৩১ জুলাই, ২০২৫ সাল। কিছুক্ষণ আগে সংবাদ দেখলাম, গাজায় ত্রাণ নিতে এসে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৭১ জন। আর আগের দিন অর্থাৎ ৩০ জুলাই ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর গোলাবর্ষণে ফিলিস্তিনের গাজার উপত্যকায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১০৪ জন এবং আহত হয়েছেন আরো অন্তত ৩৯৯ জন। এর চেয়ে নিষ্ঠুর বর্বরতা আর কী হতে পারে?
বিশ্ব থেমে যায়। যুদ্ধ থামে ইউক্রেনে, ইরানে, শান্তি আলোচনার টেবিলে বসে সুদান কিংবা মিয়ানমার। এমনকি মহামারি কোভিড-১৯ এর সময় গোটা দুনিয়া কার্যত স্থবির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটাই ব্যতিক্রম—গাজা। পৃথিবীর কোন ঘটনাই থামাতে পারে না ফিলিস্তিনের এই ছোট্ট ভূখণ্ডের ওপর ইসরাইলি বর্বর হামলা। প্রতিদিন সকাল শুরু হয় বোমার শব্দে, রাত ঘুমিয়ে পড়ে ধ্বংসস্তূপের মাঝে। আর প্রতিদিন গড়ে প্রাণ হারান শত শত নিরীহ মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিকে ‘শিশুদের কবরস্থান’ বলে অভিহিত করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইল যেভাবে গাজায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। প্রতিদিনকার হামলা, অবরোধ, খাদ্য ও ওষুধের সংকট, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা, সব মিলিয়ে গাজা এখন এক চলমান মানবিক বিপর্যয়ের নাম। প্রাণের জন্য যারা দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের কেউ গুলি করে হত্যা করা হয়। অথচ এত নির্মম ঘটনাসমূহ বিশ্ববাসীর বিবেককে নাড়া দেয় না।
২৩ লাখ মানুষের এই ছোট্ট গাজা উপত্যকা বছরের পর বছর ধরে এক প্রকার জেলখানাতে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে চলমান অবরোধের মধ্যে থেকেও মানুষ জীবনধারণ করছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস ও ইসরাইলের সংঘর্ষ শুরুর পর ইসরাইল গাজায় সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে। এরপর শুরু হয় নৃশংস বোমাবর্ষণ। হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, এমনকি জাতিসংঘের পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রও রক্ষা পায়নি। প্রতিদিন সাধারণ মানুষ নিহত হচ্ছে, যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, কেবল পরিচয়, তারা গাজার বাসিন্দা।
অন্যদিকে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বারবার বলে এসেছে, এটি আত্মরক্ষার লড়াই। প্রশ্ন জাগে, একজন দখলদার কীভাবে আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলে? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বলছে, যে ভূখণ্ড কারো দখলে, সেখানে জনগণের ওপর সশস্ত্র হামলা কখনো আত্মরক্ষা হতে পারে না। বরং এটি দখলদারিত্বের স্থায়ী রূপদানের চেষ্টা। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। ইসরাইলের নিরাপত্তা, ইহুদিদের সুরক্ষা, ইত্যাদি মনগড়া যুক্তির আড়ালে তারা গাজার নিরস্ত্র মানুষের আর্তনাদকে চাপা দিতে চায়।
কিন্তু সত্য কখনো চাপা পড়ে না। আজ বিশ্বজুড়ে মানুষ প্রতিবাদ করছে। ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারিস, জাকার্তা থেকে ঢাকা, সর্বত্রই সাধারণ মানুষ ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। তবে সরকারগুলোর অবস্থান সেখানেও বিভ্রান্তিকর কারণ কেউই সমষ্টিগতভাবে কোন পদক্ষেপ নেয়না। মুসলিম দেশগুলোরও একই অবস্থা। তারা কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষায় বেশি আগ্রহী। তুরস্ক মাঝে মাঝে তীব্র ভাষায় নিন্দা জানালেও, কূটনৈতিকভাবে বড় কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। ওআইসি কেবল বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্ব যদি ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক ও আইনি চাপ সৃষ্টি করত, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি বদলে যেতো।
একটি প্রশ্ন আমাদের সবাইকে করা উচিত, গাজায় যা ঘটছে, তা যদি ইউরোপে ঘটতো, তাহলে কী বিশ্ব এমন নীরব থাকতো? আমরা কী তাহলে দ্বিচারিতার যুগে বাস করছি? গাজার শিশু, নারী, অসহায় মানুষ, তাদের কী কোনো মানবাধিকার নেই?
পঁচাত্তর বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই দখলদারিত্ব ও নিপীড়নের রাজনীতি শেষ করতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। গাজায় যুদ্ধবিরতি, অবরোধ প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
সবকিছু থেমে যায় কিন্তু ইসরাইলি হামলা থামে না। এই চক্র ভাঙতেই হবে। কারণ ইতিহাস কখনো নিরব থাকে না। আজ যারা নিরব, ইতিহাস তাদের মুখোশ ঠিকই খুলে দেবে। আর গাজার শহীদ শিশুরা হবে সেই ইতিহাসের অমোচনীয় সাক্ষী।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক