Sunday 07 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রক্ত ও অশ্রু দিয়ে আঁকা স্বপ্নের ফিলিস্তিন

ফাহিম হাসনাত
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:৪৯

ফিলিস্তিন, এক নাম যা একই সাথে সহনশীলতা, কষ্ট, এবং স্বাধীনতার স্বপ্নকে মনে করিয়ে দেয়। বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি, বিশেষ করে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায়, এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। দশকের পর দশক ধরে চলা ইসরায়েলের নির্মম আগ্রাসনে এই ভূমি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য মানুষের জীবনহানি, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, তীব্র মানবিক সংকট, এবং দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের জীবন কাটছে। কথাশিল্পী নচিকেতার ভাষায়, ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে,’ কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জীবনে সেই শান্ত পৃথিবী কবে আসবে, তা কেউ জানে না। কবি মাহমুদ দারবিশ ‘যুদ্ধ থেমে যাবে’ কবিতায় তিনি বলেন, ‘একদিন যুদ্ধ থেমে যাবে, নেতারা হাত মেলাবে; কিন্তু মা অপেক্ষা করবে কবে তার শহীদ ছেলে ঘরে ফিরবে, বধূ অপেক্ষা করবে কবে তার প্রাণের স্বামী ফিরে আসবে’। এই মর্মস্পর্শী কথাগুলোই যেন ফিলিস্তিনিদের বঞ্চনা ও সংগ্রামের সারকথা।

বিজ্ঞাপন

‘নাকবা’ ও স্বাধীনতার সংগ্রাম _

ফিলিস্তিনিদের এই দীর্ঘ সংগ্রামের মূল কারণ নিহিত রয়েছে ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় দিবসের মধ্যে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোরের ঘোষণার পর থেকেই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। সেই সময় ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে আসে। ১৯২২ সালে লিগ অফ নেশনসের কাছ থেকে ব্রিটিশরা এই ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু ইহুদি নিধনযজ্ঞ, বিভিন্ন ইহুদি গুপ্ত গোষ্ঠীর চাপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সংশ্লিষ্টতার কারণে পরিস্থিতি রাতারাতি পাল্টাতে থাকে। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের ওপর থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেয় এবং এর দায়িত্ব জাতিসংঘের কাছে অর্পণ করে।

১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা নিয়ে বিতর্কিত ‘প্রস্তাব ১৮১’ গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবটি তিন মিনিটের কম সময়ের এক ভোটাভুটিতে পাস হয়। প্রস্তাব পাসের সময় ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ফিলিস্তিনি আরব এবং ৬ লাখ ইহুদি। অথচ, জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী হয়েও ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ৫৪ শতাংশ ভূখণ্ডের মালিক হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য বরাদ্দ হয় মাত্র সাড়ে ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারের তিনটি এলাকা, আর জেরুজালেমকে করা হয় এক বিশেষ আন্তর্জাতিক অঞ্চল। ক্ষুব্ধ আরব দেশগুলো পুরো ফিলিস্তিনকে নিয়ে একটি একক, গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেয়।

১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয়। এই দিনটি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় দিবস নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে প্রতিবেশী চারটি আরব দেশ একযোগে ইসরায়েল আক্রমণ করে। কিন্তু যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। ফলস্বরূপ, ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ভূমির থেকেও বেশি, প্রায় ৭৭ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনিরা আরও শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধের শিকার হয়। এর শেষ কোথায়, তা আজও অজানা।

প্রতিরোধ আন্দোলন: পিএলও, হামাস ও হিজবুল্লাহ _

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন সংগঠন, যেমন ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এবং হামাস, বিভিন্ন সময়ে সংগ্রাম করেছে। ইয়াসির আরাফাত-এর নেতৃত্বে পিএলও সহিংসতার লাগাম টেনে ধরে এবং জাতিসংঘের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা সীমিত স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিল, কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। অন্যদিকে, গাজা উপত্যকায় জন্ম হয় ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস-এর, যারা নিজেদেরকে পিএলও’র বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। হামাস তার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে যেকোনো মূল্যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণা করে। তাদের এই অঙ্গীকার আন্দোলনরত যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করে এবং ইসরায়েলি দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়।

১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইরানের বিপ্লব ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামে নতুন আশার আলো জাগায়। এই বিপ্লবের পর ফিলিস্তিন ও আল-কুদসের মুক্তির লক্ষ্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে রমজানের শেষ শুক্রবারকে আল-কুদস দিবস ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে বিশ্ব মুসলিম এ দিবসটি পালন করে আসছে। বর্তমান ফিলিস্তিনে হামাসের নেতৃত্বে জেগে উঠেছে ফিলিস্তিনের অজুত মানুষ। আর দক্ষিণ লেবাননে বিপুল শক্তি অর্জন করেছে এক লড়াকু সংগঠন হিজবুল্লাহ, যাদের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে ২০০৬ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। এই প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো ফিলিস্তিনিদের মধ্যে স্বাধীনতার আগুনকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা ও পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা _

ফিলিস্তিনিদের এই দীর্ঘ দুর্দশার পেছনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা একটি বড় কারণ। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের মদদে ইসরায়েল যুগের পর যুগ ধরে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের একমাত্র অপরাধ যেন তাদের ধর্মীয় পরিচয়। বারবার আবেদন সত্ত্বেও জাতিসংঘ, ওআইসি এবং আরব লীগ কার্যত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মুসলমানরা বারবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ফিলিস্তিনে গণহত্যার দায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানালেও কার্যত কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবিও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বই এই বর্বর হামলায় সহযোগিতা করছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন বিশ্ব এই দেশগুলোকে চাপের মধ্যে রাখবে। বিশেষ করে, মুসলিম দেশগুলোর উচিত অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করে ইসরায়েলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ইসরায়েল ভিক্ষুকরূপে আরব বুকে একটু ভূখণ্ড চেয়েছিল। তাদেরকে ভূখণ্ড দেওয়ার পর তারা মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদ দখল করে নেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এজন্যই তারা ফিলিস্তিনের নাগরিকদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে।

ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ: পথ কি কঠিন?

ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কোনো সহজ পথে নেই। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর সংলাপ, ন্যায়বিচার এবং সম্মানের ভিত্তিতে একটি টেকসই সমাধান প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তখনই বাস্তবে রূপ নেবে, যখন ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব চাইলেই তা এই মুহূর্তেই সম্ভব। ফিলিস্তিন এমন একটা দেশ, যার প্রধানমন্ত্রী এবং বিভিন্ন দেশে দূতাবাস থাকা সত্ত্বেও তাদের কোনো স্বাধীন ভূমি নেই। আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্রের কারণে তারা নিজভূমিতেই পরবাসী।

কিন্তু যে জাতি শাহাদতের গৌরব ধারণ করে, তাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে কোনোভাবেই থামানো যায় না। তাদের হত্যা করা যায়, বন্দি করা যায় কিন্তু স্বাধীনতার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। বিশ্বজুড়ে যারা মানবতার বুলি আওড়ায়, তারাই বর্বর হামলার সহযোগিতা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বকেই তাই দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে এই প্রাণঘাতী যুদ্ধ বন্ধের জন্য। সারা বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ও পশ্চিমা বিশ্বকে চাপের মধ্যে রাখার জন্য। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনে চিরস্থায়ী শান্তি ফিরবে তখনই, যখন ফিলিস্তিনিরা পাবে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব।

ফিলিস্তিনিদের এই দীর্ঘ লড়াইয়ে বিশ্ব মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাশে দাঁড়ানো অপরিহার্য। হয় তারা স্বাধীন হবে, নয়তো হাসিমুখে শাহাদতকে বরণ করে নেবে। মুসলমানদের জন্য এর কোনো বিকল্প পথ নেই। বিশ্ব-মুসলিমদের আজ একটাই প্রশ্ন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের রক্ত, অশ্রু এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক নতুন ইতিহাস রচনা করে চলেছে, যা হয়তো একদিন তাদের স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

ফাহিম হাসনাত ফিলিস্তিন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর