Sunday 26 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছোটরা বখে — বড়রা দেখে আর চাখে

আনোয়ার হাকিম কলামিস্ট
৩ আগস্ট ২০২৫ ১৮:৪২

সাম্প্রতিক অস্থির সময়ে পর পর বেশ কয়েকটি ইস্যু ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হিসেবে মুখে মুখে ঘুরছে। এর মধ্যে প্রায়-কিশোর বয়সীদের ব্যাপক ও দুর্ধষ চাঁদাবাজি সব ইস্যুকে ছাপিয়ে ‘টপ অব দ্য চার্টে’ জায়গা করে নিয়েছে। আর এতেই যেন সবার ঘুম ভেঙ্গেছে। তাই এখন নড়েচড়ে বসেছেন।

একসময় টেলিভিশনে একটা বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। আর তা হলো, এগুলো তো বড়দের খাবার। ছোটদের খাবার তো ভিন্ন। চাঁদা প্রশ্নে কেন জানি এই বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়লো। চাঁদা মামা অতি মধুর আর চাঁদা আরো উৎকৃষ্টও অতি মিষ্ট। এটি হারবাল টনিকের মত কাজ করে। চাঁদার পরশ না থাকলে ব্যাক্তি জীবন ম্যাড়মেড়ে হয়ে পড়ে আর দলীয় বা গোষ্ঠীগত জীবন মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই চাঁদাবাজি ভিন্ন চাঁদা আদায়ের বিকল্প নেই। চাঁদাবাজি করতে উপযুক্ততা লাগে। দাপট লাগে। বিভৎসতা ছড়িয়ে দিতে হয়। দুই একটি দৃষ্টান্তমূলক নৃশংসতা না ঘটালে চাঁদাবাজ হিসেবে দখল অব্যাহত রাখা যায় না। চাঁদাবাজির আবার গ্র্যাণ্ড ওপেনিংও হয়ে থাকে। আসলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চাঁদাবাজির বিশাল মার্কেট দখলের জন্য চমক জাগানো পাবলিসিটির বিকল্প নেই। প্রথমে কিছু একটা ছুতানাতা করে ব্যাট হাতে ক্রিজে নামতে হয়, নেমেই উপুর্যুপরি কয়েকটা বাউণ্ডারি, ওভার বাউণ্ডারি হাঁকাতে পারলে ইনিংসটা বড় করা যায়। প্রতিপক্ষ ফলো অনে পড়ে সরে পড়ে। চাঁদাবাজিতে এলাকা দখল করা ও দখলে রাখা রীতিমত রাষ্ট্র চালানোর মত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

বড়রা চাঁদা নেবে, খাবে, আরো বড়দের দেবে এভাবেই চাঁদাবাজিচক্র শৃঙ্খলা মেনে এতদিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল্লো পাড়া, মহল্লা, হাট-ঘাট-মাঠ। এগুলোর বাইরেও চাঁদাবাজির সফিসটিকেটেড এরিয়া হলো বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, হাসপাতাল-ক্লিনিক, কল-কারখানা, শিক্ষায়তন ইত্যাদি। বড়রাই এগুলোর হকদার, তারাই এগুলোর দেখভাল করে থাকে। তারাই এর রক্ষক-ভক্ষক। ছোটদের এ বিষয়ে ইন্টারেস্ট ছিলো না কোন দিন। ছোটরা জানে, ওগুলো বড়দের খাদ্য। তাই চাঁদাবাজিতে বিরাজিত বড়দের নিরংকুশ আধিপত্য নিয়ে কোন চ্যালেঞ্জের কথা কখনো শোনা যায় নি। মুক্তবাজার অর্থনীতি আর ইনফরমেশন টেকনোলজির জমানায় চাঁদা এখন ছোটদের কাছেও ক্রীম ক্রেকার্সয়ের মত সুস্বাদু ও ক্রিপসী। ছোটরাও এখন চেখে দেখছে চাঁদা টক নাকি মিঠে নাকি তিতা। চাঁদা যে অতি মিষ্ট ও ভায়াগ্রার মত চরম উদ্দীপক তা কিশোররাও বুঝে গেছে। জিহ্বায় লেগে যাওয়া স্বাদে আসক্ত কিশোররা তাই এখন চর দখলের মত মাঠে নেমে পড়েছে। বড় ভাইদের দেখে দেখে তারাও অফিসে অফিসে ঘুরে ঘুরে টেণ্ডারের খবর নেয়, নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য চাপ দেয় আর বদলী কার্যকর করতে আল্টিমেটাম দেয়।

দেশে চাঁদাবাজির কাহিনী নতুন না। এটি একটি বহুল চর্চিত ও ক্রম বর্ধিষ্ণু উপাদেয় ব্যবস্থাপনা। চাঁদাবাজির অর্থনীতি বিশাল এবং এর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ও সংঘবদ্ধ। তাই, সর্বক্ষেত্রে চাঁদাবাজির সদর্প উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। চাঁদা নিয়ে প্রায়ই কথা হয়। সকলেই জানে কারা চাঁদাবাজ, কারা চাঁদার বেনিফিশিয়ারি, কারা এর পৃষ্ঠপোষক, আর কারা তাদের সহযোগী ফোর্স? গলির ভ্যানে করে যে লোক সবজী বিক্রি করে সেও চাঁদাবাজির অর্থনীতির অধিভুক্ত। তাকেও প্রতিদিন নিজ এলাকা স্থির রাখতে টাকা গুনতে হয়। ফুটপাতে বসে যে বিক্রি করে সামগ্রী তার রেট বেশি। মার্কেটে বসে যে পণ্য বিক্রি করে তার কাছে ডিমাণ্ড হাই। তদ্রুপ হাটে-ঘাটে-মাঠের জন্যও চাঁদাবাজ নির্দিষ্ট করা আছে। সেই সাথে আছে চাঁদার পরিমাণও। মাছ-মাংস-কাঁচাবাজারেও চাঁদাবাজির হাত পড়ে। জুয়েলারি শপ, গ্রোসারি শপেও চাঁদার শীতাতপ স্পর্শ থাকে। মিষ্টির দোকান, ক্রোকারিজ, পাইকারি মার্কেট, পণ্যের গোডাউন কারো নিস্তার নেই। একেক ব্যবসার জন্য আলাদা রেট, আলাদা ব্যবস্থাপনা। যারা চাঁদাবাজ তারা মাসিক তোলা তুলে। উৎসব পার্বনে বোনাসও হাতিয়ে নেয়। আর বড় ভাইদের স্পেশাল ডিমাণ্ড মেটাতে স্পেশাল ড্রাইভ দেয় দোকানে দোকানে। খেলার নাম করে, ওরসের নাম ধরে, পিকনিকের কথা বলে, ডিজে পাটির্র্র রসদ যোগানোর প্রয়োজনে এরা বড় মাপের চাঁদা তুলে। যারা দেয় তারা কিছুকাল শান্তিতে থাকে। আর যারা দেয় না তাদের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ভোগান্তি বর্ণনাতীত। যাদের ঘাড় একটু শক্তপোক্ত তাদের নিয়েই মাঝেমধ্যে দেখা দেয় সমস্যা। এভাবে আদায়কৃত চাঁদা খুচরো আয়ের উৎস। যা রেকারিং এক্সপেণ্ডিচার মেটাতেই শেষ হয়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক চাঁদা বেশ লাভজনক। বেসরকারি হলে কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, ক্লিনিক- হাসপাতাল বেশ ছিমছাম। আর সরকারি হলে তো পোয়াবারো। কাজের পরিমাণের উপর জিজিয়া চাঁদা ধার্য হয়। বাস স্ট্যাণ্ড, ট্রাক স্ট্যাণ্ড, টেম্পু স্ট্যাণ্ড, রিক্সা স্ট্যাণ্ড বড়বেশি হাউকাউ প্রবণ। তবে দৈনিক আয়-রোজগার মোটেই ফেলনা না। মাঝেমধ্যে এলাকার আধিপত্য নিয়ে ধাওয়া ধাওয়ি হয়। যার শক্তি বেশি সে টিকে যায়। পরাজিত শক্তি লেজ গুটিয়ে শক্তি সঞ্চয়ের ধান্ধায় থাকে।

গত রেজিমের শেষের দিকে এসে ‘ছাগল কাণ্ড’ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থলের বিড়াল উন্মোচিত করে দিয়েছিলো। সম্প্রতি গুলশান কাণ্ডে ছোটরা বিশ্রীভাবে ধরা খেয়েছে। বেপোরোয়া ভাব বা অনভিজ্ঞতা বা অতি উত্তেজনা থেকে ছোটরা বড়দের কাছে এখন টেকনিক্যালি মার খাচ্ছে। বড়রা এতে রুষ্ট হয়েছে। তাদের সীমানায় নতুন উপদ্রব হিসেবে ছোটরা এসে ভাগ বসাচ্ছে। এর ফলে তাদের স্থায়ী আনলিমিটেড আয়ের উৎস কর্তনের মধ্যে পড়েছে। আর এর মাধ্যমে সমাজের সামনে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা হয়েছে। এর জের আরো বহুমুখী ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যদি না সরকারি হস্তক্ষেপ সাঁড়াশি ধাঁচের না হয়।

এখন এইসব কিশোরদের নিয়ে রমরমা কাহিনী বেরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যেই তাদের অনেকেই শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। কারো বাড়ীতে সুউচ্চ দালান উঠছে। অথচ পঞ্চাশ বছরেও তাদের অভিভাবকদের কোরবানি দেওয়ার ভাগ্য হয় নি। এখন তারা নিজেরাই এলাকা ভাগ করে নিয়েছে। যাকে তাকে যে কোন তকমা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি। যারা পারছেনা তারা হাউকাউ শুরু করে দিয়েছে। আর যারা পরিষ্কার থাকতে চায় তারা মিডিয়ায় মুখ খুলে এখন নিরাপত্তা শংকায় ভুগছে। মব কালচার এক বিভীষিকাময় নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। কখন কার উপর আছর করবে কেউ আগে থেকে বলতে পারে না। এর কবলে পড়ে দুষ্টুজনের সাথে ভালো মানুষও হেনস্তার শিকার হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। কেউ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবে সে পরিবেশও নেই। এখন হয়ত আরো কিছু ছোট কচি-কাঁচাদের অনুরূপ উত্থানের কাহিনী শোনা যাবে। মিডিয়া এ নিয়ে খুব সরগরম থাকবে। বড় ভাইরা হয়ত মুচকি হেসে মনে মনে বলছে, ওস্তাদের মার শেষ রাত্রেই হয়।

সে যাই হোক। প্রশ্ন একটাই, কেন এমন হলো? দেশে চাঁদাবাজি অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ফরম্যাটে চালু রয়েছে। পাড়ার অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মাস্তানরা করলে তা হয় চাঁদাবাজি। আর শিক্ষিত হোয়াইট কলার পিপলরা করলে তা হয় দক্ষিনা। সরকারি কর্মকর্তারা করলে হয় ঘুষ। রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে তা সেলামী। অনেকেই ইদানীং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে হুজুরদেরকে এর মধ্যে টেনে এনে হাদিয়া পরিভাষা সেঁটে দিতে চাচ্ছে। ভাবটা এমন যে সর্বত্র সবাই চাঁদাবাজির অর্থনীতির উদগাতা ও সুফলভোগী। চাঁদার টাকায় আমাদের সংসার চলে, স্ট্যাটাস বাড়ে, প্রভাব বিস্তার হয়। সমাজের সবাই সমীহ করে চলে। সন্তান-সন্ততির কাছে সফল বাবার পালক যুক্ত হয়। আহ্লাদী স্ত্রীর মুখে সারাক্ষণ খুশীর আভা লেগে থাকে, নিজেকে সফল পতি ভাবতে অফুরান সুখ জাগে। কেউ প্রশ্ন করে না দিনমজুরের ছেলের বাড়ীতে কোটি কোটি টাকার চেক কীভাবে মেলে, ব্যাংকে একেকজনের ত্রিশ-চল্লিশ-শতাধিক একাউন্টে শত-সহস্র কোটি টাকা এ কয় মাসে কীভাবে জমা হয়?

সরকারি জ্বালানি তেল বিপণন কোম্পানির প্রাক্তন এমডির বাসায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা হানা দিয়ে প্রায় হাজার কোটি টাকা নগদ উদ্ধার করেছে। যাকেই ধরছে তার কাছে শত শত কোটি টাকা শুধু বাড়ীতেই পাওয়া যাচ্ছে। সাংবাদিকদের শত শত একাউন্ট কেন থাকে? কেন তাতে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়? এগুলো ঘটমান বাস্তব। কেউ এখন আর এতে বিস্মিত হয় না। কার কাছে কত টাকা আছে কেউ জানে না। অনুমান করারও জো নেই। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে কোন এক ইউপি চেয়ারম্যানের একাউন্টে চৌত্রশ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বড়দের এগুলো দেখে দেখে ছোটরাও হাত পাকিয়েছে। আগে তারা বড়দের দিয়ে থুয়ে খেত। আর এখন ছাত্র উত্থানের তাপে ‘নো বিগ ব্রাদার’ ম্যুডে অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করে সর্বত্র হাত-পা-মুখ-নাক গলিয়ে দিচ্ছে। গায়ের রক্ত টগবগ করেছে, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূল, মাথার উপরে কোন অভিভাবক নেই, পুরোনো বড় ভাইদের যুগ শেষে, এখন ছোটদের বাংলাদেশ- তাই ডোন্ট কেয়ার ভাব সর্বত্র বিরাজমান। আর এতেই বড়দের রুটি রোজগারে খরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তাই তারা এখন সোচ্চার হচ্ছে। আগেও তারা এরূপ দেখেছে কিন্তু কিচ্ছু বলে নি। কারণ, তাদের নির্ধারিত হিস্যা অক্ষুন্ন ছিলো। তাই দুর্জনেরা বলে ছোটরা বখে আর বড়রা দেখে আর চাখে।

চাঁদাবাজি আজ সবচেয়ে নিরাপদ ও বিনা পুঁজিতে লাভজনক পেশা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কী নেই এই চাঁদাতে? সুখ আছে, শান্তি আছে, নিরাপত্তা আছে, সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, নেতাগিরি অক্ষুন্ন আছে। আর চাই কি? কে হায়! এর বিপরীত অবস্থা কামনা করে? এরপরেও রাজনীতিসহ সব পেশাতেই ভালো ও সৎ লোক আছে। তারা কোনঠাসা, নির্জীব, মান-মর্যাদার ভয়ে সারাক্ষণ সংকুচিত হয়ে থাকে। সামনে এরা সকলের তারিফ পায়, আড়ালে পরিহাসের পাত্র হয়। এভাবে চললে সমাজ কালো অর্থনীতি ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির কবলে পড়ে যাবে। তখন ম্যালেরিয়া ও কুইনাইন দুটোই সারাবে কে? অতএব, সাধু সাবধান। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

আনোয়ার হাকিম - আরো পড়ুন