতো দুর্ঘটনা হোক তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার, ত্রাণ, রক্তদানের মতো কাজে হাত দিতে হয় স্থানীয় সাধারণ মানুষকেই। সাধারণ মানুষের অদক্ষতা ও পেশাদার বাহিনীর দেরিতে পৌঁছানোর কারণে অনেক সময়ই প্রাণহানি ন্যূনতম রাখা সম্ভব হয় না।

তাছাড়াও বর্তমান সমাজে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রাকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি কিছু মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টিও সামনে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট মনিটাইজেশন চালু হওয়ার পর থেকেই একটি ভয়ংকর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে—বিপদ বা দুর্ঘটনার মুহূর্তে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে মোবাইল ক্যামেরা অন করে ফুটেজ তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে অনেকে। সাম্প্রতিক কিছু দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের ছবি-ভিডিও ঘেঁটে দেখলেই স্পষ্ট, কীভাবে কিছু মানুষ মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে ‘ভিউ’ আর ‘লাইক’ পাওয়ার লালসায় মত্ত।

বাংলাদেশে কেন যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই এমন বিশৃঙ্খলা দেখতে হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন। অথচ নিউইয়র্কর ‘হাডসনের মিরাকল’-এর মতো ঘটনাগুলোর দিকে যদি তাকাই, যেখানে সুসংগঠিত প্রস্তুতি ও দায়িত্বশীলতা কীভাবে বিপর্যয়কে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

২০০৯ সালে নিউইয়র্কের লা গারডিয়া বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই একটি এয়ারবাস এ৩২০-এর দুটি ইঞ্জিন পাখির আঘাতে হঠাৎই বিকল হয়ে যায়। ১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে পাইলট ক্যাপ্টেন সালি সুলেনবার্গার নিউইয়র্কের হাডসন নদীর বরফশীতল পানিতে বিমানটি সফলভাবে অবতরণ করান। অবিশ্বাস্যভাবে, বিমানের প্রতিটি যাত্রী ও ক্রু বেঁচে যান। এই ঘটনাকে অনেকে বলেছিলো, ভাগ্য সহায় ছিলো।
তবে পাইলট সালি নিজেই ব্যাখ্যা করেছিলেন যে এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা ছিল না, বরং ছিল ‘দশকের পর দশক ধরে চলে আসা প্রস্তুতির ফলাফল’।

অথচ আমাদের দেশে বিমান দুর্ঘটনা যেনো একটি রীতি নীতিতে পরিণত হয়েছে।দেশে এর আগেও বিভিন্নভাবে বিমান দূর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। ৩৪ বছরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৩২টি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ছিল সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। একদিনেই ৪৪টি বিমান বিধ্বস্ত হয়।

১৭ নভেম্বর ১৯৯৮ – ন্যাঞ্ছাং এ-৫সি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত। একবার পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলানো যাক।

২৬ অক্টোবর ১৯৯৮ – এফ-৭এমবি বিধ্বস্ত।

৮ মে ১৯৯৬ – একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত।

১৯৯৪ – একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত।

১৯৯৩ – দুটি পিটি-৬ ট্রেনিং বিমান সংঘর্ষ, তিন পাইলট নিহত।

১৯৯৩ – একটি এফটি-৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট কুদ্দুস নিহত।

৩০ এপ্রিল ১৯৯১ – ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৪০টি এফ-৬ এবং ৪টি মিল-৮ হেলিকপ্টার সম্পূর্ণ ধ্বংস।

৭ জানুয়ারি ২০০১ – এফটি-৭বি ট্রেনার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত, স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ মহসিন নিহত।

৩০ জুলাই ২০০২ – এ-৫সি যুদ্ধবিমান, চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট আদনান নিহত।

১৯ অক্টোবর ২০০২ – এমআই-১৭-২০০ হেলিকপ্টার, কক্সবাজার উখিয়ায় বিধ্বস্ত, ৪ জন নিহত।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ – এফটি-৭বি বিমান বিধ্বস্ত।

২০০৩ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত।

১৫ নভেম্বর ২০০৩ – পাইপার সেসনা এস-২ বিমান বিধ্বস্ত।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত।

২৪ এপ্রিল ২০০৬ – পিটি-৬, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট ক্যাডেট তানজুল ইসলাম নিহত।

৯ এপ্রিল ২০০৭ – পিটি-৬ ট্রেনিং বিমান, যশোরে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট ক্যাডেট ফয়সাল মাহমুদ নিহত।

৮ এপ্রিল ২০০৮ – এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান, টাঙ্গাইলের পাহাড়িয়া গ্রামে বিধ্বস্ত, স্কোয়াড্রন লিডার মোরশেদ নিহত

১৬ জুন ২০০৯ – এফটি-৬ যুদ্ধবিমান, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত

২২ অক্টোবর ২০০৯ – পিটি-৬ ট্রেনার বিমান, বগুড়া সদরে বিধ্বস্ত

২০১০ – এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান, পতেঙ্গায় বিধ্বস্ত।

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান, কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত।

২০ ডিসেম্বর ২০১০ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান, বরিশালে বিধ্বস্ত, দুই স্কোয়াড্রন লিডার নিহত।

৮ এপ্রিল ২০১২ – এল-৩৯ অ্যালবাট্রস জেট ট্রেনার, মধুপুরে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট রেজা শরীফ নিহত।

২০ মে ২০১৩ – এল-৩৯ প্রশিক্ষণ বিমান, যশোরে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে।

১৪ জুলাই ২০১৩ – ন্যাঞ্ছাং এ-৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত।

৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত।

৩০ এপ্রিল ২০১৪ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত।

১৩ মে ২০১৫ – এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার, শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত, ১ প্রশিক্ষক নিহত।

২৯ জুন ২০১৫ – এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান, পতেঙ্গা উপকূলে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট তাহমিদ নিহত

২১ জুলাই ২০১৫ – এমআই-১৭১এসএইচ হেলিকপ্টার, মিরসরাইয়ে জরুরি অবতরণকালে ক্ষতিগ্রস্ত

১১ জুলাই ২০১৭ – ইয়াক-১৩০ চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় বিধ্বস্ত, পাইলটরা ইজেক্ট করেন।

২ জানুয়ারি ২০১৮ – মিল এমআই-১৭ হেলিকপ্টার, শ্রীমঙ্গলে বিধ্বস্ত, কুয়েতি সামরিক কর্মকর্তা-সহ।

১ জুলাই ২০১৮ – কে-৮ডব্লিউ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত, দুই পাইলট নিহত।

২৩ নভেম্বর ২০১৮ – এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমান, টাঙ্গাইলে রকেট ফায়ারিং অনুশীলনের সময় বিধ্বস্ত, পাইলট নিহত।

৯ মে ২০২৪ – ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান, কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বিধ্বস্ত; স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ নিহত।

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি; এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি ব্যবস্থাপনার অবহেলার ফল এবং এই রক্তাক্ত দিনটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়-আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কতটা ভয়াবহ ফাঁক রয়েছে। কারণ বিদ্যালয়ে শিশুমৃত্যু কেবল সংখ্যাতত্ত্ব নয়, এটা গোটা জাতির চেতনার মৃত্যু!

একটি শিশু হারানো মানে একটি ভবিষ্যৎ জাতি হারানো। এত সংখ্যক শিশুর মৃত্যু শুধু অব্যবস্থাপনার কারণে। একটি স্কুলের এত কাছ দিয়ে বারবার প্রশিক্ষণ বিমান উড়ে যাবে—এই অনুমোদন কে দিল? অথবা বিমান চলাচল করে-এমন এলাকায় স্কুলের অনুমোদনও বা কীভাবে হলো? কে এই ভুল সিদ্ধান্তের দায় নেবে? এই প্রশ্নগুলো এখন কেবল সাংবাদিক বা পরিবার নয়, গোটা জাতির জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে– বিমান প্রশিক্ষণ নাগরিক এলাকাজুড়ে কেন?

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে দেখা গেছে—নিরাপত্তা কিংবা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি অনেক সময় কাগজেই থাকে। বাস্তবায়নে থাকে শৈথিল্য, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং অদৃশ্য সুবিধার সমঝোতা। তা না হলে প্রশিক্ষণ বিমানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ যান যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে পারে—তাহলে এর মানে রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকের নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আজ সমগ্র জাতির মুখে একই প্রশ্ন– এ দুর্ঘটনায় কি রাষ্ট্র দায় এড়াতে পারে?

আজ যারা কাঁদছে, আগামীকাল তারা ন্যায়বিচারের জন্য পথে নামবে। এই শোক যদি প্রতিবাদে পরিণত হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে তাদের জবাব দিতেই হবে। কারণ যারা হারিয়েছে তারা কেবল সন্তান নয়, নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়েছে। তাই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে ঝুঁকিপূর্ণ সবধরনের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নীতিমালা নতুন করে পর্যালোচনা ও প্রয়োগ করতে হবে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে আজীবন সুরক্ষা দিতে হবে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

কেউ যদি দোষী হয়ে থাকেন, সেটাও আলোচনা থেকে হারিয়ে যায়। কোন একটি দুর্ঘটনা ঘটলে পুনরায় একটি নতুন করে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, তাই সবাই আশায় বুক বেঁধে থাকে এবার কি সেই দুষ্টচক্র ভাঙতে পারব?দিনের পর দিন এত এত মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে মানুষের অনুভূতিগুলো হয়তো মৃত হয়ে গেছে। এর থেকেই কোনো টেকসই ব্যবস্থা গড়ে উঠে না। এভাবেই বছরের পর বছর মায়াকান্নার বেড়াজালেই প্রতিকার হারিয়ে যায়। এমনই যখন ব্যবস্থা, তখন এ ধরনের বিপদ ও দুর্ঘটনাকে স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স বলা যেতেই পারে।

একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা না থাকার জন্য এর দায় আমরা কাউকে নিতে ও দিতে দেখি না। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবার, মা–বাবা কি এসব স্মৃতি কখনো ভুলতে পারবে? এই যে অব্যবস্থাপনা দায়ের সাথে যারা জড়িত কখনো কি সেই মা–বাবার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভেবেছে? আর কতো সঠিক পদক্ষেপহীনতা এবং অব্যবস্থাপনার দায় নিয়ে চলতে থাকবে সাধারণ মানুষ?? কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এই প্রশ্নের উত্তর নির্বাক বা চুপচাপ করে থাকাটাই যেনো আর কোনো উত্তর হয়তো জানা নেই।

বিমান দুর্ঘটনার সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রধান কারণ মনুষ্যসৃষ্ট। গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ৭০% দুর্ঘটনা মানবসৃষ্ট ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। যেমন অবতরণের সময় ভুল গতি নির্বাচন, উচ্চতা নির্ধারণে সমস্যা, অভিজ্ঞতা ঘাটতি বা প্রশিক্ষণের দুর্বলতা, ক্লান্তি, স্ট্রেস বা মনোযোগ বিচ্যুতি, গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের ভুল নির্দেশনা বা যোগাযোগ বিভ্রাটের কারণে বিমান দুর্ঘটনা হতে পারে।

এছাড়াও যান্ত্রিক ত্রুটিও একটি বড় কারণ হতে পারে। কারণ বিমান যন্ত্রাংশে যে কোনো ত্রুটি গুরুতর দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। ইঞ্জিন ফেইল, হাইড্রোলিক সিস্টেম বা ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি, অটো পাইলট সিস্টেমে গ্লিচ বা অকার্যকারিতা, দীর্ঘদিন ব্যবহারে যন্ত্রপাতির অবক্ষয়, রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতি বা ভুল রিপেয়ারিং প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ অর্থাৎ ঘন কুয়াশা, বজ্রপাত বা তীব্র ঝড়, বার্ড হিট, অচেনা বায়ু প্রবাহ , টার্বুলেন্স, অপ্রত্যাশিত ঝোড়ো হাওয়া বা অবতরণের সময় বাহ্যিক প্রভাব বা নিরাপত্তা ঘাটতি, নাশকতা বা সন্ত্রাসী হামলা বিমান চালনার এলাকা অসুরক্ষিত বা অপরিকল্পিত স্কুল বা কলেজ কিংবা জনবহুল স্থানে উপর দিয়ে ফ্লাইট অনুমোদন কিংবা বিমান যাত্রার রূপ প্লানিং এ ভুল, পর্যাপ্ত রানে বা জরুরি অবতরণ ব্যবস্থা না থাকার ফলেও বিমান দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

তাছাড়া প্রশিক্ষণ বিমানের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু কারণ থাকে। প্রশিক্ষণ বিমানগুলোতে সাধারণত নবীন পাইলট থাকেন, তাই অতিরিক্ত কিছু ঝুঁকি থাকে: ইন্সপেক্টর ও ট্রেইনি পাইলট এর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, দ্রুতগতির কৌশল চর্চা করতে গিয়ে ব্যর্থতা, কম উচ্চতায় মহড়ার চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণ হারানো, পুরাতন ট্রেইনার মডেল বা সীমিত টেকনোলজি ব্যবহার করলেও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। অথবা পাইলটের ক্লান্তি বা অবসাদগ্রস্ততা, হালকা যান্ত্রিক ত্রুটি বা আবহাওয়া খারাপ — এই তিনের সম্মিলন ঘটলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বিমান দুর্ঘটনা এড়াতে কিছু পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর। এগুলো কেবল সামরিক বা বাণিজ্যিক বিমানেই নয়, প্রশিক্ষণ বিমানসহ সব ধরনের বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য: পাইলট ও ক্রুর প্রশিক্ষণ উন্নত করা, নিয়মিত সিমুলেশন প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক, নতুন পাইলটদের জন্য পর্যাপ্ত সুপার ভাইজড ফ্লাইট আওয়ার নিশ্চিত করা, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য যাচাইয়ের নিয়মিত ব্যবস্থা থাকতে হবে।

দুর্যোগ ও দুর্ঘটনার ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়; কিন্তু টেকসই ব্যবস্থার জন্য যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি সেটি অনেকাংশেই অনুপস্থিত থাকে। স্কুলের বাচ্চাদের মৃত্যু আমাদের আবারও সেই দুর্বলতার কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই, এই অসহনীয় ঘটনায় বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক আলাপ শুরু হবে।এ ধরনের গণসচেতনতাও সবার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

উদ্ধারের পরে আসে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করে যেতে হবে। কিছু হলেই বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতির যে ঐতিহাসিক প্রবণতা, সেটি থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ যদি এখনো না নেওয়া হয়, তাহলে আর কবে সে বিষয়ে ভাবা হবে?

যদি জনগণের যথাযথ চিকিৎসাসেবা, বিশেষ করে আপৎকালীন চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা দিতে না পারি, তাহলে সেটা হবে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য একটি চূড়ান্ত ব্যর্থতা। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি।

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা একটি উপেক্ষিত বিষয় হলেও আমাদের এ প্রেক্ষাপটে শিশু ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের শিক্ষকদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা, এমন একটি দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া একজন মানুষকে সেই মানসিক আঘাত সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে। তাই এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা জরুরি।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে স্কুলকে এ বিষয়ে যথাযথ সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যদিকে বিমানে দূর্ঘটনা এড়াতে নির্দিষ্ট সময় পর পর Routine Maintenance বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি ফ্লাইটের আগে ও পরে Pre-flight & Post-flight Inspection চালু করতে হবে। ওভারহোলিং ও যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন যথাসময়ে সম্পন্ন করতে হবে। আধুনিক ওয়েদার রাডার ও পূর্বাভাস প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। গুরুতর আবহাওয়ার সময় ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বে পরিচালনার নিয়ম প্রয়োগ করতে হবে। জনবহুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদির উপর দিয়ে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট নিষিদ্ধ করতে হবে।

প্রশিক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট, নিরাপদ এলাকা ও রুট চিহ্নিত করতে হবে। বিমান চলাচল এলাকা ও আকাশপথ পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। বিমান পরিচালনার নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ফ্লাইট সেফটি প্রটোকলস বাধ্যতামূলক করতে হবে।

এছাড়াও জরুরি প্রতিক্রিয়া যোগাযোগ পদ্ধতি আরো শক্তিশালী করা যাতে দ্রুত উদ্ধার ও জরুরি সহায়তা প্রস্তুত রাখা জরুরি। সেইসাথে বিমানবন্দর ও প্রশিক্ষণ এলাকার কাছে উদ্ধারকারী ইউনিট, অগ্নিনির্বাপক দল, প্রাথমিক চিকিৎসা রাখতে হবে।এছাড়া দুর্ঘটনার সঠিক তদন্ত ও প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি দুর্ঘটনার ‘স্বাধীন তদন্ত কমিটি’ গঠন করতে হবে। তদন্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

দিন শেষে প্রতিটি বাবা-মার সবচেয়ে বড় চাওয়া-তাদের সন্তান যেন নিরাপদে থাকে। কিন্তু আজকের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, সেই কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। যেখানে শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার কথা, সেখানে প্রায়শই শোনা যায় সহিংসতা, নিপীড়ন কিংবা অবহেলার খবর। সামাজিক অবক্ষয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার, নৈতিকতার সংকট এবং আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা মিলে একটি অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করেছে। ফলে বাবা-মার মনে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে উৎকণ্ঠা ও ভীতি।

তাই পরিশেষে বলতে চাই, রাষ্ট্রকে তার জনগণের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে যা করণীয়, তা করতে হবে। অন্যথায় এই ধরণের দূর্ঘটনা দিনকে দিন ত্রুটিপূর্ণ এবং অবহেলার কারণে যেমন সংগঠিত হতে থাকবে, অন্যদিকে মৃত্যুর মিছিল প্রতিরোধ করাও যেনো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাই এই দূর্ঘটনায় কবলিত বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে সঠিক বাস্তবায়ন ও কঠোর পদক্ষেপ গৃহীত করার সময় এখনই।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

দূর্ঘটনার বাংলাদেশ মুক্তমত সুমন বৈদ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর