Sunday 07 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’: স্বাভাবিক জীবনের গ্যারান্টি কোথায়?

ইমরান ইমন
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৮

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয় জোবরা গ্রামবাসীর সংঘর্ষে হামলার শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মামুন মিয়া এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। চিকিৎসকরা তার মাথায় লিখে দিয়েছেন— ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভয়ংকর বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মাথার হাড় ভেঙে গেছে, তার জীবন এখন ঝুঁকির মুখে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আর কিছু গণমাধ্যমের চোখে সবচেয়ে বড় খবর হয়ে ওঠেছে স্থানীয় জোবরাবাসীর ভাঙা টিনের কয়েকটি দৃশ্য।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপরই বর্তায়। কিন্তু হামলার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ব্যস্ত হয়েছে তাদের ওপর দোষ চাপাতে, তাদের বলিরপাঁঠা বানাতে। তারা হামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত কিংবা আহতদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে দেখিয়েছে ভাঙা টিন, ভাঙা বেঞ্চ, ভাঙা জানালার ছবি। এটি প্রশাসনের চরম মেরুদণ্ডহীনতার প্রমাণ।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয় কখনও কেবল জ্ঞানের ভাণ্ডার নয়, এটি শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের নৈতিক আশ্রয়স্থল। সেই আশ্রয় ভেঙে পড়লে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়? প্রশাসনের এই নির্লিপ্ততা শিক্ষার্থীদের প্রতি সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

কিছু গণমাধ্যমের ভূমিকা আরও হতাশাজনক। তারা আহত শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত ছবি, হাসপাতালে জীবন-মৃত্যর সঙ্গে লড়াই করার দৃশ্য কিংবা মামুনের ভাঙা করোটির করুণ দৃশ্য তুলে না ধরে বরং তারা তুলে ধরেছে জোবরা গ্রামবাসীর কিছু ভাঙা টিনের ছবিকে, যেন এগুলোই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘অপরাধী’ তকমা দেওয়া হয়েছে, অথচ সত্য আড়াল করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের মৌলিক দায়িত্ব হলো নিরপেক্ষভাবে সত্য প্রকাশ করা, মানবিকতার পক্ষে দাঁড়ানো। কিন্তু যখন প্রোপাগান্ডা চালানো হয় এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি দোষ চাপানো হয়, তাদের বলিরপাঁঠা বানানো হয়, তখন সেই দায়িত্বের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এভাবে গণমাধ্যম নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাও হারায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষার্থীরা সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণতান্ত্রিক আন্দোলন— সবক্ষেত্রেই তারা প্রাণ দিয়েছে। অথচ আজ সেই শিক্ষার্থীদেরকেই অপবাদ দিয়ে দমন করা হচ্ছে। মামুনের মাথায় আঘাত কেবল একটি দুর্ঘটনা নয় বরং একটি প্রবল সতর্কবার্তা। এটি প্রমাণ করে: রাষ্ট্র ও সমাজ আজ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো— কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কয়েকটি ভাঙা টিন, নাকি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর চূর্ণবিচূর্ণ মস্তিষ্ক? টিন নতুন করে কেনা যায়। কিন্তু শিক্ষার্থীর ভাঙা করোটি আর তার জীবনের সম্ভাবনা কোনো অর্থেই পূরণ করা যায় না। তবুও প্রশাসন ও কিছু মিডিয়া টিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষার্থীদের বলিরপাঁঠা বানিয়ে।

এমন ঘটনা এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের নৈতিক দেউলিয়াত্বের স্পষ্ট প্রমাণ। কারণ যারা ভাঙা টিনকে বড় করে দেখায়, তারা আসলে নিজেদের ভাঙা বিবেকের মুখোশ ঢাকতে চায়।

মামুনের মাথায় আঘাতের দায় হামলাকারীর পাশাপাশি প্রশাসনের ওপরও বর্তায়। তারা শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। একইসঙ্গে দায় রয়েছে কিছু গণমাধ্যমের, যারা প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে। এই দায় অস্বীকার করা মানে শিক্ষার্থীদের রক্তকে অস্বীকার করা। যদি বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিই আলোকিত শিক্ষার কেন্দ্র হয়, তবে তাকে এই দায় স্বীকার করে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছে—এ সমাজ ও রাষ্ট্র ভাঙা টিনকে বড় করে দেখে কিন্তু অন্যায়ভাবে হামলার শিকার ভাঙা মস্তিষ্ককে দেখে না। এখানে ক্ষুদ্র সম্পদের ক্ষতিকে গণনা করা হয় অথচ মানবিক ক্ষতির হিসেব সুকৌশলে মুছে ফেলা হয়।

মামুনের মস্তিষ্কের ওপর চিকিৎসকের লেখা সতর্কবার্তা— ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’—কেবল তার জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য একটি আয়না। যেখানে ফুটে ওঠে এ সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মামুনের অবস্থা প্রমাণ করে: সমাজের হাড় ভেঙে গেলে, প্রশাসনের মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে— কোনো ভবিষ্যৎ বাঁচানো যায় না। আর তখন ভাঙা টিন নয়, ভাঙা বিবেকের বোঝাতেই দেশের নাগরিক চাপা পড়ে মারা যায়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

ইমরান ইমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মামুন মিয়া মুক্তমত শিক্ষার্থী

বিজ্ঞাপন

আসছে ‘পুষ্পা ৩’
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:৪১

আরো

সম্পর্কিত খবর