Tuesday 09 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণতন্ত্রের নতুন প্রভাত: প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতির মোড়কে ডাকসু নির্বাচন

ফাহিম হাসনাত
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৯:০২ | আপডেট: ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৯:০৩

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাসে এখন ভেসে বেড়াচ্ছে নির্বাচনী আমেজ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেই কাঙ্ক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। তবে এবারের নির্বাচনটি শুধু একটি সাধারণ ছাত্র সংসদ নির্বাচন নয়; এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ফ্যাসিবাদের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আয়োজিত এই নির্বাচন যেন শিক্ষার্থীদের জন্য এক নতুন আস্থা ও আশার আলো নিয়ে এসেছে। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে বিরাজ করছে এক উৎসবমুখর পরিবেশ, যেখানে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে এবং স্বাধীনভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ পাবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছে।

বিজ্ঞাপন

স্বচ্ছতার নতুন দিগন্ত: ভয়মুক্ত পরিবেশে ভোট

এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন হলো ভোটকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা হলের অভ্যন্তরে ভোটকেন্দ্রের প্রথা এবার বিলুপ্ত করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে হলের বাইরে, উন্মুক্ত পরিবেশে। এই একটি সিদ্ধান্তই শিক্ষার্থীদের মন থেকে ভয়-ভীতি ও চাপের কালো মেঘ সরিয়ে দিয়েছে। অতীতে হলের অভ্যন্তরে ভোটকেন্দ্র থাকায় নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠনের প্রভাব বিস্তারের যে অভিযোগ উঠত, এবার তা থেকে মুক্তি মিলবে। এর সাথে যোগ হয়েছে প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মতো আধুনিক প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা, যা নির্বাচনকে আরও স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপমুক্ত পরিবেশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিশ্বাস স্থাপন করেছে যে, এবারের নির্বাচন হবে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং এতে প্রতিফলিত হবে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মতামত।

মতাদর্শের লড়াই: প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল ও পদের সমীকরণ

এবারের ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে ছয়টি শক্তিশালী প্যানেল এবার আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট (ইসলামী ছাত্রশিবির), বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংগঠন, প্রতিরোধ পরিষদ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টুডেন্ট ইউনিটি এবং ডাকসু ফর চেঞ্জ।

ডাকসুতে কেন্দ্রীয় পর্ষদের মোট পদ সংখ্যা ২৮টি, যার মধ্যে ১৫টি সম্পাদকীয় এবং ১৩টি সদস্য পদ। এর পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার নিজ নিজ আবাসিক হলের জন্য নির্ধারিত হল সংসদে আরও ১৩টি পদে ভোট দেবেন। সুতরাং, আবাসিক কিংবা অনাবাসিক প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ডাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে মোট ৪১টি ভোট দিতে হবে। এই বিশাল সংখ্যক পদে প্রার্থী বাছাই করা ভোটারদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

এ বছর মোট ৩৯,৭৭৫ জন ভোটারের মধ্যে ১৮,৯০২ জনই নারী, যা মোট ভোটের ৪৭.৫২ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক নারী ভোট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠবে। ডাকসুর ২৮টি পদের জন্য চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন ৪৭১ জন প্রার্থী। এর মধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৪৫ জন এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা তীব্র লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে।

ভিপি পদে ছাত্রদলের মো. আবিদুল ইসলাম খান, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের (শিবির) সাদিক কায়েম, প্রতিরোধ পর্ষদের শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি এবং ডাকসু ফর চেঞ্জের (ছাত্র অধিকার পরিষদ) বিন ইয়ামিন মোল্লার মতো প্রার্থীরা মূল আলোচনায় রয়েছেন। অন্যদিকে, জিএস পদে ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম, প্রতিরোধ পর্ষদের মেঘ মল্লার বসু এবং ডাকসু ফর চেঞ্জ প্যানেলের সাবিনা ইয়াসমীনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে, জিএস পদে সাবিনা ইয়াসমীনের প্রার্থিতা নারী নেতৃত্বের অগ্রযাত্রাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

ফলাফলের নেপথ্যে যেসব সমীকরণ

এবারের নির্বাচনের ফলাফল কেবল প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করছে না, এর পেছনে কাজ করবে আরও অনেক জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক সমীকরণ।

প্যানেল ভোটের শক্তি বনাম স্বতন্ত্র ভাবনা: রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত প্যানেলগুলো তাদের সমর্থকদের ‘প্যানেল ভোট’ বা একাট্টা ভোটের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা, যারা কোনো দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন, তারা ৪১টি পদের সবগুলোতে ভোট না-ও দিতে পারেন। তারা ভিপি-জিএস-এজিএসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিয়ে বাকি পদগুলোতে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। এই ‘বিচ্ছিন্ন ভোট’ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে এবং বড় প্যানেলগুলোর সব পদে জয়ের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যে প্যানেল নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি এই বিচ্ছিন্ন ভোটারদের টানতে পারবে, তারাই শেষ হাসি হাসবে।

গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি বনাম মুক্তির আকাঙ্ক্ষা: বিগত বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম ও গেস্টরুমের নামে চলা নিপীড়নমূলক সংস্কৃতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। ছাত্রলীগের একাধিপত্যের অধীনে চলা এই নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবারের নির্বাচনে বড় একটি ইস্যু। প্রায় সব প্রার্থীই এই সংস্কৃতি থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, এবং ভোটাররা সেই প্রতিশ্রুতিকেই তাদের ভোটের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করবেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রভাব: সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থান প্রতিটি প্রার্থীর জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। আন্দোলনে কার কী ভূমিকা ছিল, তা ভোটারদের স্মৃতিতে এখনো সতেজ। যারা স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তারা স্বাভাবিকভাবেই ভোটারদের কাছে বাড়তি সহানুভূতি ও সমর্থন পাবেন।

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির প্রয়াস: এবারের নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি প্যানেল নিজেদের অন্তর্ভুক্তিমূলক হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছে। নারী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এমনকি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও প্রার্থী করা হয়েছে। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠনগুলোও তাদের প্যানেলে নারী ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রার্থীদের জায়গা দিয়েছে। এটি ছাত্র রাজনীতির একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। তবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছাত্রশিবিরের একজন প্রার্থীর বিতর্কিত মন্তব্য তাদের পুরো প্যানেলকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে, যা প্রমাণ করে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পথটি এখনো সহজ নয়।

একটি গণতান্ত্রিক মাইলফলকের প্রত্যাশা

সব মিলিয়ে, এবারের ডাকসু নির্বাচন কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, পুরো দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে চলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা যদি শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে, তবে এই নির্বাচন থেকে উঠে আসবে সত্যিকারের ছাত্র নেতৃত্ব। এই নেতৃত্বই আগামী দিনে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা করবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ডাকসু নির্বাচন হোক গণতন্ত্র চর্চার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এই প্রত্যাশা আজ সকলের।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

ডাকসু নির্বাচন ফাহিম হাসনাত মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর