বর্তমান হারে পৃথিবীর জনস্যংখ্যা বাড়লে ২০৫০ সালে পৃথিবীর জন্যসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি। এই জনসংখ্যার খাদ্য, চিকিৎসা সহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের ক্ষেত্রে সমুদ্র তথা ব্লু-ইকোনমির বিকল্প ভাববার কোন অবকাশ নেই। ব্লু-ইকোনমি হল সমুদ্র এবং উপকূলীয় অঞ্চলের সম্পদ ব্যবহার করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি ধারণা। এটি মৎস্য আহরণ, পর্যটন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, খনিজ সম্পদ আহরণ এবং সমুদ্র পরিবহন সহ বিভিন্ন খাতে সুযোগ তৈরি করে। সর্বপ্রথম ১৯৯৪ সালে বেলজিয়ামের অধ্যাপক Gunter Pauli টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু-ইকোনমির ধারণা দেন।বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি বহুবিধভাবে অবদান রেখে চলেছে। বছরব্যপী ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। বিশ্বের ৮.২ বিলিয়ন মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানী তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। তবে আমাদের মতো দেশের ব্লু- ইকোনমির উন্নয়নে কিছু সমস্যা বা চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নীতিমালা ও দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং পরিবেশগত ঝুঁকি।
আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার বেশি সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের। এছাড়া ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৪৫ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহিসোপানের তলদেশে সব ধরণের প্রাণিজ অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের ১২টি পেয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় শূন্য দশমিক ১১ থেকে শূন্য দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট থাকার বিষয়টি অনুমিত হয়েছে, যা ১৭ থেকে ১০৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের সমান।
বিশ্ব অর্থীনীতিতে ব্লু- ইকোনমির গুরুত্ব:
আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন ছোট বড় দেশ ব্লু-ইকোনমি নির্ভর উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন করেছে। ব্লু-ইকোনমিতে ইন্দোনেশিয়ার সাফল্যের কথা তুলে ধরা যেতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। দ্য জাকার্তা পোস্টে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে দ্য লমবক ব্লু-ইকোনমি বাস্তবায়ন কর্মসূচি ৭৭ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করার পাশাপাশি প্রতিবছর ১১৪.৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করবে। গৃহীত কর্মসূচী পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা গেলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় বাজেটের দশগুণ হবে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্লু-ইকোনমির অবদান ছিল ৩৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা জিডিপির ২% এবং কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ মিলিয়ন মানুষের। গত পাচ বছরে চীনের অর্থনীতিতে ১.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্লু-ইকোনমি বা ১০% জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ব্লু -ইকোনমির পমিরাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৫০০ বিলিয়ন ইউরো অর্জিত হয়েছে।মরিশাসের মতো একটি দেশের জিডিপিতে ব্লু-ইকোনমির অবদার ১০%।
বাংলাদেশের অর্থীনীতিতে ব্লু-ইকোনমির গুরুত্ব:
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্লু- ইকোনমির অবদান জিডিপির ৩% বা ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশের ৩০ মিলিয়ন মানুষের জীবন জীবিকা ব্লু-ইকোনমির ওপর নির্ভরশীল। Bangladesh Oceanographic Research Institute -এর মতে ২০২৮ সালের মধ্যে ব্লু- ইকোনমি থেকে ২০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা জিডিপির ৪৬% আয় করা সম্ভব। ব্লু-ইকোনমি’র সামুদ্রিক মৎস্য, সমুদ্র ভিত্তিক জ্বালানী ( তেল,গ্যাস ইত্যাদি), খনিজ পদার্থ, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙ্গা, নবায়নযোগ্য শক্তি (সৌরতাপ, বাতাস, ঢেউ ইত্যাদি), লবণ শিল্প এবং পর্যটন খাতে অবদান রাখার সুযোগ আছে।
বাংলাদেশে ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র সমূহ:
১. মৎস্য আহরণ: বঙ্গোপসাগর হতে প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরা হলেও আমরা মাত্র ০.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরতে পারছি। বঙ্গোপসাগর থেকে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা হয়।তারপরও বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে আমাদের ব্লু ইকোনমির অর্জন ও সম্ভাবনা অনেক বেশি। বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি মাছ, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক এবং বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে এবং ১১ প্রজাতির নতুন মাছের সন্ধান মিলেছে। দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া মৎস্য সম্পদের মধ্যে বিদেশে সবচেয়ে বেশি চাহিদা চিংড়ির। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি হয় কাঁকড়া। দেশে উৎপাদিত কাঁকড়ার প্রায় ৯৮ শতাংশই রপ্তানি হয় চীনসহ ১৭টি দেশে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কাকড়া রপ্তানী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে বিশ্বমানের ৩টি অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবরেটরি পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশে যে পরিমাণ মৎস সম্পদ রয়েছে তার ১৬ ভাগের যোগান দিচ্ছে বঙ্গোপসাগর।বর্তমানে বাংলাদেশের মাছ বিশ্বের ৫৬ দেশে রফতানি হচ্ছে। সর্বাধিক মাছ রফতানিকৃত ১০ দেশ হলো-নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান ও রাশিয়া। বঙ্গোপসাগরে উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক জেলে প্রায় ৭০ হাজার যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌযানের সহায়তায় জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে ০৭ টি মৎস্যকেন্দ্র। মৎস্যসম্পদ ছাড়াও সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতা-গুল্মতেও ভরপুর বঙ্গোপসাগর।
২. জাহাজ চলাচল ও জাহাজ ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণে বিশ্বে ১৩ তম আর শিপ রেকিংয়ে ৩য়। পৃথিবীর মোট জাহাজ ভাঙার ২৪.৮ শতাংশ বাংলাদেশে সম্পাদিত হয়। বাণিজ্যিক পরিবহনের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। প্রতি বছর সমুদ্রপথে ১৫০টিরও বেশি দেশের প্রায় ৫০ হাজারের ওপর বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। বর্তমানে ০৮টি আন্তর্জাতিক মানের জাহাজের মিশ্র বহর নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন সমুদ্রপথে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পতাকা বহন করছে। বর্হিবিশ্বে মালামাল আনা-নেয়ার সুবিধার্থে সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে দুটি আঞ্চলিক অফিস খোলা হয়েছে। দেশের দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষত: চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলকে এ শিল্পের জন্য পরিবেশবান্ধবভাবে কাজে লাগাতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে তা আরো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
৩. সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তি: সামুদ্রিক শৈবাল থেকে প্রাপ্ত আলগিনেট (Alginate) হজম ও গ্যাস্ট্রিক ওষুধে পাকস্থলীতে জেল তৈরি করে এসিড প্রতিরোধে সাহায্য করে। কারাজিনান (Carrageenan) ঠান্ডা-সর্দি ও গলা ব্যথার সিরাপে ঘন পদার্থ তৈরি করে ও গলার ব্যথা উপশম করে। ফুকোইডান (Fucoidan) ক্যান্সার, হেপাটাইটিস ও অ্যান্টিভাইরাল ওষুধে কোষ ধ্বংসকারী ক্ষমতা এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। ল্যামিনারিন (Laminarin) ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধে রক্তে গ্লুকোজ ও প্রেসার কমাতে সহায়ক। এছাড়াও, কিছু সামুদ্রিক শৈবাল থেকে সাবান ও ক্যান্ডির মতো পণ্যও তৈরি করা হয়। জাপান, চীন, কোরিয়াতে সামুদ্রিক শৈবাল খাদ্য হিসেবে ব্যাপক পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। Japan জেলিফিশের কোলাজেন দিয়ে চর্মরোগ ও জ্বালা-পোড়া সারানো ঔষধ আবিস্কার করেছে। USA (NIH) জেলিফিশের আলো-নিঃসরণকারী প্রোটিন দিয়ে ক্যান্সার সনাক্তকরণের কাজ করছে। South Korea জেলিফিশ প্রোটিন দিয়ে চুল ও ত্বকের চিকিৎসা করছে। জেলিফিশের শরীরের কিছু অংশে থাকা Bioactive Peptides চোখের কর্নিয়া চিকিৎসায় সাহায্য করতে পারে বলে গবেষণা রয়েছে।
৪. লবণ শিল্পে: বাংলাদেশের লবণ শিল্প একটি সম্ভাবনাময় খাত, বিশেষ করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণ মূলত সমুদ্রের পানি বাষ্পীভূত করে এবং কিছু ক্ষেত্রে অগভীর জলাশয়ের খনিজ সমৃদ্ধ পানি থেকে আহরণ করা হয়। এটি রাসায়নিক শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং অন্যান্য অনেক শিল্পে একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক আন্তর্জাতিক প্রসাধনী কোম্পানি যেমন Lush, The Bodz Shop, এবং ঐরসধষধুধ ব্র্যান্ড লবণ-ভিত্তিক স্ক্রাব ও বাথ সল্ট বাজারজাত করছে।বাংলাদেশেও সামুদ্রিক লবণ ব্যবহার করে হস্তশিল্পভিত্তিক কিছু কসমেটিক কোম্পানি এগোচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে লবণশিল্পের অবদান প্রায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা।
৫. সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি: পৃথিবীর পৃষ্ঠের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে সাগর-মহাসাগর। এই বিশাল সমুদ্র অংশ সম্পদ ও শক্তির ভান্ডার। সমুদ্রের তরঙ্গ বা ঢেউতে রয়েছে গতি শক্তি ও যান্ত্রিক শক্তি। এটাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়। বঙ্গোপসাগরে Wave Energy থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গবেষণা করছে BUET ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূল ঢেউ শক্তির জন্য অনুকূল জোয়ার ভাটার সময় দিনে দুইবার করে সমুদ্রের পানির উচ্চতা কম বেশি হয়। বাঁধ দিয়ে এই উচ্চতার পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে টার্বাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। কুতুবদিয়া ও মহেশখালী উপকূল জোয়ার-ভাটা শক্তির জন্য উপযুক্ত। জোয়ার-ভাটা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে Power Division I Petrobangla. আমাদের দেশের কিছু উপকূলীয় এলাকায় International Renewable Energy Agency (IRENA) সমুদ্রশক্তি গবেষণায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাজ্যের Wave Hub, Cornwal জোয়ার ভাটাকে কাজে লাগিয়ে শতাধিক মেগাওয়াট এবং দক্ষিণ কোরিয়ার Sihwa Lake Tidal Power Plant ২৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। সমুদ্রের উপরিভাগের গরম পানি (২৫ক্ক-৩০ ক্ক সে.) ও গভীর সমুদ্রের ঠান্ডা পানি (৫ক্ক-১০ ক্ক সে.) এই তাপমাত্রার পার্থক্য কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সাধারণত ২০ ক্ক সে. বা তার বেশি পার্থক্য প্রয়োজন হয় কার্যকর উৎপাদনের জন্য। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোন গবেষণা হয় নি। তবে বিশ্বে সর্বপ্রথম জাপান Okinawa OTEC Plant ১০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। ফ্রান্স (ক্যারিবীয় অঞ্চল) Martinique Island ১০ মেগাওয়াট এবং হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্র NELHA OTEC Plant ১০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
৬. খনিজ পদার্থ: বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ৩ হাজার ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মোনাজাইট, জিরকন, রুটাইল, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ফসফরাস, সালফেট ও রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসহ মূল্যবান খনিজ পদার্থের ভান্ডার পাওয়া গেছে। সাগরের তলদেশে পাওয়া গেছে সম্ভাব্য ১০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুত, যা দিয়ে দেশের ১০০ বছরের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বর্তমানে দেশে মাত্র ১৪ বছরের গ্যাস মজুত রয়েছে। খনিজের মধ্যে আরো রয়েছে ১৭ ধরনের খনিজ বালু। এর মধ্যে ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, মোনাজাইট, কায়ানাইট, লিকোক্সিন উল্লেখযোগ্য। এ আটটি খনিজ বালু বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। এগুলোর দামও বেশি। বঙ্গোপসাগরের অর্জিত সমুদ্রসীমা থেকে বছরে প্রায় ১০ লাখ টন এসব খনিজ বালু আহরণ করা সম্ভব। সাগরের তলদেশে ক্লেসার ডেপোজিট, ফসফরাস ডেপোজিট, এভাপোরাইট, পলিমেটালিক সালফাইড, ম্যাঙ্গানিজ নডিউল, ম্যাগনেসিয়াম নডিউল নামক খনিজ পদার্থ আকরিক অবস্থায় সঞ্চিত আছে। এদের নিষ্কাশন করে লেড, জিংক, কপার, কোবাল্ট, মলিবডেনামের মতো দুষ্প্রাপ্য ধাতুগুলো আহরণ করা সম্ভব হবে। এসব দুষ্কর ধাতু উড়োজাহাজ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া এ খনিজ পদার্থগুলো দিয়ে মোবাইল, ব্যাটারি, গাড়ি, সৌর প্যানেল, অলঙ্কার, স্টিল, রাসায়নিক দ্রব্য, নির্মাণসামগ্রীসহ বহু আধুনিক জিনিসপত্র তৈরি হয়। এগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ আছে। সামুদ্রিক স্পজ্ঞ থেকে প্রাপ্ত Avarol, HHalichondrin যৌগ ক্যান্সার প্রতিরোধে এবং ভাইরাসবিরোধী ঔষধ (HIV) উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সামুদ্রিক শৈবাল (Seaweed) এর উপাদান Fucoidan, Carrageenan থেকে অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিক্যান্সার ওষুধ এবং রক্ত পাতলা করার ওষুধ (anti-coagulants) তৈরী হয়। বঙ্গোপসাগর শুধু খনিজ ও শক্তির ভা-ার নয়, বরং এটি ঔষধ শিল্পের জন্য এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এই খনিজ ও জীববৈচিত্র্েযর সঠিক গবেষণা এবং ব্যবহার বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে বিশ্বমানের করে তুলতে পারে।
৭. সামুদ্রিক পর্যটন: আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত (১২০ কি.মি) হিসেবে ও প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারলে এ অঞ্চলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৭ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, যা সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৩.৭ শতাংশ। এছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য উপকূলীয় জেলাতে পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। খুলনা-সাতক্ষীরার সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল হিসেবে কুয়াকাটা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার একমাত্র উপকূল বিবেচনায় এবং মহেশখালী ও সোনাদিয়া দ্বীপ পরিবেশ বান্ধব পর্যটনের সম্ভাবনা অনেক। Blue Economy Master Plan (২০২০) অনুযায়ী, সামুদ্রিক পর্যটন হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকা শক্তি। বঙ্গোপসাগরের ৭২০ কিমি উপকূল ও ৭টি দ্বীপ ব্যবহার করে মালদ্বীপ মডেলে ট্যুরিজম গড়ে তোলা সম্ভব।
৮. সামুদ্রিক বাণিজ্য: বঙ্গোপসাগর হচ্ছে বিশ্বের ৬৪টি উপসাগরের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ উপসাগর। এই সাগরতীরে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাই উপকূলে বাস করে কয়েক কোটি মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের মূল কেন্দ্রে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমীক্ষা (Economic Survey), Blue Economy Cell, Ministry of Foreign Affairs, বিশ্ব ব্যাংক ও UNDP রিপোর্ট এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসেবে মতে সামুদ্রিক বাণিজ্যে বর্তমান আয় প্রায় ৭০,০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিশাল খনি।তবে যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে এ আয় কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। ব্লু-ইকোনমি বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছে। সমঝোতা চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপানও। এছাড়া গ্যাসসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্যসম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশে ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এরই মধ্যে পাঁচ ধরনের কৌশল নেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা, উপকূলীয় জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সমুদ্র বন্দর গুলোর আধুনিকীকরণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি, অগভীর ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কার্যক্রম জোরদারকরণ, সমুদ্রে ইকোট্যুরিজম ও নৌ-বিহার কার্যক্রম চালু করা, সমুদ্র উপকূল ও সমুদ্রবন্দরগুলোকে দূষণমুক্ত রাখা।
বাংলাদেশ সরকার RV Meen Shandhani নামের গবেষণা জাহাজ ২০১৬ সালে মালয়েশিয়া ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ক্রয় করে। এটি ২০১৬ থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরে স্থাপিত ও উচ্চ-প্রযুক্তি সংবলিত, যা ২০১৬-২০১৯ পর্যন্ত প্রায় ২৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে ও ২৪ ভ্রমণে সমুদ্রজুড়ে স্টক মূল্যায়ন করেছে।বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (BOCRI) এবং জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ (GSB) বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় জরিপ পরিচালনা করেছে। কক্সবাজার, টেকনাফ, মহেশখালী এবং চট্টগ্রামের উপকূলে ভারী খনিজ বালুর অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে।
RV Fridtjof Nansen, নরওয়েজিয়ান FAO পরিচালিত গবেষণা জাহাজ ২০১৮ সালে বাংলাদেশে এসে ইকোসিস্টেম ও জলবায়ু সহ মাছ এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য জরিপ করেছে। ১৯৭৩, ১৯৭৯-৮০, ১৯৮১-৮৩, ১৯৮৪-৮৬ সালে বিভিন্ন গবেষণা কর্মকর্তা ও জঠ ভেসেল দিয়ে সার্ভে চালানো হয়, যার মধ্যে ডেমার্সাল (সামুদ্রিক তল) মাছের স্টক পূর্বে প্রায় ১.৫-১.৮ লাখ মেট্রিক টন হিসেবে ধরা হয়। সর্বশেষ গবেষণায় ১৫টি বাণিজ্যিক মাছ নিয়ে এবং জিনগত মার্কার (mtDNA) ব্যবহার করে stock assessment ও population genetic studies ২০১৯-২০২২ সালের মধ্যে পরিচালনা করা হয়েছে, যার ফলে মাছের শোষণ, overexploitation ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নির্ধারণ করা হয়েছে। Swatch of No Ground Marine Protected Area (প্রায় ১,৬৩৬ sq km) ২০১৪ সালে ঘোষণা করা হয়। এটি প্রথম মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া (MPA) যা ডলফিন, হোয়েল শার্ক, sea turtles, সনাতক মাছ ও অন্যান্য জীবের জন্য সংরক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত।
ব্লু-ইকোনমি বাস্তবায়নে যেসব পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে তা হলো- ফিজিক্যাল অ্যান্ড স্পেস ওশানোগ্রাফিক সম্পর্কিত বেইজ লাইন-ডেটা নির্ধারণ। পটেনশিয়াল ফিশিং জোন চিহ্নিতকরণ। সমুদ্র পর্যবেক্ষণ এবং রিয়েলটাইম ডেটা সিস্টেম চালুকরণ। ভূ-তাত্ত্বিক ওশানোগ্রাফি সম্পর্কিত বেইজ লাইন ডোটা নির্ধারণ। বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি সম্পর্কিত বেইজ লাইন ডেটা নির্ধারণ ও একোয়াকালচার করা। কেমিক্যাল ওশানোগ্রাফি সম্পর্কিত বেইজ লাইন ডোটা সমৃদ্ধকরণ। সমুদ্র তীরবর্তী দূষণরোধ। ওশানোগ্রাফিক ডেটা সেন্টার স্থাপন, উন্নয়ন এবং ডেটা সমৃদ্ধকরণসহ সমুদ্রবিষয়ক তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নয়ন।
ব্লু-ইকোনমিতে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ সমূহ-
১. মৎস্য ও সামুদ্রিক খাদ্য খাতে চ্যালেঞ্জ: বিজ্ঞানভিত্তিক মাছ জরিপ সীমিত। সামুদ্রিক মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। জলবায়ু পরিবর্তনে মৎস্য অভিবাসন ও বিপন্নতা বাড়ছে।
২. তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানে প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাব।
৩. সামুদ্রিক খনিজ সম্পদ যেমন: ইলমেনাইট, থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম ইত্যাদির এখনো পর্যন্ত বাণিজ্যিক উত্তোলন শুরু হয়নি।
৪. পর্যটন (Coastal and Marine Tourism) খাতে ব্যবস্থাপনা দুর্বল, কক্সবাজার বা সেন্ট মার্টিনে অব্যবস্থাপনা ও দূষণ।
৫. নৌপরিবহন ও বন্দরের নাব্যতা সংকট ও আধুনিক ডিপ-সি বন্দর পরিচালনার ঘাটতি। নৌযান ও কার্গো সেবা উন্নয়নে ধীরগতি। আন্তর্জাতিক নৌপথের সঙ্গে সংযুক্তির দুর্বলতা।
৬. সামুদ্রিক শৈবাল ও জৈব সম্পদ গবেষণা ও চাষের উদ্যোগ খুবই সীমিত। আন্তর্জাতিক বাজারে সামুদ্রিক শৈবাল রপ্তানি নেই বললেই চলে। উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির ঘাটতি।
৭. জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিনষ্টে বঙ্গোপসাগরে দূষণ, প্লাস্টিক ও জাহাজ বর্জ্য দ্রুত বাড়ছে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বায়োস্ফিয়ার বা ন্যাশনাল পার্ক পর্যাপ্ত নয়।
বঙ্গোপসাগরভিত্তিক ব্লু ইকোনোমি শুধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি নতুন দিগন্ত নয়, বরং এটি টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। সামুদ্রিক সম্পদ যেমনÑমৎস্য, খনিজ, পর্যটন, জাহাজ চলাচল এবং নবায়নযোগ্য শক্তি-এই সবই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবে এই সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, পানি দূষণ, অবৈধ মাছ ধরা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ব্লু ইকোনোমি হুমকির মুখে পড়ছে। তাই এখনই প্রয়োজন:পরিবেশবান্ধব ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা, মেরিন গবেষণায় বিনিয়োগ,আইন প্রয়োগে কঠোরতা, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি, একটি ভারসাম্যপূর্ণ, টেকসই ও অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্লু ইকোনোমি গড়ে তুলতে পারলেই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে একটি সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতির বিশ্বনেতায় পরিণত হতে পারবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম