প্রযুক্তি বা প্রকৌশল বিদ্যা শব্দ দুটি একটি অন্যটির পরিপুরক। এটি এমন একটি বিদ্যা যা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। এ শিক্ষার ওপর যতবেশি গুরুত্ব দেয়া যায় ততবেশি দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে সাফল্য পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে অন্যান্য শিক্ষাপাঠের চাইতে প্রকৌশল শিক্ষাকে যুগোপযোগি করে গড়ে তুলতে অধিকতর জোর দিয়ে থাকেন। প্রযুক্তি শিক্ষা একটি হাতে-কলমের শিক্ষা (থিউরিটিক্যাল এন্ড প্রাকটিক্যাল) যেটি এখন কলমের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ল্যাপটপ-কম্পিউটার। প্রকৌশল বা প্রযুক্তি শিক্ষাকে বাদ দিয়ে কোনো দেশ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পেরেছে বলে বিশ্বে এমনকোনো নজির নেই, বরঞ্চ সেই দেশগুলোর সরকার এই শিক্ষার পিছনে অধিকতর গুরুত্বারোপ করে উন্নত সমৃদ্ধ প্রযুক্তি নির্ভর দেশ গড়তে নতুন নতুন উদ্যোগ ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকেন। সময় ও চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানামুখী স্রোতধারায় প্রকৌশল শিক্ষার শিক্ষার্থিদের পাঠ নিতে হয়। তার কোনোরকম ঘাটতি থাকলে শিক্ষার্থীদের জানার ও শেখার ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়।
আজকে দেখুন, উন্নয়নশীল ও টেকসই দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে যারা তাক লাগিয়েছে তার প্রত্যেকটি ছোঁয়ার পিছনে কিন্তু প্রযুক্তিবিদদের নিরলস ভূমিকা রয়েছে। তাদের সৃষ্টিশীল নিত্য নতুন উদ্ভাবনের কারণে দেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ছোট্ট একটি কুঠির নির্মাণ শৈলীর কারণে যেমন অনন্য হয়ে ওঠে তেমনি একটি দেশের ভিত মজবুত ও আধুনিকতার রূপ দিতে প্রকৌশলীরা বদ্ধ পরিকর। উন্নয়নশীল দেশে প্রকৌশল প্রযুক্তিবিদদের একটি আলাদা সম্মানের জায়গা আছে। দেশগুলোতে প্রকৌশল বিদ্যার কারিগরি উন্নয়নে যেভাবে বাজেট বরাদ্ধ রাখা হয় তা সত্যিই ঈর্ষনীয় ব্যাপার। কিন্তু অতীব দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, আমাদের দেশে উচ্চতর প্রকৌশল বিদ্যার যে প্রতিষ্টানগুলো বর্তমান বিদ্যমান রয়েছে সেসব প্রতিষ্টানের ওপর মোটেও সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তর বা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজর আছে বলে মনে হয়না। বিশেষ করে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যার কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থিরা অনেকদিন থেকে সরকারের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেন-দরবার করে আসলেও কর্তৃপক্ষের নিষক্রিয় ভূমিকা শিক্ষার্থিদের মনে দিন দিন অশান্তির দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
আজকে প্রায় তিন মাস সময় ধরে দেশের ৪টি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল ও সিলেটের শিক্ষার্থিরা তাদের ন্যায্য দাবির স্বপক্ষে সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। দেখেছি আন্দোলনে কোনোধরণের বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা যাতে সৃষ্টি না হয় এই মেধাবী শিক্ষার্থিরা সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে ধাপে ধাপে তাদের যোক্তিক দাবিগুলোকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরে আনার চেষ্টা করেছে। তাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে সাধারণ অভিভাবক থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থিরা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো। কিন্তু এতকিছর পরও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে দাবি বাস্তবায়নের পরিবর্তে বার বার শুধু আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। এ ব্যাপারে শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে একটি বৈঠকে মিলিত হয়েও তার কোনোরকম সুরাহা হয়নি। শিক্ষার্থিরা দাবি পূরণে ব্যর্থ হলে আগামী ৯ আগষ্টের পর থেকে আমরণ অনশনের দিকে ফিরে যাবে বলে ঘোষণা করেছে। শিক্ষার্থিদের প্রধানতম দাবি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত ও কম্বাইন্ড সিস্টেম বাতিল করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র (বিআইটি) অধীনে ফিরিয়ে দেওয়া।
প্রথমদিকে তিন কলেজের শিক্ষার্থিরা আন্দোলনের যোক্তিক বিষয় তুলে ধরে যুগপৎ আন্দেলনের সূচনা করেন। পরবর্তিতে সিলেট সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থিরাও আন্দোলনে সামিল হন। তাদেরও দাবি সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থেকে বের হয়ে বিআইটিতে ফিরে যাওয়া।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানাবিধ সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে বৈষম্য করছে এ কারণে গত ১৮ মে ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেধাবী ছাত্র ধ্রুবজিৎ কর্মকারের জীবন দিতে হয়েছে। সে বিষয়গুলো তার ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করে গেছে। এতকিছুর পরও সরকার ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা দপ্তরের হুশ ফিরছেনা। তাহলে আর কতো শিক্ষার্থির জীবন বিপন্ন হলে সরকার ফিরে তাকাবে ? ওরা প্রত্যেকে মেধাবী শিক্ষার্থি তাদের অন্যকোন উদ্দেশ্য নেই, তারা চায় শিক্ষার ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে। শিক্ষাপ্রতিষ্টান বন্ধ করে শিক্ষার্থিদের যদি মাসকে মাস অভিভাবকহীনভাবে রাস্তায় কাটাতে হয় তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছু হতে পারেনা।
শিক্ষা ব্যবস্থা একটি দেশের বড় কেন্দ্র যেটিকে পিছনে ফেলে সমাজ প্রগতির কথা কখনো আশা করা যায় না। প্রকৌশল শিক্ষা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম। আজকে শিক্ষাকে বৈষম্য ও বাণিজ্যিকরণের মাধ্যমে নামখাওয়াস্তে শিক্ষাব্যবস্থাকে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থিরা শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগি করার পক্ষে যখন রাস্তায় দিনের পর দিন মাসের পর মাস বিক্ষোভ, মানবন্ধন, সভা-সমাবেশ করছে তার বিপরীতে আরেকদল ছাত্র নামধারী প্রতিনিধি চাঁদাবাজি, মারামারি, হাতাহাতি, কাটাকাটিতে সংবাদের শিরোনাম হয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করছে।
একটি সয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে অনেক কিছুরই প্রয়োজন হয়। তার সবক’টি পূরণ করতে না পারলেও অন্তত মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি সরকারের নজর দেওয়া করণীয়। সংকট রেখে কখনো উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারেনা। গবেষণার অপ্রতুলতা, ছাত্রাবাস সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, চিকিৎসা সমস্যা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা এই বিষয়গুলো একটি প্রতিষ্ঠানের মান-মর্যাদা অনেকখানি বৃদ্ধি করে। অথচ এ প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে তারা প্রতিদিন ভুগছেই আর ভুগছে।
উচ্চতর প্রকৌশল শিক্ষার কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট, ল্যাব সংকট, গবেষণা সামগ্রী সংকট যে প্রকট আকার ধারণ করেছে তা মেধাবী শিক্ষার্থি ধ্রুবজিৎ কর্মকার কর্তৃপক্ষকে সে জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আজকে সে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলেও তার যে প্রতিবাদ এবং তাকে অন্তরে ধারণ করে আজ তার অগণন বন্ধুরা নির্ভিকহীনভাবে রাজপথে সরব হয়েছেন। নানাবিধ সংকটে জর্জরিত কলেজগুলোকে অতিসহসা উত্তরণের রূপরেখা প্রণয়ন এবং সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পিছপা হলে হয়তো ভবিষ্যতে আরো কঠিন মূল্য দিতে হবে। আর কোনোরকম অবহেলা না করে শিক্ষার্থিদের নৈতিক দাবিগুলো পূরণ করে পুনরায় তাদেরকে ক্লাসের টেবিলে বসার ব্যবস্থা করে দিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক