Sunday 21 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দালাল চক্রে জিম্মি সরকারি হাসপাতাল: নেপথ্যে কারা?

ফাহিম হাসনাত
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৯:০৬

বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলো সাধারণ মানুষের জন্য একধরনের শেষ আশ্রয়স্থল। দেশের সিংহভাগ মানুষ, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ, উন্নত চিকিৎসার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী দালাল চক্র, যা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করছে। হাসপাতালের গেট থেকে শুরু করে জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ, প্যাথলজি ল্যাব, এমনকি কেবিন পর্যন্ত সর্বত্র এই দালালদের অবাধ বিচরণ। এরা রোগীদের বিভ্রান্ত করে, শোষণ করে এবং মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। এটি নিছক কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট, যা আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এক অশুভ ছায়া ফেলে রেখেছে।

বিজ্ঞাপন

দালাল চক্রের বিস্তৃতি ও কাজের ধরন:

দালাল চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত কৌশলী এবং তাদের কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপক। তারা হাসপাতালের ভেতরে এবং বাইরে সক্রিয় থাকে। একজন রোগী বা রোগীর স্বজন হাসপাতালে পা রাখার সাথে সাথেই তারা তাদের শিকার খোঁজা শুরু করে। সাধারণত তারা নিজেদেরকে হাসপাতালের কর্মচারী বা রোগীর শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচয় দেয়। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো রোগীকে সরকারি হাসপাতালে প্রাপ্য সেবা সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া।

এই চক্রের সদস্যরা রোগীদের বোঝায় যে, সরকারি হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা হয় না, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নষ্ট, বা ডাক্তাররা পর্যাপ্ত সময় দেন না। এরপর তারা রোগীকে প্রলোভন দেখায় যে, তারা কম খরচে এবং দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেবে। এরপর তারা রোগীদের নিজেদের পছন্দের বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের গোপন চুক্তি থাকে, যার বিনিময়ে তারা মোটা অঙ্কের কমিশন পায়।

উদাহরণস্বরূপ, একজন রোগী জরুরি বিভাগে গেলে তাকে বলা হয় যে এখানে কোনো বেড খালি নেই বা ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এরপর তাকে দ্রুত একটি নির্দিষ্ট প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে, কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হলে রোগীদের হাসপাতালের ল্যাবে না পাঠিয়ে বাইরের নির্দিষ্ট প্যাথলজিতে পাঠানো হয়। এমনকি, হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলে দালালরা বেড খালি থাকা সত্ত্বেও রোগীদের বলে যে কোনো সিট খালি নেই এবং তাদের জোর করে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

এই দালাল চক্রের সদস্যরা শুধুমাত্র অর্থলোভী নয়, তারা মানুষের জীবন নিয়েও ছিনিমিনি খেলে। অনেক সময় তাদের ভুল তথ্য ও প্ররোচনার কারণে রোগীর চিকিৎসার সময়ক্ষেপণ হয়, যা তার জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

সমস্যার মূলে কারা?

দালাল চক্রের এই সিন্ডিকেট শুধুমাত্র বাইরে থেকে পরিচালিত হয় না। অভিযোগ রয়েছে, এর সাথে হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ কিছু অসাধু কর্মচারীও জড়িত। হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মী, ওয়ার্ড বয়, আয়া, ক্লিনার এবং কিছু অসাধু প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও চিকিৎসকও এই চক্রের অংশ। তারা দালালি কার্যক্রমকে সহজ করে তোলে এবং তাদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন পায়। এই অভ্যন্তরীণ যোগসাজশই এই চক্রকে এতটাই শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে।

তারা রোগীদের তথ্য ফাঁস করে, হাসপাতালের ভেতরের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেয় এবং দালালদেরকে নির্দিষ্ট রোগীদের কাছে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে। এর ফলে, রোগীর পক্ষে দালালদের থেকে নিজেকে রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই দালালদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হলেও সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হয় না। এর প্রধান কারণ হলো, গ্রেপ্তারকৃত দালালদের লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড শেষে তারা আবার একই কাজে ফিরে আসে, যা তাদের ঔদ্ধত্য আরও বাড়িয়ে দেয়।

আইনের দুর্বলতা ও জবাবদিহিতার অভাব:

আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং প্রশাসনিক শৈথিল্যই এই সমস্যার প্রধান কারণ। বর্তমানে দালালির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো কঠোর আইন নেই। এ ছাড়া, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার অভাবও এই সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে। কোনো হাসপাতালে দালাল চক্রের উপস্থিতি শুধুমাত্র রোগীর দুর্ভোগের কারণ নয়, বরং এটি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতারও সুস্পষ্ট প্রমাণ। যতক্ষণ পর্যন্ত হাসপাতালের পরিচালক এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এই সমস্যার জন্য সরাসরি জবাবদিহিতার আওতায় আনা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা কঠিন।

স্থায়ী সমাধানের জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ:

এই গুরুতর সমস্যা সমাধানের জন্য শুধুমাত্র মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী এবং সমন্বিত পরিকল্পনা, যেখানে প্রশাসনিক, আইনি এবং প্রযুক্তিগত পদক্ষেপগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

১. আইন সংশোধন ও কঠোর প্রয়োগ: দালালির কার্যক্রমকে একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন সংশোধন করা উচিত। একইসাথে, এই আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দালালদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড এবং মোটা অঙ্কের জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে।

২. প্রশাসনিক কঠোরতা: হাসপাতালের অভ্যন্তরে কর্মরত যে সমস্ত কর্মচারী এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা উচিত। একইসাথে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দালালমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

৩. প্রযুক্তিগত সমাধান: প্রতিটি হাসপাতালের প্রবেশদ্বার, জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়াতে হবে। হাসপাতালগুলোতে ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে রোগীরা সহজেই সঠিক তথ্য পেতে পারে। এছাড়াও, একটি হটলাইন বা মোবাইল অ্যাপ চালু করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে রোগীরা দালালদের সম্পর্কে সরাসরি অভিযোগ করতে পারবে।

৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যমে এবং হাসপাতালের ভেতরে দালাল চক্র সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রচারমূলক কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। রোগীরা যাতে দালালদের প্রলোভনে না পড়ে, সেই বিষয়ে তাদের সতর্ক করতে হবে। একইসাথে, হাসপাতালের সেবার মান উন্নীত করা জরুরি, যাতে রোগীরা দালালদের ওপর নির্ভরশীল না হয়।

৫. স্বেচ্ছাসেবক দল: প্রতিটি হাসপাতালে একদল নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা যেতে পারে, যারা রোগীদের পথ দেখাবে এবং সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। এতে করে দালালদের সুযোগ কমে যাবে।

স্বাস্থ্যসেবা কোনো বাণিজ্যিক পণ্য নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার। সরকারি হাসপাতালগুলো জনগণের আস্থার জায়গা, কিন্তু এই দালাল চক্র সেই আস্থা নষ্ট করে দিচ্ছে। যদি সরকার সত্যিই ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’ নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে প্রথমেই এই দালাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী এবং কঠোর অবস্থান নিতে হবে। প্রশাসনিক কঠোরতা, আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা – এই তিনটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করেই দালালমুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। তা না হলে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি মানুষের ভরসা আরও কমে যাবে এবং আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়ে থাকবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

দালাল চক্রে জিম্মি সরকারি হাসপাতাল ফাহিম হাসনাত মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর