Sunday 07 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডাকসু নির্বাচন ২০২৫: সেকেন্ড পার্লামেন্ট এবং প্রত্যাশা

জাফর হোসেন জাকির
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:২১

ডাকসু হলো দেশের দ্বিতীয় সংসদ। কেননা এখান থেকেই যুগে যুগে দেশপ্রেমিক মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের নেতৃত্বে গেছেন এবং সাধারণ মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকেই বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল, যেমন – ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে এর ভূমিকা অগ্রগণ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, এটি দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। ডাকসু দেশে গণতন্ত্র এবং ইতিবাচক ধারায় সবসময় ভূমিকা রেখেছে৷ ছাত্রদের অধিকার আদায়ে ডাকসু যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি দেশের মানুষের অধিকারের জন্যও তারা সক্রিয় থেকেছে। বিষয়টি এমন যে দেশের মানুষ কোনো অন্যায় আর অবিচারের প্রতিবাদ দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডাকসুর দিকে তাকিয়ে থেকেছে সবসময়৷ দেশের ক্রান্তিলগ্নে ঢাবি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। আর এ কারণেই ডাকসুকে বলা হয় সেকেন্ড পার্লামেন্ট। কিন্তু দুঃখ হলেও সত্য, ডাকসু ও হল সংসদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ৩৭ বার নির্বাচন হলেও স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র ৮ বার! সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৯ সালে, সেটিও শেষ হয়েছিল বিতর্কের মধ্য দিয়ে; সুষ্ঠু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের কাছে যেন অলীক স্বপ হয়ে উঠেছিল।

বিজ্ঞাপন

সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দীর্ঘ ছয় বছর পর আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রার্থীরা ভোট পেতে প্রচারণা চালাচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংলাপ করছেন এবং তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইছেন। ইতিমধ্যেই সকল প্রার্থী নিজেদের ইশতেহার প্রকাশ করেছেন এবং শিক্ষার্থীদের কাছে আশার বাণী দিয়েছেন।

শিক্ষার্থীরা ডাকসু নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এমআইএস বিভাগ ও বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শেখ সামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয় তারা মূলত সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি। আমরা তাদের কাছে ক্যাম্পাসকে রাজনৈতিক বলয় থেকে সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি চাই। অতীতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন, আবাসিক হলে গণরুম-গেস্টরুম নামে অপসংস্কৃতির প্রচলন— সবই হুমকিস্বরূপ। ডাকসুতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আমরা এই বিষয়গুলোর স্থায়ী সমাধান প্রত্যাশা করি।’

অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মেধা হোসাইন বলেন, ‘ক্যাম্পাসে চলাফেরায় যেন আর কোনো ভয় বা অনিশ্চয়তা না থাকে। আমরা চাই এমন এক ডাকসু, যেখানে নারী শিক্ষার্থীরা নিজেদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ মনে করবে। হোস্টেল থেকে লাইব্রেরি, টিউশন থেকে বাসায় ফেরার পথে— সব জায়গায় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা, প্রার্থীরা নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবে সহায়ক ব্যবস্থা ও সেল গঠন করবে।’

আমাদের মতো পশ্চাৎপদ, কম শিক্ষার হারের দেশে শিক্ষার্থীরাই হচ্ছেন জ্ঞানের তথা সংস্কার আন্দোলনের ভ্যানগার্ড। এটি একমাত্র সংরক্ষিত শক্তি, যা একাধারে লড়াই করে আবার জ্ঞানের আলোকে সংগঠিত করে। এবার এমন এক সময় ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যখন মাত্রই শিক্ষার্থীরা আরেকটি রক্তের নদী সাঁতরে তীরে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাত্র ৩৬ দিনে ফ্যাসিস্ট সরকার হত্যা করেছিল ১ হাজার ৪০০ মানুষকে।

কী রকম হবে এবারের ডাকসু নির্বাচন? কেমন হবে তার চালচিত্র ও চরিত্র? এক বছর পরও এই মহান জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি মানুষের মনে দগদগে ও জীবন্ত। এই অভ্যুত্থানেই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ আগুন-ঝরানো অবিস্মরণীয় সাহসী আত্মদানের উদাহরণ তৈরি করেছেন। দেশপ্রেমিক বীরদের এই মহান আত্মদান দেশের মানুষের মধ্যে এক অসাধারণ আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে। এক নতুন দেশ গড়ব, ফ্যাসিবাদকে আর কখনো এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে দেব না, লুটেরা খুনিদের বিচার হবে এ দেশের মাটিতেই, একটি কল্যাণময়-সাম্যের-শান্তির দেশ গড়ে উঠবে, এই তো জনগনের আকাঙ্ক্ষা। এবার যে ডাকসু গঠিত হবে, দেশবাসীর কাছে তাদের কী অঙ্গীকার থাকবে? আমরা কী ধরনের ডাকসু চাইব? দেশের ২০ কোটি মানুষের যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন না, তাদের কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে তথা ডাকসুর কাছে কোনো প্রত্যাশা থাকতে পারে? নিশ্চয়ই পারে। কেননা ডাকসু শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, ডাকসু বাংলাদেশ বির্নিমাণের বাতিঘর। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন ছাত্ররা কি কেবল তাঁদের দাবিদাওয়ার কথা বলবেন, নাকি দেশের কথাও বলবেন? মানুষ মহা আনন্দে দেখেছিল ছাত্ররা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে একটা সময় শ্রমিক, চাকুরিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে সংহতি জানায় স্ব-শরীররে যুক্ত হয়।

এবার ডাকসু নির্বাচন হবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের বিশাল দেশবদলের চেতনার আলোতে। এমনিতেই নির্বাচনটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, তার ওপর চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরিপূর্ণভাবেই রাজনৈতিক ও জ্বলন্ত। ফলে ডাকসুর প্রতি প্রত্যাশা থাকবে- ডাকসু হবে সত্যিই শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর, হলের অব্যবস্থাপনা, দখলবাজি ও সিন্ডিকেটের অপরাজনীতি বন্ধ করতে সাহসী পদক্ষেপ, প্রার্থীদের কাছ থেকে শুধু প্রতিশ্রুতির বন্যা নয়, বরং বাস্তব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ। সেই সাথে দেশবাসী বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে- দ্বিতীয় সংসদ থেকে আগামীর বাংলাদেশ বির্নিমাণের নতুনভাবে সূচনা পর্ব শুরু হবে। এবারের ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক মুক্ত ছাত্র রাজনীতির সুস্থ ধারা বিরাজ করবে, নারী বিদ্বেষী নয় বরং নারী ও শিক্ষার্থী বান্ধব ক্যাম্পাস হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ডাকসু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

জাফর হোসেন জাকির ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর