সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জোবরাবাসীর নৃশংস হামলার শিকার ১৫০০ শতাধিক শিক্ষার্থীর রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। অথচ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা (সেকশন অফিসার, প্রশাসনিক ভবন) ও হাটহাজারী আসনে (চট্টগ্রাম-৫) জামায়াত মনোনিত এমপি প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বলেছেন: ‘আমরা (জোবরাবাসী) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পাশ্ববর্তী এলাকার মালিক। আমরা হলাম জমিদার। জমিদারের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করবে আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। আমাদের সম্মান করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি আমাদের যথাযথ সম্মান না করে, আমরা জনগণ নিয়ে যা ব্যবস্থা করা দরকার তা করবো ইনশাআল্লাহ।’ তিনি তার বক্তব্যের মাঝে শিক্ষার্থীদের ওপর জোবরাবাসীর হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়েরকৃত মামলায় তাদের গ্রেফতার করা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন।
সিরাজুল ইসলামের এমন বক্তব্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। তার এ বক্তব্য জোবরাবাসীর জন্য আনন্দের ও অনুপ্রেরণার। তার এমন বক্তব্যে জোবরাবাসী আগামীতে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠবে। তারা এবার শিক্ষার্থীদের ওপর যেমন নৃশংস হামলা চালিয়েছে ভবিষ্যতে তা আরও ভয়াবহ আকারে চালানোর সাহস পাবে। তারা তখন গণহারে শিক্ষার্থীদের লাশ ফেলতে মরিয়া হয়ে ওঠবে। অথচ সিরাজুল ইসলাম চাইলে এ জোবরাবাসীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বের কথা বোঝাতে পারতেন, বলতে পারতেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েগুলো আপনাদেরই সন্তান, আপনাদেরই দায়িত্ব তাদের রক্ষা করার।
তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন: ‘আমরা জমিদার, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক যদি তিনি কিংবা জোবরাবাসী হয়ে থাকেন তাহলে আজ থেকেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে স্বায়ত্বশাসিত যে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা। আর না হয় সেটিকে ‘জোবরা বিশ্ববিদ্যালয়’-এ নামাঙ্কিত করা। শুধু তাই নয়, এটাও নিশ্চিত করা যে, জোবরাবাসী ছাড়া এখানে যাতে বাংলাদেশের আর কোনো অঞ্চলের ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে না পারে। কেননা তাদের চোখে বাকি সবাই ‘বইঙ্গা’। তিনি তার বক্তব্যে শেষাংশে যা বলেছেন তা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। তিনি বলেছেন: ‘বিশ্ববিদ্যালয় যদি আমাদের যথাযথ সম্মান না করে, আমরা জনগণ নিয়ে যা ব্যবস্থা করা দরকার তা করবো।’ আসলে তিনি যে ব্যবস্থার কথা বলেছেন, তা ইতোমধ্যে তিনি-তারা করে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর আকারে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার বন্দোবস্তের কথাই তিনি বলেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তিনি কী মনোভাব পোষণ করেন কিংবা কোন চোখে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেখেন তা তার এমন বক্তব্যে ফুটে ওঠে। সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর জোবরাবাসীর নৃশংস হামলা ও তার এমন বক্তব্যের দৃঢ়তা খুঁজতে যেতে হবে একটু পেছনে। দেড় বছর আগে জোবরাবাসীসহ হাটহাজারীবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে হাটহাজারীর শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা দাবি করে আন্দোলন করেছিল। তখন এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই সিরাজুল ইসলাম। যদিও শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে তা সফল হয়নি। তখন থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর তাদের ক্ষোভ তৈরি হয়।
মামুন কিংবা সায়েমরা এখনো হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, এখনো নিরীহ নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের রক্তের দাগ শুকায়নি। আর সিরাজুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের পরিবর্তে উল্টো জোবরাবাসীকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আরও ভয়ংকর আরও বেপরোয়া হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ তিনিও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকতা। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকতা হয়েও তিনি কীভাবে কোন শক্তিবলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেন?
জোবরাবাসীর শক্তির শেকড় এরকম সিরাজুল ইসলামরাই। তাদের কারণেই তারা অন্ধকার ঠেলে আলোর দিকে ধাবিত হতে পারছে না। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা মূর্খ-বর্বর-ধর্মান্ধ জোবরাবাসীদের ব্যবহার করেন, যাদের সহজেই ‘ম্যানিপুলেট’ করা যায়। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৬০ বছরেও জোবরা আলোকিত হয়নি।
জোবরাবাসীর নৃশংস হামলায় ১৫০০ শতাধিক শিক্ষার্থীর যে রক্ত ঝরলো তারা কি সেটির বিচার পাবেন? যদিও বিচার চাওয়া এদেশে এখন হাস্যকর একইসঙ্গে লজ্জাকর ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আর ভাঙতে হবে ‘জোবরা সিন্ডিকেট’। তা না হলে ষাটোর্ধ্ব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই তার অস্তিত্ব হারাবে, পরিণত হবে অভূতপূর্ব কোনো রক্তগঙ্গায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট