সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এটি এখন আর কেবল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই, বরং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ এবং নজিরবিহীন ঘটনাটি ঘটে কাতারের রাজধানী দোহায়, যেখানে ইসরায়েল সরাসরি একটি সম্মেলন ভবনে বিমান হামলা চালিয়ে হামাসের আলোচনায় অংশ নেওয়া নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করে। এই হামলাটি শুধু একটি দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ নয়, বরং যুদ্ধবিরতির জন্য চলমান কূটনৈতিক আলোচনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে নস্যাৎ করার একটি বর্বর প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক আইন এবং ন্যূনতম মানবিকতার তোয়াক্কা না করে ইসরায়েল আবারও প্রমাণ করেছে যে, তাদের সামরিক ঔদ্ধত্য কতটা লাগামহীন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ ছিল ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের নিপীড়নের এক অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক এবং আল-আকসা মসজিদের মুসল্লিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, অবরোধ ও দখলদারিত্বের ফল। এই অভিযানের মধ্য দিয়ে হামাস সহস্রাধিক ইসরায়েলিকে হতাহত করে এবং ৩০০-এর বেশি সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে জিম্মি করে। এই ঘটনায় ইসরায়েল মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় এক সর্বাত্মক ও নির্বিচার সামরিক অভিযান শুরু করে, যা এখন পর্যন্ত চলছে।
ইসরায়েলি বাহিনী (আইডিএফ) গাজা উপত্যকাকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। তারা নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নারী, শিশুসহ নিরপরাধ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। তাদের এই বর্বরতার মুখেও তারা জিম্মিদের মুক্ত করতে পারেনি। বরং, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই দফা যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে হামাসই শতাধিক জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে। এটি ইসরায়েলের সামরিক ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে তোলে। ইসরায়েলের উদ্দেশ্য জিম্মি উদ্ধার নয়, বরং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা এবং গাজাকে সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেওয়া।
ইসরায়েলের এই লাগামহীন আগ্রাসনের পেছনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এক বড় কারণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো একদিকে ইসরায়েলকে বিপুল পরিমাণ সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে গাজায় চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাদের এই দ্বিমুখী নীতি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে আরও ঔদ্ধত্যপূর্ণ করে তুলেছে। তিনি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার অধিকারকে অস্বীকার করে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ গঠনের নীলনকশা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।
শুধু পশ্চিমা দেশগুলোই নয়, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় দেশগুলো যেমন সৌদি আরব, তুরস্ক, এবং অন্যান্য আরব দেশগুলোর ভূমিকাও অত্যন্ত হতাশাজনক। তারা মুখে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দা জানালেও, পর্দার আড়ালে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এই নীরবতা ও দ্বৈত নীতির সুযোগ নিয়ে ইসরায়েল গত এক মাসে মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত ছয়টি দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে। ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন ও কাতারে হামলা চালিয়ে তারা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলেছে। এই নীরবতা ইসরায়েলকে আরও বেপরোয়া ও আগ্রাসী হয়ে উঠতে উৎসাহিত করছে।
ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকের বেশিই নারী ও শিশু। দেড় লক্ষাধিক মানুষ আহত হয়েছে। ইসরায়েল শুধু বোমা হামলা চালিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, তারা হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র এবং খাদ্য ও পানি সরবরাহের মতো মৌলিক অবকাঠামো ধ্বংস করে ২০ লক্ষাধিক মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এটি সুস্পষ্ট গণহত্যা, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
গাজায় চলমান এই মানবিক বিপর্যয় এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে। খাবার ও চিকিৎসার অভাবে মানুষ তিলে তিলে মারা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে হলিউডের হাজার হাজার শিল্পী ও নির্মাতা ইসরায়েলকে বর্জনের ডাক দিলেও, মুসলিম দেশগুলো এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ। গাজার শিশুদের রক্ষা করতে তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা সমগ্র সভ্যতার জন্য এক লজ্জাজনক ঘটনা।
জাতিসংঘের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বারবার নিন্দা প্রস্তাব পাস করলেও, তা বাস্তবায়নে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে, আর জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কেবল বিবৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। এই ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে, বিশ্বমানবতা এক অনিবার্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
কাতারে ইসরায়েলের বিমান হামলা এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যা এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি আর কোনো আঞ্চলিক সংঘাত নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইন, কূটনীতি এবং মানবতার ওপর সরাসরি আঘাত। বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবশ্যই এই বর্বরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইসরায়েলি আগ্রাসন, গণহত্যা এবং টার্গেটেড কিলিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে বিশ্ব একটি ভয়াবহ মানবিক ও নৈতিক সংকটের দিকে ধাবিত হবে। এটি কেবল ফিলিস্তিনের বিষয় নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির বিবেক ও নৈতিকতার পরীক্ষা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়