Thursday 25 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শি জিনপিং: চীনের পুতিন নাকি নিজস্ব মডেল?

হাফিজুর রহমান
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:৫৯

বেইজিংয়ের থিয়ানআনমেন স্কোয়ারের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ৮০ হাজার সাদা ঘুঘু। সেই সঙ্গে উড়ছে ৮০ হাজার রঙিন বেলুন। নিচে ঝলসে উঠছে আধুনিক ও ভয়ংকর সব অস্ত্র, আর বিশাল কুচকাওয়াজে অংশ নিচ্ছে ১০ হাজার সেনা। ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫- দিনটি কেবল সামরিক শক্তির প্রদর্শনীতে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং রাজনৈতিকভাবেও হয়ে উঠেছিল এক অনন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বিশ্বনেতাদের আগমনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন মার্কিনবিরোধী তিন রাষ্ট্রনায়ক- শি জিনপিং, ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উন। প্রথমবারের মতো তারা দাঁড়ালেন একই মঞ্চে। আরও একটি ইতিহাস লেখা হলো সেদিন বিশ্বনেতাদের কূটনৈতিক মঞ্চে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থিত হলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন।

বিজ্ঞাপন

এভাবেই, চীন সম্প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উদযাপন করল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের মাধ্যমে পূর্ব এশিয়ায় এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, যেখানে চীনের জনগণ তীব্র কষ্ট, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সম্মান পুনরুদ্ধার করে। এই উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘চীনা জাতি এক মহান জাতি যারা কখনো কোনও উৎপীড়নের দ্বারা ভীত হয় না। এবং নিজের শক্তিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।’ শি-এর এই বক্তব্য কেবল একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচারণ নয়, বরং বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের শক্তিশালী অবস্থান ঘোষণা করার প্রতীকী ভাষা।

শি জিনপিং ২০১২ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন এবং ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে এবং তিনি ধাপে ধাপে নিজেকে চীনের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শি শুধু প্রেসিডেন্ট নন, তিনি সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং পার্টির সাধারণ সম্পাদকও, যা তাকে কার্যত রাষ্ট্র, সরকার ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব দিয়েছে। ফলে তার ক্ষমতা চীনের আধুনিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব।

চীনের সংবিধান অনুযায়ী আগে একজন প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। কিন্তু ২০১৮ সালে এই সাংবিধানিক সীমা বাতিল করা হয়। এর ফলে শি জিনপিংয়ের সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার পথ খুলে যায়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পদক্ষেপ ছিল একেবারেই কৌশলগত, কারণ এর মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, ভবিষ্যতে তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার মতো সাংবিধানিক বাধা আর থাকবে না।

এই পরিস্থিতিকে অনেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মডেলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পুতিনও বিভিন্ন সাংবিধানিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় আছেন। যেমন, কখনো প্রেসিডেন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, আবার পরে প্রেসিডেন্টে ফিরে এসেছেন এবং ২০২০ সালে সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তৈরি করেছেন। এর মানে কি তাহলে, শি জিনপিং চীনের পুতিন?

তবে, শি জিনপিং-কে কেবল ‘চীনের পুতিন’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া পুরো চিত্র তুলে ধরে না। পুতিন যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ব গড়ে তুলেছেন এবং মূলত নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল, সেখানে শি বরং পার্টি-কেন্দ্রিক শাসনকে শক্তিশালী করেছেন। তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান লক্ষ লক্ষ কর্মকর্তা ও নেতাকে শাস্তি দিয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা দমে গেছে এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে শি একজন সংস্কারক ও দৃঢ় নেতার ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছেন (The Economist, 2022)। ফলে চীনে শি-এর নেতৃত্ব শুধু প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, বরং কমিউনিস্ট পার্টি ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা হিসেবেও বহুমাত্রিক ক্ষমতার প্রতীক।

৮০ বছর পূর্তির বক্তৃতায় শি ইতিহাসকে বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনের জনগণের ঐক্য ও আত্মত্যাগকে সামনে এনেছেন, যা আজকের জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দেয়। ‘শতাব্দীর অপমান’ কথাটি চীনের রাজনৈতিক ইতিহাসে বারবার উঠে এসেছে- আফিম যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিদেশি দমননীতি পর্যন্ত। শি সেই অপমানের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেন এবং বলেন যে আজকের চীন আর দুর্বল রাষ্ট্র নয়। এ ধরনের ভাষণ একদিকে জাতীয় গর্ব বাড়ায়, অন্যদিকে জনগণের কাছে শি-এর নেতৃত্বকে একমাত্র ভরসার জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শি জিনপিং এক ধরনের দ্বৈত কৌশল অবলম্বন করেছেন। তার ঘোষিত ‘চায়নিজ ড্রিম’ বা চীনের পুনর্জাগরণের স্বপ্নের মূল লক্ষ্য হলো দেশকে একবিংশ শতাব্দীতে বৈশ্বিক পরাশক্তিতে রূপান্তর করা। এর মাধ্যমে তিনি শুধু অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীনের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। বিশেষ করে প্রযুক্তি, অবকাঠামো, শিল্পোন্নয়ন ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনকে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো তার নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

তবে এই পথ মোটেও সহজ নয়। শি’কে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে একাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্যযুদ্ধ, উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পে (যেমন সেমিকন্ডাক্টর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রতিযোগিতা, এবং দক্ষিণ চীন সাগর বা তাইওয়ান ইস্যুকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা চীনের কৌশলগত পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলেছে। অর্থাৎ, একদিকে তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে চান, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের চাপ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হচ্ছে।

এখানেই পুতিনের সঙ্গে তার পার্থক্য স্পষ্ট হয়। পুতিন পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে একপ্রকার বিচ্ছিন্নতাবাদী অবস্থান নিয়েছেন এবং চীন, ইরান বা গ্লোবাল সাউথের কিছু দেশের সঙ্গে বিকল্প অক্ষ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শি জিনপিং বরং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতর থেকেই চীনের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছেন। তিনি পশ্চিম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার বদলে, বৈশ্বিক অর্থনীতির নিয়ম ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার কৌশল নিয়েছেন।

এই উদ্দেশ্যে শি জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF), এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন। একই সঙ্গে তিনি নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন, যেমন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (AIIB) এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI), যার মাধ্যমে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। গবেষকরা (Brookings, 2023) মনে করেন, এসব প্রচেষ্টা শি’র কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ, যেখানে তিনি আন্তর্জাতিক অর্থনীতিকে একেবারে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে বরং এর অভ্যন্তরে থেকেই চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন।

তবে সমালোচকেরা বলেন, শি-এর ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য এক ধরনের হুমকি। চীনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশ সীমিত হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বাড়ছে, এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম ও শিক্ষাঙ্গনে শি-এর চিন্তাধারা (‘Xi Jinping Thought’) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা পুতিনের রাশিয়ার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়। আবার অনেকে মনে করেন, শি পার্টি-কেন্দ্রিক এই শাসনকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন, ফলে তার শাসনব্যবস্থা পুতিনের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

এই তুলনায় এক মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসে, তা হল- শি কি পুতিনের পথে হাঁটছেন, নাকি নিজের পথ তৈরি করছেন? দুই নেতার মধ্যে মিল আছে: উভয়েই দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছেন, সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শাসনকে বৈধতা দিচ্ছেন, জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পশ্চিমা আধিপত্যের বিকল্প দাঁড় করাতে চাইছেন। কিন্তু একই সঙ্গে মৌলিক পার্থক্যও রয়ে গেছে। পুতিন মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্বের প্রতীক, যেখানে রাষ্ট্র তার ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। শি বরং পার্টিকে সর্বোচ্চ শক্তি হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং নিজেকে সেই কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করছেন।

৮০ বছর পূর্তির বক্তব্য আসলে এক বড় রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। শি-এর ভাষণ চীনের জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে তাদের ইতিহাস সংগ্রামের, আর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শক্ত হাতে নেতৃত্বের ওপর। একই সঙ্গে বাইরের বিশ্বকে সতর্ক করা হয়েছে—চীন শান্তিপ্রিয় হলেও কোনো প্রকার আগ্রাসন বা হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না। এই বার্তা আজকের ভূ-রাজনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে তাইওয়ান পর্যন্ত নানা ইস্যুতে উত্তেজনা বাড়ছে।

সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, শি জিনপিং-এর নেতৃত্বকে কেবল পুতিনীয় কর্তৃত্ববাদ হিসেবে দেখা সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি হবে। বরং শি এমন এক নতুন মডেল দাঁড় করাচ্ছেন, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, জাতীয়তাবাদের আবেগ, এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার সমন্বয়ে চীনকে দীর্ঘমেয়াদি পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা রয়েছে। পুতিনের পথ হয়তো তাকে কিছুটা অনুপ্রাণিত করেছে, কিন্তু শি মূলত নিজের পথেই হাঁটছেন- একটি নয়া পথ, যা চীনকে আগামী কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যেতে পারে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং মুক্তমত শি জিনপিং হাফিজুর রহমান

বিজ্ঞাপন

‘ইউনূস সাহেব বৈষম্য সৃষ্টি করেছেন’
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:৩১

আরো

সম্পর্কিত খবর