স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের স্বাস্থ্য খাতে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, গড় আয়ুষ্কাল বেড়েছে। টিকাদান কর্মসূচি প্রায় শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে এবং পোলিও ও কুষ্ঠরোগ নির্মূলে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু এখনো জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ও প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে অবকাঠামো থাকলেও চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও ওষুধের ঘাটতি প্রকট। আছে অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতা। তাছাড়া দুর্নীতি পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগের অপর্যাপ্ততার বিপরীতে দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত। বেসরকারি খাতে চিকিৎসাসেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর পক্ষে এ সেবা গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সেবার মান ও সুযোগ তুলনামূলকভাবে উন্নত হলেও অতিরিক্ত খরচের ভার সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবায় এক ধরনের বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশিক্ষিত জনবল ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে স্বাস্থ্য খাতে পরিকল্পিত বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রয়োজন।
প্রত্যেক নাগরিকের চিকিৎসাসেবা পাওয়া সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। কিন্তু সরকারি চিকিৎসা ও সেবার মান নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন উঠছে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স থাকেন না, যন্ত্রপাতি থাকে না। হাসপাতালগুলোয় সংশ্লিষ্ট সব পদ থাকে কিন্তু লোকবল নিয়োগ দেয়া হয় না। আবার নিয়োগ পাওয়ার পর অনেক চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে থাকেন না। চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসক না থাকার কারণেও অনেক স্থানে মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা পায় না। দেশের স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসার বেহাল দশা একদিনে গড়ে ওঠেনি। হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবস্থা না নেয়ায় স্বাস্থ্য খাতে অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
প্রত্যেক নাগরিকের চিকিৎসাসেবা পাওয়া সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। কিন্তু সরকারি চিকিৎসা ও সেবার মান নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন উঠছে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স থাকেন না, যন্ত্রপাতি থাকে না। হাসপাতালগুলোয় সংশ্লিষ্ট সব পদ থাকে কিন্তু লোকবল নিয়োগ দেয়া হয় না। আবার নিয়োগ পাওয়ার পর অনেক চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে থাকেন না। চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসক না থাকার কারণেও অনেক স্থানে মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা পায় না। দেশের স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসার বেহাল দশা একদিনে গড়ে ওঠেনি। হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবস্থা না নেয়ায় স্বাস্থ্য খাতে অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক ও নার্স সংকট দেশের স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান নিশ্চিতে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র দশমিক ৮৩ জন। বাংলাদেশে জনসংখ্যা ও চিকিৎসকের এ অনুপাত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। নার্সের পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক। দেশে মোট জনসংখ্যার বিপরীতে ৩ লাখ ১০ হাজার ৫০০ নার্স থাকা দরকার। কিন্তু কর্মরত আছেন মাত্র ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন, অর্থাৎ মোট চাহিদার মাত্র ২৮ শতাংশ। চিকিৎসক ও নার্স সংকট দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ চিকিৎসক ও নার্স না থাকায় সেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে, বাড়ছে রোগীর চাপ। ফলে রোগীকে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হচ্ছে। চিকিৎসক সংকটের একজন ডাক্তারকে অতিরিক্ত রোগী দেখতে হয়। ফলে একজন ডাক্তারের পক্ষে রোগীর যথাযথ রোগ নির্ণয় ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে নার্স সংকট রোগীর পরিচর্যা ও সেবার মানকে প্রভাবিত করছে। সেবার গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে উপজেলা ও গ্রামীণ পর্যায়ে এ সংকট আরো তীব্র, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াই অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় জনসাধারণ, বিশেষত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে বা একেবারেই চিকিৎসা না নিয়ে ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তোলে। চিকিৎসক ও নার্সের এ ঘাটতি সার্বিকভাবে দেশের জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা যাবে না স্বাস্থ্য খাতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে কেবল অর্থ বরাদ্দই যথেষ্ট নয়, তার সঠিক ব্যবস্থাপনাও জরুরি।
এক গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চতর সেবা কেন্দ্রের পরিবর্তে যদি নিকটবর্তী সেবা কেন্দ্র (যেমন উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা জেলা হাসপাতাল) থেকে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারতো তাহলে ব্যক্তির যে পরিমাণ অর্থ এবং সময় সাশ্রয় হতো তার মূল্য বছরে চার হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে, ব্যক্তির পকেট থেকে স্বাস্থ্যের ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশের ৫ -৬ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্য সীমার নিচে পতিত হয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি দিয়ে বছরে যতটুকু দারিদ্র্য বিমোচন হয়, শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের খরচ মেটাতে গিয়ে তার থেকে বেশি পরিবার দারিদ্রে পতিত হয়। স্বাস্থ্যে বিনিয়োগকে দারিদ্র্য দূরীকরণের কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করলে এতদিন দারিদ্র্য সিঙ্গেল ডিজিটে আনা সম্ভব হতো। স্বল্প আয়ের মানুষের ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্য সেবা সহজতর করার মাধ্যমে দারিদ্র্যে পতিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে আমাদের পথ খুঁজতে হবে। বাংলাদেশকে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক মহামারীর মতো একাধিক চ্যালেঞ্জ। এসব বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করতে কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। একটি সহনশীল ও স্থিতিশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারকে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি এর মানোন্নয়নে সুশাসন ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিশ্চিত করা দরকার। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয় হলেও তা টেকসই করতে হলে প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার, বিনিয়োগ বাড়ানো, প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুশাসন। স্বাস্থ্য খাতকে উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে সরকারকে এখনই এ খাতে সুদৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যকর পরিকল্পনার ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জনগণের স্বাস্থ্যই দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি—এ উপলব্ধিকে সামনে রেখে আসুক সুপরিকল্পিত ও টেকসই পদক্ষেপ।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক