Sunday 21 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভিউ বনাম মূল্যবোধ: হারাচ্ছে কি পেশার শ্রেষ্ঠতা?

তানজিদ শুভ্র
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:০৪

‘এই সপ্তাহে একটা রিল বানাতেই হবে!’ কিংবা ‘মনিটাইজেশন কমে গেছে, ফেসবুক বুঝি আর পেটের দায় নেবে না!’- এমন হাহুতাশ একসময় শুধু ইউটিউব-ফেসবুক নির্ভর কনটেন্ট নির্মাতাদের মুখেই শোনা যেত। কিন্তু এখন? এখন শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, এমনকি সরকারি চাকুরের কণ্ঠেও শোনা যাচ্ছে একই সুর। গাঁটের পয়সায় পড়াশোনা করে, বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে গড়ে ওঠা পেশাগত পরিচয় যেন হঠাৎ করেই একেকটা ‘চ্যালেঞ্জ’ বা ‘রিল’-এর ভিউয়ের নিচে ঢলে পড়ছে। তখন প্রশ্ন জাগে, এই পথে হাঁটতে গিয়ে কি পেশার শ্রেষ্ঠতা ও দায়বোধ হারিয়ে যাচ্ছে?

কন্টেন্ট মনিটাইজেশন এক নতুন প্রলোভনের দরজা খুলে দিয়েছে। শিক্ষক ভাবছেন, ক্লাসের চেয়ে টিউটোরিয়াল ভিডিওতে ভিউ বেশি আসে। চিকিৎসক দেখছেন, রোগীর সঙ্গে কথোপকথনের ছোট্ট ভিডিও ক্লিপে লাইক পড়ে হাজারে হাজারে। কেউ কেউ এমনকি পরীক্ষা নিতে নিতে ক্যামেরা তাক করছেন ছাত্রদের দিকে, যেন দর্শকসংখ্যাই এখন মিশন সফলতার মানদণ্ড!

বিজ্ঞাপন

একসময় শিক্ষক ছিলেন জ্ঞানের গুরুজন, চিকিৎসক ছিলেন আস্থার প্রতীক, আইনজীবী ছিলেন নীতির মানদণ্ড। অথচ এখন তাদের কেউ কেউ নিয়মিত ভিডিও আপলোড না দিলে কনটেন্ট অ্যালগরিদমে ‘মরতে’ থাকেন। হতাশ হন, যখন ফেসবুক বা ইউটিউব ঘোষণা দেয় ‘এই অঞ্চল থেকে ভিডিওতে আর ইনকাম হবে না।’ তখন মনে হয়, সত্যিই কি এটাই সেই শিক্ষকতা যেখানে ছাত্রের চিন্তার বিকাশই ছিল মূল উদ্দেশ্য? সত্যিই কি এটাই চিকিৎসা যেখানে রোগীর ব্যক্তিগত কথাও আশ্রয়যোগ্য ছিল?

সমস্যা শুধু রিল বানানোতে নয়, সমস্যা তার পদ্ধতিতে। একজন শিক্ষকের ক্লাসে ছাত্রদের অনুমতি ছাড়া ভিডিও ধারণ কি গ্রহণযোগ্য? একজন চিকিৎসক যখন রোগীকে না জানিয়ে ক্যামেরায় কথোপকথন ধরে রাখেন, তা কি পেশাগত শালীনতা লঙ্ঘন নয়? সর্বত্র এসে দাঁড়ায় ‘কনসেন্ট’ বা সম্মতির প্রশ্ন। যার ছবি, যার কণ্ঠ, যার ব্যক্তিগত তথ্য সবই তো হয়ে যাচ্ছে কনটেন্টের কাঁচামাল। অথচ পেশার প্রথম পাঠই তো ছিল- গোপনীয়তা, বিশ্বাস, মর্যাদা।

এভাবে ক্যামেরা যদি হয়ে ওঠে পেশার প্রতিস্থাপক, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কাকে অনুসরণ করবে? শ্রদ্ধার জায়গা কি ফলোয়ারের সংখ্যা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব? উত্তর আমাদের সবার জানা।

তবে এত সব সমালোচনার মাঝেও একটি সত্য অস্বীকার করা যায় না, কনটেন্ট তৈরি সবসময় খারাপ কিছু নয়। বরং অনেক শিক্ষক ইউটিউব বা ফেসবুকের মাধ্যমে জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরছেন শিক্ষার্থীর উপকারের জন্য। অনেক চিকিৎসক রোগ বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভিডিও বানিয়ে। অনলাইনে শিক্ষামূলক কিংবা স্বাস্থ্যবিষয়ক কনটেন্টের মাধ্যমে অনেকেই প্রকৃত অর্থেই মানুষকে সাহায্য করছেন।

তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা তখনই, যখন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় শুধু ভিউ আর ইনকাম, আর উপায় হয়ে ওঠে ‘ভাইরাল হবার খোঁজ’। তখনই পেশা হারায় তার গাম্ভীর্য, গৌরব, গভীরতা। শিক্ষক হয়ে ওঠেন উপস্থাপক, চিকিৎসক হয়ে যান ক্যামেরার পারফর্মার। তখন আর পেশা থাকে না, থাকে কেবল জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রতিযোগিতা।

এই সময়ের তরুণ প্রজন্ম আমাদের দেখছে, শিখছে। তারা খুঁজছে প্রকৃত নায়ক কাকে বলা যায়। তারা দেখছে সম্মান অর্জনের পথ কি—জ্ঞান, দক্ষতা আর মূল্যবোধ, নাকি ফলোয়ার সংখ্যা আর রিলের ভাইরালিটি। তাই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে সবারই নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার: আমার ভিডিও কি মানুষকে শেখায়, না কেবল দেখায়? আমি কি দায়িত্ব নিচ্ছি, না শুধু মনিটাইজেশনের দৌড়ে অংশ নিচ্ছি?

পেশার পোশাক খুলে কনটেন্ট নির্মাতার পোশাক পরা সহজ; কিন্তু শ্রদ্ধার আসন ধরে রাখা কঠিন। এই কঠিন কাজটাই করতে হবে, যদি আমরা চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদেরকে ‘ডিজিটাল পারফর্মার’ নয়, বরং ‘দৃষ্টান্ত’ হিসেবে দেখুক।

ডিজিটাল কনটেন্ট এখন জীবনের অংশ, এটা থামানো যাবে না, থামানোও উচিত নয়। বরং প্রয়োজন, পেশাদাররা যেন বুঝতে পারেন তাদের প্রতিটি ভিডিও, প্রতিটি রিল আসলে দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। যেমন শিক্ষক কেবল পড়ান না, তিনি দিকনির্দেশনা দেন; চিকিৎসক কেবল রোগ সারান না, তিনি আস্থা গড়ে তোলেন; সাংবাদিক কেবল খবর পরিবেশন করেন না, তিনি সত্যের মানদণ্ড তৈরি করেন।

এই দায়বোধ যখন ভিউ-শিকারির কাছে হার মানে, তখনই পেশার শ্রেষ্ঠতা ক্ষয় হতে থাকে। তাই এখনই সময় নতুন করে ভেবে দেখার, আমরা আসলে কী হতে চাই: ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’, নাকি ‘পেশাজীবী’?

লেখক: শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর

সারাবাংলা/এএসজি

তানজিদ শুভ্র ভিউ মুক্তমত মূল্যবোধ

বিজ্ঞাপন

আবেগ আর রঙিন আমেজে আসছে শারদীয় উৎসব
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর