Thursday 25 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চুলের যত্ন থেকে দেশের যত্ন: মনোযোগের সংকট

সাদিয়া সুলতানা রিমি
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:১৮

আমরা প্রতিদিন যে সমাজে বাস করি, সেখানে প্রতিটি মুহূর্তেই ঘটে চলেছে নানা রকম ঘটনা। কেউ নতুন চাকরি পেলেন, কেউ বা চাকরি হারালেন, কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে, কোথাও নতুন আইন প্রণীত হচ্ছে, আবার কোথাও একটি কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজফিড খুললে দেখা যায়, সেসব ঘটনার অতি অল্প অংশই সেখানে উপস্থিত। বরং তারকাদের চুলের যত্ন, বিদেশি নায়িকার ব্যক্তিগত জীবন, ক্রিকেট দলের জয়ের পর উদযাপন বা পরাজয়ের পর সমালোচনা— এসবই দখল করে রেখেছে আমাদের মনন। এই চিত্রটি কেবল সাধারণ মানুষের মানসিক অবস্থা নয়, বরং পুরো জাতির মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। বাংলাদেশের মতো একটি সম্ভাবনাময় দেশের জন্য এটি এক গভীর সংকেত। কারণ মনোযোগই হলো উন্নয়ন ও পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। যে বিষয়টিতে মনোযোগ থাকবে, সেখানেই বিনিয়োগ হবে শ্রম, সময় ও মেধা। আর যেটিকে আমরা অবহেলা করব, সেটি ধীরে ধীরে অনুন্নত থেকে যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বেশ কিছু ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি হলো গত ৬ সেপ্টেম্বরের আইইএলটিএস (IELTS) পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস। যে পরীক্ষাটি বিশ্বের শত শত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অপরিহার্য, সেটি নিয়ে বাংলাদেশে কেলেঙ্কারি ঘটেছে—এই খবর বিবিসি-র মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও প্রচার করেছে। এটি নিছক কোনো ছোটখাটো ঘটনা নয়; বরং দেশের শিক্ষার্থীদের ওপর আস্থা, দেশের ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা—সবকিছুর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

কিন্তু এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? দেশের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো একদিন-দুদিন খবরটি প্রচার করল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু স্ট্যাটাস হলো, তারপর আবার সব স্বাভাবিক। কারণ তখন আমরা ব্যস্ত ছিলাম ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিতর্কে বা কোনো ভাইরাল ভিডিওর পেছনে ছুটতে। অথচ এই প্রশ্নফাঁসের দায়দায়িত্ব নিরূপণ, ভবিষ্যতে তা ঠেকানোর উপায় বের করা এবং আন্তর্জাতিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠনের জন্য আমাদের রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক—সবারই এগিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল।

একইভাবে, সুইডেন বা ডেনমার্কের মতো দেশে বাংলাদেশি ছাত্রদের বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের রিপোর্ট ভবিষ্যতে আমাদের ছাত্রদের জন্য ভিসা পাওয়া বা বৃত্তি পাওয়ার পথ কঠিন করে তুলতে পারে। অথচ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে ব্যস্ত নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ক্ষমতার রাজনীতিতে।

এই মনোযোগের সংকট কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাজনৈতিক দল এবং দেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও এর প্রভাব স্পষ্ট। যখন আমেরিকান সৈন্যরা বাংলাদেশের সৈন্যদের সঙ্গে জনপ্রিয় ‘মুড়ির টিন’ গানে নাচছেন, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি ভাইরাল হয়, আমরা হাসাহাসি করি, কেউ কেউ ‘কিউট’ বলেন। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে না— এরা এখানে কাজ করছে কেন? আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণ বা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তাদের উপস্থিতি কী বোঝায়? সেন্ট মার্টিন কেন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে, সেই প্রশ্ন কতজন তুলেছেন?

আমরা অনেক সময় অপ্রাসঙ্গিক ইস্যুকে বড় করে দেখি, কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলোকে আড়াল করি। এর একটি বড় উদাহরণ হলো ধর্মীয় বিতর্ক। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো যখন আড়ালে চলে যায়, তখন হঠাৎ দেখা যায় কোনো একটি ধর্মীয় ইস্যু সামনে চলে এসেছে, সেটি নিয়ে দিন-রাত তর্ক-বিতর্ক চলছে। মানুষ বিভক্ত হচ্ছে, মিডিয়া আলোচনার বিষয় পাচ্ছে, অথচ মূল সমস্যা অপরিবর্তিত রয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষা হলো একটি জাতির মূল শক্তি। কিন্তু সেই শিক্ষা নিয়েই আমরা বারবার ভুল করছি। একজন জনপ্রিয় হুজুর যখন মাদ্রাসায় কম্পিউটার শিক্ষা চালু করার বদলে সাধারণ স্কুলগুলোতে তা চালুর উপদেশ দেন, তখন বোঝা যায় আমাদের অগ্রাধিকার কতটা এলোমেলো। প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে শিশু-কিশোরদের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা দেওয়াটা অপরিহার্য। অথচ আমরা অনেক সময় এটি নিয়ে বিতর্ক করি, দেরি করি, বা একেবারেই অগ্রাধিকার দিই না। মোস্তফা জব্বারের মতো একজন মন্ত্রী যিনি মূলত প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন, তার সময়েও আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ‘হাতেকলমে’ কম্পিউটার শিক্ষা ঠিকমতো প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ১৯৯২ সালে যখন প্রথমবার কম্পিউটার শিক্ষা চালু হয়েছিল, তখনও নানা কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। তিন দশক পেরিয়েও আমরা সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছি। এর ফলে নতুন প্রজন্ম পিছিয়ে পড়ছে, আর দেশও পিছিয়ে যাচ্ছে।

আমরা চুলের যত্নে নানা ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করি। কিন্তু নিয়মিত সুষম খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ কমানোর মাধ্যমে চুলের প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা সম্ভব—এটি আমরা ভুলে যাই। দেশের ক্ষেত্রেও চিত্রটি হুবহু একই। আমরা দেশের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান না করে সাময়িক উত্তেজনা বা বিনোদনের পেছনে ছুটি।

রোনালদো বা হানিয়া আমিরের মতো তারকারা তাদের চুলের পেছনে যে টাকা খরচ করেন, তা তাদের ব্যক্তিগত আয় ও পেশার অংশ। কিন্তু আমরা তাদের মতো হওয়ার স্বপ্নে সেই অর্থ ব্যয় করি, অথচ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব কমই ভাবি। আমাদের সময়, শ্রম, অর্থের একটি বড় অংশ চলে যায় বিনোদন বা ব্যক্তিগত ইমেজ তৈরিতে; অথচ জাতির জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলোতে সে মনোযোগ থাকে না।

অতি-জনসংখ্যা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থা—এসব গুরুতর সমস্যা আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত দাঁড়াচ্ছে। কুয়েটের মতো শীর্ষ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়, তখন এটি একটি সতর্কবার্তা যে আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গভীর সংকটে আছে। কিন্তু আমরা তখনও ব্যস্ত ক্রিকেট দলের জয়ে বা কোনো বিদেশি সিরিয়ালের নতুন এপিসোডে।

একইভাবে, সৌদি আরবের মতো একটি শক্তিশালী দেশ যখন নিজের নিরাপত্তার জন্য সামরিক জোট গঠন করছে, তখন আমাদের মতো একটি দুর্বল দেশের শুধু ক্রিকেট আর নায়িকা নিয়ে মেতে থাকা জাতিগত মূর্খতারই লক্ষণ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে, আর আমরা সেই হুমকি উপলব্ধি না করে বিনোদনের জগতে ডুবে থাকি।

মনোযোগের অভাবের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে। যেসব বিষয়ে আমরা মনোযোগ দিই না, সেসব বিষয়ে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা তৈরি হয় না। ফলে নীতিনির্ধারকেরা জানেন—এখানে কোনো প্রশ্ন তুলবে না কেউ, কোনো জবাবদিহির চাপ থাকবে না। এই সংস্কৃতি চলতে থাকলে দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও অযোগ্যতা আরও বেড়ে যায়।মনোযোগের অভাব কেবল নীতিগত সিদ্ধান্তে নয়, সমাজের সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলে। আমরা ধীরে ধীরে সমালোচনাহীন, প্রশ্নহীন এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হই। তখন অন্যায় দেখলেও কেউ প্রতিবাদ করে না, অন্যায্য নীতি গ্রহণ হলেও কেউ প্রশ্ন তোলে না।

এই মনোযোগের সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের কয়েকটি ধাপে কাজ করতে হবে…

সচেতনতা বৃদ্ধি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় বা ভাইরাল বিষয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে না রেখে, দেশের গুরুতর ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা চালু করতে হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার: প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রযুক্তি, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও নাগরিক দায়িত্ববোধ শেখানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা: গণমাধ্যমকে বিনোদনের পাশাপাশি নীতিগত ও মৌলিক সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করতে হবে।

রাজনৈতিক দলের অগ্রাধিকার বদল: দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে জাতির মৌলিক স্বার্থে তারা যেন কাজ করে, সে জন্য জনগণকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

ব্যক্তিগত স্তরে পরিবর্তন: আমরা প্রত্যেকে নিজেদের সময়ের একটি অংশ দেশের মৌলিক ইস্যু নিয়ে জানার ও আলোচনার জন্য ব্যয় করব।

একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে তার নাগরিকদের মানসিকতার ওপর। আমরা যদি সবসময় সাময়িক বিনোদন, ব্যক্তিগত ইমেজ বা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকি, আর দেশের মৌলিক সমস্যাগুলো আড়ালে রাখি, তাহলে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না।

চুলের যত্নের মতো দেশের যত্নও একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। যেমন নিয়মিত পুষ্টি ও যত্নে চুল প্রাকৃতিকভাবে ভালো থাকে, তেমনি নিয়মিত মনোযোগ, পরিকল্পনা ও উদ্যোগে দেশ উন্নত হয়। দেশের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান, সঠিক শিক্ষা, প্রযুক্তি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা—এসবের দিকে মনোযোগ দিলে একসময় বিনোদনের বিষয়গুলোও নিজে থেকেই ইতিবাচক হয়ে উঠবে।

আমাদের তাই এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে— আমরা কি কেবল তারকাদের চুলের যত্ন আর ক্রিকেটের স্কোরকার্ড নিয়েই মেতে থাকব, নাকি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিকারের মনোযোগী হব। আজ যদি আমরা মনোযোগ ফেরাতে পারি, তাহলে আগামী প্রজন্ম একটি সুস্থ, সচেতন ও উন্নত দেশে বাস করবে। আর যদি ব্যর্থ হই, তবে বিনোদনের আড়ালে আমরা একটি ব্যর্থতার ইতিহাসই রচনা করব।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

মনোযোগের সংকট মুক্তমত সাদিয়া সুলতানা রিমি

বিজ্ঞাপন

‘ইউনূস সাহেব বৈষম্য সৃষ্টি করেছেন’
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:৩১

আরো

সম্পর্কিত খবর