Sunday 27 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চীনের জলবিদ্যুৎ বাঁধ: কতোটা ক্ষতি করবে ভারত ও বাংলাদেশের

সাইফুল ইসলাম শান্ত
২৭ জুলাই ২০২৫ ১৮:১৭

চীন তিব্বত মালভূমির পূর্ব প্রান্তে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। আনুমানিক ১৭০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এই প্রকল্পটি ইয়ারলুং জাংবো (ভারতে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত) নদীতে স্থাপিত হচ্ছে, যা ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। বিশাল এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার পানি নিরাপত্তা, পরিবেশ ও লাখ লাখ মানুষের জীবিকার উপর এক গভীর প্রভাব ফেলতে চলেছে।

যদিও চীনা কর্মকর্তাদের মতে, তিব্বতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি পরিবেশ বা ভাটিতে জল সরবরাহে বড় কোন প্রভাব ফেলবে না। তবুও প্রতিবেশী ভারত বাঁধটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থাগুলোও বলছে এই বাঁধটি তিব্বতের মালভূমির অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করবে।

বিজ্ঞাপন

চীনের সীমান্তবর্তী ভারতের অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আগেই সতর্ক করেছেন যে এই বাঁধের কারণে তাদের রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ৮০ শতাংশ নদী শুকিয়ে যেতে পারে এবং নিচের দিকে আসাম রাজ্যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে। আর প্রতিবেশী আসাম রাজ্যে বন্যা হলে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে এটা নিশ্চিত।

আমরা দেখেছি পানি নিরাপত্তা নিয়ে বিরোধ নতুন নয়। প্রতিবেশীদের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে সিন্ধু চুক্তিতে নয়াদিল্লির অংশগ্রহণ স্থগিত করার পর পাকিস্তান ভারতকে বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে ভাগ করা পানি সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ করেছে। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে পানি সরিয়ে নেয়ার অভিযোগ করে আসছে বাংলাদেশ। ভারত নিজেও ইয়ারলুং ঝাংবো (ভারতে যার নাম সিয়াং নদী) নদীতে দুটি বড় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে একটি হবে ভারতের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।

চীনা সরকার জানিয়েছে, নির্মিতব্য এই বাঁধের বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে, যা তিব্বত এবং চীনের বাকি অংশে স্থানীয় জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সহায়তা করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এককভাবে চীনের এই প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ভয়াবহ পরিবেশগত ও মানবিক সংকট তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য।

ব্রহ্মপুত্র একটি হিমালয় থেকে উৎপন্ন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি তিব্বতের পর ভারত ও বাংলাদেশে যমুনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছেছে। নদীটির প্রবাহে কৃত্রিম হস্তক্ষেপ মানে ভাটির দেশের কৃষি, পানীয় জল, মৎস্য সম্পদ এবং প্রকৃতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বাঁধ কেবল রাজনৈতিক ও কৌশলগত নয় বরং পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা ভাটির দেশগুলো—বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বিঘ্নিত হলে নদীর নিচের দিকে পানির প্রবাহ হ্রাস পাবে, যা শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। বর্ষায় অতিরিক্ত পানির কারনে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।

বাঁধের ফলে নদীতে পানির স্তর ও তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটবে, যা মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর প্রজননে ব্যাঘাত ঘটাবে। নদীভিত্তিক বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট হলে বাংলাদেশের নদীজীবী জনগোষ্ঠী জীবিকা হারানোর আশঙ্কায় পড়বে। বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটির বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর উপর নির্ভরশীল। এই বাঁধের প্রভাবে নদীভিত্তিক জীবিকা হারাবে বাংলাদেশ ও ভারতের বহু মানুষ। কৃষক, জেলে, নৌকার মাঝি এবং নদীকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নদীর পানি প্রবাহ কমে গেলে তা নৌপরিবহন খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তাছাড়া বাঁধটি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় নির্মিত হওয়ায় ভূ-রাজনৈতিক দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই বছরের শুরুতে তিব্বতে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর এই অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের এক জোরালো প্রচেষ্টা নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। একদিকে পানির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ভারত-বাংলাদেশকে দ্বিমুখী বিপদে ফেলবে।

ভারত ইতোমধ্যে প্রকল্পটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশ ও আসাম রাজ্যের নদীনির্ভর অর্থনীতি, সেচ ও পানির ব্যবহার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কেবল একটি পরিবেশগত হুমকি নয় বরং কৌশলগত দিক থেকেও তা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ। পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে চীন ভবিষ্যতে ‘জল অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

আমাদের মনে রাখতে হবে পানি একটি আন্তর্জাতিক সম্পদ, বিশেষ করে তা যখন সীমান্ত অতিক্রম করে। নদীভিত্তিক আন্তঃদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে না তুললে ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রকল্প অঞ্চলজুড়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী, নদীভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু চীন এই বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারত কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে কোন আলোচনা করেনি, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।

এই জলবিদ্যুৎ বাঁধ প্রকল্প চীনের জন্য শুধু একটি উন্নয়নমূলক অবকাঠামো হলেও এটি দক্ষিণ এশিয়ার নদীনির্ভর কোটি মানুষের জীবিকা, পরিবেশ ও অস্তিত্বের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠতে পারে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে হস্তক্ষেপ, পলি আটকে পড়া, প্রাণবৈচিত্র্য হ্রাস, কৃষির ক্ষতি এবং ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি এই প্রকল্প আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে উঠেছে। তাই ভারত-বাংলাদেশের উচিত হবে দ্রুত কূটনৈতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমন্বিত পানিনীতির দাবি তোলা। পানির ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই ব্যবস্থাপনার নিশ্চয়তা না থাকলে এই প্রকল্প ভবিষ্যতে ভয়াবহ এক পরিবেশগত ও মানবিক বিপর্যয়ের রূপ নিতে পারে, যার মাশুল দিতে হবে গোটা অঞ্চলকেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

চীনের জলবিদ্যুৎ বাঁধ মুক্তমত সাইফুল ইসলাম শান্ত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর